ভক্তি ভূষণ মন্ডল
অ্যালিয়েনেশন শব্দটিকে বাংলা তর্জমায় ‘বিচ্ছিন্নতা’, ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ’ ইত্যাদি ভাবে প্রয়োগ করা হয়। ‘বিচ্ছেদ’ও ‘পৃথককরণ’ অ্যালিয়েনেশনের অর্থ হলেও শব্দটির আর এক বিশেষ অর্থ হলো, ‘যা স্বগত তাকে পরগত করা’, ‘যা অন্তরঙ্গ তাকে বহির্বিশ্বের বস্তুতে পরিণত করা’, ‘যা আপন তাকে পর করে দেওয়া’। তাই, জটিলতার মধ্যে না গিয়ে এই নিবন্ধে ইংরেজি অ্যালিয়েনেশন শব্দটিকেই ব্যবহার করা নিরাপদ।
আমরা যে সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে বাস করি তার নাম ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। এই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ক্রমোন্নতিতে আমরা শিল্পায়নের বিপ্লব পেরিয়ে বর্তমানে আমরা ‘বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির বিপ্লব’ সংক্ষেপে এসটিআর এবং তার সাথে ‘তথ্য ও যোগাযোগের বিপ্লব’সংক্ষেপে আইসিআর যুগের মধ্য দিয়ে চলছি। শিল্পায়নের বিপ্লব থেকে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির বিপ্লব অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শিল্পায়নের যুগের চেয়ে এসটিআর-এর যুগে জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে বহু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এসটিআর বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে, প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগে এক বিপ্লব নিয়ে এসেছে। বর্তমানের প্রযুক্তিসমূহ ক্রমবর্ধমান সংখ্যক ক্ষেত্রসমূহে ইলেকট্রনিকস্ ও কম্পিউটারের ব্যবহার দ্বারা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বস্তুতে চিহ্নিত হয়েছে। কৃত্রিম উপগ্রহের বিপ্লব কারণে ইন্টারনেট ও ইমেইল ব্যবস্থা যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বর্তমানে উৎপাদন ও যোগাযোগের এক সাধারণ উপায় রূপে কম্পিউটার গণ্য হয়।
এত পরিবর্তন, এত গতিশীল অবস্থার মধ্যে এসটিআর যুগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অ্যালিয়েনেশন অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতার শিকার। এমন অবস্থায় উপনীত হয়ে মানুষ যা তার নিজস্বতাকে পরগত করেছে; যা অন্তরঙ্গ তাকে বহির্বিশ্বের বস্তুতে পরিণত করেছে; যা আপন তাকে পর করে দিয়েছে। ব্যাক্তি ও তার জীবন - কর্মচঞ্চলতার মধ্যে ফাটল, ব্যাক্তি ও বস্তু জগতের মধ্যে ফাটল এবং মানুষে ও মানুষে ফাটলের কারণে মানুষ আজ তার কর্ম থেকে, তার নিজের উপাদিত দ্রব্য থেকে ও তার সঙ্গী মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এভাবে নগ্নভাবে, অ্যালিয়েনেটড মানুষ এক বিমূর্ত সত্তায় পরিণত হয়েছে, ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবী নাটকের ‘৭১ট’, ‘৬৯ঙ’, ‘ণয়ের ৬৫’ প্রমুখ শ্রমিকদের মতো।
সৃজনাত্মক জীবন যাপনকেই বলে যথার্থ জীবন বা বেঁচে থাকা। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এসটিআর-এর যুগে অ্যালিয়েনেশনের শিকার হয়ে মানুষ তার সৃজনশক্তি, নিজস্বতা হারিয়ে ফেলেছে। প্রযুক্তির সৌজন্যে আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অপরের সিদ্ধান্তকে তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত বলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষ প্রযুক্তির প্রভু না হয়ে, প্রযুক্তির দাস হয়ে পড়েছে। প্রযুক্তিই মানুষের ওপর প্রভুত্ব স্থাপন করছে। ফলে, মানুষের নিজস্ব চিন্তা, উদ্যম ও ভাবনার অবকাশ কার্যত থাকছে না। নিজস্ব চিন্তা ও সৃজনশীলতার অবকাশ না থাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিশেষ করে শ্রমিকরা অবসাদ ও একঘেয়েমির দ্বারা আক্রান্ত। এমন কি বিশ্রামে থাকা অবস্থাতেও মানুষ প্রযুক্তির আওতায় বাস করছে।
