MURSHIDABAD VOTE

উধাও বিজেপি, রক্তপাতহীন মুর্শিদাবাদ

রাজ্য

 

চন্দন দাস ও অনির্বাণ দে: ডোমকল
  ভোট দিতে গেছিলেন প্রৌঢ়া। বুথ তাঁর গোপীনাথপুর শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে। বছর ষাটের সেই মহিলাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল তৃণমূলীরা। পুলিশ কাছেই ছিল। তাদের মহিলা জানিয়েছিলেন অভিযোগ। জবাব কী মিলেছিল? মহিলার কথায় গণতন্ত্রের মৃত্যু পরোয়ানার বয়ান,‘‘পুলিশ বলল লিখিত অভিযোগ জানাও আগে। তারপর ভোট দেবে।’’
নিজের ভোট নিজে দিতে না পারার জন্য পুলিশকে লিখিত অভিযোগ দিতে হবে? আর বুথ ঘিরে দাপট দেখাবে লুটেরারা? কিন্তু অসহায় মহিলার প্রবল স্পৃহা ছিল ভোট দেওয়ার। তিনি ঘরে ফেরেননি। গত কয়েকটি ভোটে তাঁর ভোট তৃণমূলীরা দিয়েছে। এবার ভোট দিতে চান—  তাই দাঁড়িয়ে ছিলেন দূরে। যদি কোনও সুযোগ মেলে এই আশায়। পৌনে নটা নাগাদ পরিস্থিতি বদলে গেল। মহিলা ভোট দেওয়ার জন্য সেই পুলিশ আর তৃণমূলীদের সামনে দিয়েই এগিয়ে গেলেন বুথের দিকে। 
পরিস্থিতির এই গুণগত পরিবর্তন কী করে হলো?
উত্তর—  হিটলারই প্রথম পিছু হটলো। মঙ্গলবারের মুর্শিদাবাদে সকালেই প্রতিরোধের কদম এগিয়ে দিল গোপীনাথপুর। 
তাঁদের যে প্রার্থীকে ‘বাজপাখি’ বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি মঞ্চ থেকে, সেই মহম্মদ সেলিমের উপস্থিতিতে মুর্শিদাবাদের মাটিতে তৃণমূলের ভোট লুটেরাদের মঙ্গলবার প্রতিহত করেছেন সাহসী মানুষ। 
হিটলারের মনে, শরীরে গুসসা এদিন আসা তাই স্বাভাবিক ছিল।
লোকটির নামই হিটলার। হিটলার সরকার। গোপীনাথপুর এলাকার তৃণমূল নেতা এবং অবধারিতভাবে ‘মাস্তান।’ স্থানীয় গ্রামবাসীদের তেমনই তাঁর সম্পর্কে বিশেষণ। রানিনগরের গোপীনাথপুরে শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের বুথ থেকে সিপিআই(এম)’র পোলিং এজেন্ট মোস্তাকিন সেখকে সকাল ৮টা নাগাদ হিটলারের নির্দেশে ভয় দেখিয়ে তুলে দেয় তৃণমূলীরা। বদলে নিজেদের একজনকে বুথে ঢুকিয়ে দেয়। কাছাকাছি পাহারা দিচ্ছিলেন ওসি নির্মল দাস এবং অন্যান্য পুলিশকর্মীরা। বুথের দরজায় দাঁড়ানো ছাড়া আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের আর কিছু করতে দিচ্ছিল না পুলিশ। বুথের ২০০ মিটারের মধ্যে প্লাস্টিক বিছিয়ে তৃণমূলীরা পাহারা দিচ্ছেল, যাতে সিপিআই(এম)’র সমর্থক কিংবা ‘সন্দেহভাজন’ ভোটদাতারা কেউ বুথের ধারেকাছে পৌঁছাতে না পারে। 