দার্শনিক মার্কসের মতেও অ্যালিয়েনেটেড মানুষ এক অমূর্ত সত্তা, কেননা মানুষ তার সমস্ত নিজস্ব স্বতন্ত্রতার স্পর্শ হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হল অমূর্ত মানুষ, কেননা উৎপাদনের শক্তিসমূহ তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং প্রকৃত জীবনের সমস্ত আধেয় তাদের কাছ থেকে লুন্ঠন করে নেওয়া হয়েছে।
মার্কসের এলিয়েনেশন তত্ত্ব মূলত পাঁচটি মূল বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি।
কাজের এলিয়েনেশন: শ্রমিকরা উৎপাদন প্রক্রিয়ার মালিক নয়, তারা শুধুমাত্র শ্রম বিক্রি করে। তারা নিজেদের কাজের সাথে সম্পর্ক অনুভব করতে পারে না, কারণ তাদের কাজ এক ধরনের যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়, যেখানে তাদের কল্পনা বা সৃজনশীলতা কোন স্থান পায় না।
প্রাকৃতিক উপকরণের এলিয়েনেশন: শ্রমিকরা যে উৎপাদনের উপকরণ সমূহ ব্যবহার করে, সেগুলি তাদের নিজস্ব সৃষ্টি নয়। উৎপাদনের উপকরণ এবং প্রকৃতির প্রতি শ্রমিকদের সম্পর্কও এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে।
অন্য মানুষের সাথে এলিয়েনেশন: শ্রমিকরা তাদের সহকর্মী বা সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না, কারণ তারা সবাই শ্রম বিক্রির প্রক্রিয়ার অংশ। এতে সামাজিক সম্পর্কগুলো শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।
নিজস্ব সত্তার এলিয়েনেশন: শ্রমিকদের নিজেদের জীবন এবং অস্তিত্বের উপর নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। তাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে শুধুমাত্র উৎপাদন এবং অর্থ উপার্জন। নিজেদের মানবিক সত্তা বা সৃজনশীলতাকে তারা বিকশিত করতে পারে না।
প্রকৃতি এবং মানুষের উৎপাদন ক্ষমতার এলিয়েনেশন: শ্রমিকরা প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছে না, কারণ তারা আর সেই প্রকৃতির অংশ নয়; তারা একটি যান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশে পরিণত হয়েছে।
মার্কস মনে করতেন, নিজের থেকে মানুষের বিচ্ছিন্ন হওয়া হল, আসলে চিন্তাকর্তার তার সারবত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অর্থাৎ স্বাভাবিক ও মানবীয় সারবত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। মানুষের চেতনা তখন প্রকৃতি ও মানুষের বাইরে এক নির্দিষ্ট কাঠামোতে বাস করতে থাকে, সমগ্রতা তখন অসংখ্য অংশে খন্ড খন্ড হয়ে যায় এবং খন্ড খন্ড অংশগুলির সাথে সমগ্রতার আন্তর্সম্পর্ক সঠিক ভাবে নির্ধারণ করা যায় না। এটাই হল অ্যালিয়েনেশনের সারমর্ম।
দার্শনিক মার্কসের চিন্তায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই হল অ্যালিয়েনেশনের জন্মদাতা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হল শ্রমিক, মুটেমজুর, কৃষিমজুর ইত্যাদি দরিদ্র শ্রেণী। একমাত্র শ্রমশক্তি ছাড়া অন্য সব বিষয়ে এই দরিদ্র শ্রেণী মালিকানাহীন। তারা উৎপাদনের উপায়ের মালিক নয় বলে উৎপাদনের উপায়ের সাথে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে; তারা তাদের শ্রম দিয়ে যা উৎপাদন করে, সেই উৎপাদিত পণ্য থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। উৎপাদিত পণ্য হয়ে ওঠে শ্রমের অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধ বিষয়। মার্কস বলেছেন, শ্রমিক ধনীদের জন্য আশ্চর্য সব জিনিস উৎপাদন করে, কিন্তু সে নিজের জন্য তৈরি করে বঞ্চনা। শ্রমিক ধনীর জন্য তৈরি করে প্রাসাদ, কিন্তু নিজের জন্য পায় জীর্ণ কুটির। শ্রমিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে, কিন্তু নিজের জীবনের জন্য সে পায় বিষন্ন ক্লিশতা। বিচ্ছিন্নতার এই প্রক্রিয়ায় শ্রমিকদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্দশাগ্রস্ত; তাদের নিজেদের বাহ্যিক জীবন ও অন্তস্থ জগৎ হয়ে ওঠে দরিদ্র; মনের স্বাধীন বিকাশ হয় রুদ্ধ। এই বিচ্ছিন্নতায় তারা নিজেদের স্বাধীনতাকে হারায়। উৎপাদন কর্মের বাইরে তারা নিজেদের স্বাধীন বলে অনুভব করে শুধুমাত্র তাদের জৈবিক ক্রিয়ার মধ্যে অর্থাৎ পানাহার, সন্তান উৎপাদন ক্রিয়া ইত্যাদির মধ্যে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক হল যন্ত্রের দাস, যন্ত্রের লেজুড়; নিজস্বতা বলে তার কিছুই থাকে না। এই ব্যবস্থায় শ্রম বিভাজন থাকায় উৎপাদনের এক একটি আংশিক ক্রিয়ার জন্য এক একজন শ্রমিক সারা জীবন জুড়ে কাজ করে। একই ধরনের কাজ করার ফলে মানুষ স্বয়ংক্রিয় বিশেষীকৃত যন্ত্রে পরিণত হয়। এভাবে পুঁজিবাদে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তার মানবিক সত্তাকে হারিয়ে ফেলে অ্যালিয়েনেশনের শিকার হয়।
অ্যালিয়েনেশন তত্ত্ব আধ্যাত্মিক ধর্মীয় চিন্তায়, ভাববাদী দর্শনেও পাওয়া যায়। আধ্যাত্মিক ধর্মীয় চিন্তায় অ্যালিয়েনেশন তত্ত্বের সারমর্ম হল নিম্নরূপ। সৃষ্টির আদিতে পরমাত্মা বা ঈশ্বর ছাড়া অন্য কিছুই ছিল না। জীবাত্মা পরমাত্মায় বিলীন ছিল, তার পৃথক কোনও অস্তিত্ব ছিল না। ঈশ্বর সৃষ্টি করলেন, জীবাত্মা পরমাত্মা থেকে পৃথক হল, বিচ্ছিন্ন হল। বিচ্ছিন্ন জীবাত্মার সার্থক পরিণাম হল পুনরায় ঈশ্বরের সাথে অর্থাৎ পরমাত্মার সাথে মিলিত হওয়া। পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যাওয়ার জন্য জীবাত্মার আকুতি, তার বিচ্ছেদ বোধ, তার বিরহ বেদনা, তার নিঃসঙ্গতা বোধ, তার তৃষ্ণা। কিন্তু অজ্ঞানতা বশতঃ জীবাত্মা এই সত্য আকুতির বদলে পার্থিব কামনা-বাসনার দ্বারা চালিত হয়ে নানা ধরনের দুঃখকষ্ট ভোগ করে, অসুস্থ অস্থিরতায় জর্জরিত হয়। প্রকৃত জ্ঞানের উদয় হলে পার্থিব যাবতীয় মায়ামোহ বিনাশ হয়ে ঈশ্বরের সাথে মিলনের জন্য উপযুক্ত সাধনায় মানুষ রত হয়।
অ্যালিয়েনেশন সম্বন্ধে ধর্মীয় চিন্তার এই রকম কাঠামো দেখা যায় ভারতীয় আধ্যাত্মবাদী দর্শনগুলিতে। যেমন, বেদান্ত দর্শনের একটি বিভাগ অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে বলা হয়েছে, ব্রহ্ম অর্থাৎ পরমচৈতন্য বা বিশুদ্ধ চেতনাই হল একমাত্র সত্য। জগৎ মিথ্যা, মায়ার প্রকাশ। ব্রহ্মাত্মা ও জীবাত্মা হল এক ও অভিন্ন। তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হলে এই অভিন্নতা বোধ জন্মে। জীবাত্মা ব্রহ্মাত্মায় বিলীন হয়ে যাবতীয় দুঃখকষ্ট, বিচ্ছেদ থেকে মুক্তি পায় অর্থাৎ জীবাত্মা মোক্ষ লাভ করে।
বেদান্ত দর্শনের মতো প্রতিটি ভারতীয় আধ্যাত্মবাদী তথা ভাববাদী দর্শন চেতনাকে জড়বস্তু থেকে পৃথক সত্তা বলে স্বীকার করে, জড়ের ঊর্ধ্বে চেতনাকে স্থান দিয়ে অ্যালিয়েনেশন তত্ত্ব প্রচার করে জগতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যাবতীয় বিচ্ছেদ ও দুঃখকষ্টের কারণের ব্যাখ্যা দেন। সমস্ত ভারতীয় আধ্যাত্মবাদী দর্শন স্বীকার করে যে পরমচেতনায় বিলীন হয়ে যাওয়া বা চেতনা যে জড় থেকে ভিন্ন সত্তা, এই বোধ হওয়া ও জীবাত্মার চৈতন্যের জগতে, তার প্রকৃত স্বরূপে ফিরে যাওয়াই হল জীবাত্মা তথা মানুষের মুক্তি ও অ্যালিয়েনেশনের বিনাশ। ভারতীয় আধ্যাত্মবাদী দর্শনগুলিতে অ্যালিয়েনেশন থেকে মুক্তির পথ হল জীবাত্মার মোক্ষ লাভের সাধনা, জীবাত্মার স্বরূপে ফিরে যাবার সাধনা এবং তার জন্য রয়েছে যোগাভ্যাস, যাগযজ্ঞ, জ্ঞানমার্গ, ভক্তি মার্গ, কর্মযোগ, রাজযোগ, অষ্টাঙ্গিক মার্গ ইত্যাদি নানা পন্থা।
প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হেগেল প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিকগণও ভাববাদী অ্যালিয়েনেশন তত্ত্ব প্রচার করেন। যেমন, দার্শনিক হেগেলের মতে প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মধ্যে রয়েছে দ্বন্দ্ব। গতিশীল বস্তুগুলো দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হতে হতে শেষ পর্যন্ত প্রকৃত সত্য অর্থাৎ পরমব্রহ্ম বা পরমচেতনায় পরিণত হয়। কাব্য-সাহিত্য-সংগীতের মধ্যেও ভাববাদী অ্যালিয়েনেশন তত্ত্বের প্রকাশ ঘটে।
কার্ল মার্কস হলেন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দার্শনিক। মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে অ্যালিয়েনেশনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অস্তিত্বের কারণকে বাস্তব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফল বলে উল্লেখ করেন। অ্যালিয়েনেশন থেকে মানব মুক্তির জন্য, প্রকৃত স্বাধীন মানবীয় সত্তা বিকাশের জন্য মার্কস পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটিয়ে কমিউনিজম অর্থাৎ সাম্যবাদ পত্তনের কথা সামনে এনেছিলেন।
মার্কস বর্তমান সময়ের অ্যালিয়েনেশনকে কমিউনিজম অর্থাৎ সাম্যবাদের মানদন্ডের আরোপ করেছেন। দার্শনিক মার্কসের মতে অ্যালিয়েনেশন হল যথার্থ মানবীয় অস্তিত্ব থেকে বহির্গমন বা বিচ্ছিন্নতা। যথার্থ মানবীয় সত্তার বাস্তবায়ন হবে ভবিষ্যৎ প্রকৃত কমিউনিস্ট অর্থাৎ সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার ছত্রছায়ায়; অপরদিকে সমস্ত ধরনের প্রাক্ সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা, বিশেষ করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত উন্নয়নের সম্ভাবনাসমূহের পরিপূরণ এবং তার সীমা অতিক্রম করার সাথে কমিউনিজম সমার্থক।
মার্কসের মতে প্রকৃত মানব জীবন হল সেই জীবন, যেখানে একজন মানুষ তার সামর্থ্যের সমগ্র ব্যাপ্তিসীমাকে ব্যবহার করতে পারবে। কমিউনিস্ট অর্থাৎ সাম্যবাদী ব্যবস্থায় এটির বাস্তবায়ন সম্ভব, কেননা কমিউনিস্ট সমাজে উৎপাদন হয়ে উঠবে সাধারণের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই, কমিউনিস্ট সমাজে ব্যক্তির কর্ম কেবল একটি নির্দিষ্ট সীমায় বা ক্ষেত্রে আবদ্ধ থাকবে না। সেখানে একজন ব্যক্তি তার পছন্দ অনুযায়ী যে কোনো শাখায় পারদর্শী হয়ে উঠতে পারবে। এক্ষেত্রে কোন একজন ব্যক্তির পক্ষে আজ একটা আর আগামীকাল অন্য আর একটা কিছু করা সম্ভব হবে। একজন মানুষ সকালে শিকার করা, বিকেলে মাছ ধরা, সন্ধ্যায় পশুপালন ও ডিনারের পর সমালোচক হিসেবে সমালোচনা করতে পারবে। একজন ব্যক্তি যদি মনস্থির করে তবে আদৌ শিকারী, মেছুয়া, মেষপালক বা সমালোচক না হয়েও নিজের ইচ্ছে মতো এসব কিছু করা সেই ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হবে। সাধারণ ভাবে বলা যায় যে সাম্যবাদী সমাজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুমুখী প্রতিভার মতো প্রত্যেকেই তার অন্তর্নিহিত সামর্থ্যের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটাতে পারবে, কেননা বহুমুখী প্রতিভার স্ফুরণের জন্য সে মানবিক পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করবে।
মার্কস মনে করেন, মানুষ যদি তার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে মানবিকতা অর্জনের জন্য পরিবেশকে করে তুলতে হবে মানবিক। মানবিক পরিবেশ তৈরি করতে প্রতিষ্ঠা করতে হবে সাম্যবাদ। মার্কস ইতিহাসকে মানব মুক্তির গতিশীল প্রক্রিয়া বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে ইতিহাসের পথ ধরেই পুঁজিবাদের গর্ভ থেকে সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা হবে। তবে প্রকৃত সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার পূর্বে পুঁজিবাদী অমানবিক বাস্তব পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রথম যে মানবিক পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠিত হবে, তা হল সমাজতন্ত্র অর্থাৎ প্রলেতারিয়েত মানে সর্বহারা শ্রেণীর রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
Comments :0