ঠিকই চলছিল তৃণমূলের। প্ল্যান ভেস্তে গেল পৌনে ৯টা নাগাদ। মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী মহম্মদ সেলিম পৌঁছে গেলেন ভোট কেন্দ্রে। বুথে ঢুকেই তিনি পার্টির এজেন্টের খোঁজ করলেন। দেখা গেল এজেন্ট নেই। বদলে বসে আছে সোহেল শেখ—  তৃণমূল কর্মী। সেলিম তার সামনে দাঁড়িয়ে পরিচয় জিজ্ঞাসা করা মাত্র সে পালানোর চেষ্টা করে। আধা সামরিক বাহিনীর সহায়তায় টেনে বের করা হয় সেই ‘ভুয়ো’ এজেন্টকে। সোহেল শেখকে পুলিশের হাতে তাকে তুলে দেওয়া হয়। এখানে দ্বিতীয় একটি বুথেও তৃণমূলের ভুয়ো এজেন্ট ছিল। সে পরিস্থিতি বুঝে আগেই চম্পট দেয়। ইতিমধ্যে ছাপ্পা ভোট আটকে যাচ্ছে বুঝে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে তৃণমূলীরা। আক্কাস মণ্ডল, রাজ্জাকের মতো স্থানীয় তৃণমূলী নেতারা কর্মীদের জড়ো করার চেষ্টা করলেন। ততক্ষণে মহম্মদ সেলিম আশপাশের গ্রামবাসীদের বুথে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছেন। এগিয়ে গেছেন তৃণমূলীদের জমায়েতের দিকে। সেলিমকে এগিয়ে আসতে দেখে তৃণমূলীরা সরে পড়তে থাকে। কিন্তু তাদের সে সুযোগ দেননি সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক। পুলিশকে ডেকে দেখাতে থাকেন বুথের ২০০মিটারের মধ্যে বসে থাকা সেই তৃণমূলীদের। ভোট দিতে গিয়ে তৃণমূলীদের বাধায় ফিরে আসা গ্রামবাসীরা এগিয়ে আসেন। তাঁরা অভিযোগ জানাতে থাকেন। এক মহিলা প্রথম বলেন,‘‘আমি ভোট দিতে গেছিলাম। আমাকে বলে ভোট দিতে হবে না। বাড়ি যাও।’’ সমস্বরে আরও অনেকেই তা বলতে থাকেন। ওসি নির্মল দাস সেলিমের সঙ্গে তর্ক করে তৃণমূলকে ‘খেলা’য় ফেরত আনার চেষ্টা করেন। সেলিম গ্রামবাসীদের বলে ওঠেন,‘‘ভোট দিতে যান। আমি আছি। যাকে ইচ্ছা ভোট দিন। কিন্তু ভোট দিয়ে আসুন।’’ গ্রামবাসীদের অনেকেই ভোট দিতে এগোন। 
অবস্থা বেগতিক বুঝে তৃণমূলের সাত-আট জন ‘গো ব্যাক সেলিম’ বলে চিৎকার শুরু করেন। তারা সিপিআই(এম)’র প্রার্থীকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। এই বাহিনীর পান্ডা সেই হিটলার সরকার। সে বাধা দিতে গেলে সেলিম তাকে সরিয়ে দেন। পিছিয়ে যায় তৃণমূলের বাহিনী।  
এমনই ঘটনা ঘটে কেশবপুর নওদাপাড়ায়। সিপিআই(এম) প্রার্থীর দাপট আর পুলিশ বালির বাঁধের মতো নাস্তানাবুদ হচ্ছে—  এই খবর ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে অনেকদূর। নওদাপাড়ার বুথের সামনে তৃণমূলের চার পাঁচজন সিপিআই(এম) প্রার্থীকে বুথে ঢুকতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। মুখে সেই ‘গো ব্যাক।’ তাদের পান্ডা ছিল সাকিরুল ইসলাম। এই বুথে গ্রামবাসীদের ভোট দিতে দিচ্ছিল না তৃণমূলীরা। মহম্মদ সেলিম পৌঁছানোয় ভোট দিতে না পারা গ্রামবাসীরা অভিযোগ জানাতে থাকেন। তখন সাকিরুলের নেতৃত্বে তৃণমূলীরা মহম্মদ সেলিমকে ধাক্কা দিতে এলে ধস্তাধস্তিতে পিছু হটে। কেশবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে ঢুকে আর এক ভুয়ো এজেন্ট আজিজুলকে বের করে আনেন মহম্মদ সেলিম। তিনি বিপাকে পড়ে বলতে থাকেন,‘‘আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি এখনই চলে যাচ্ছি।’’ সেলিম বলেন,‘‘আপনাকে ক্ষমা করে দেওয়ার আমি কেউ নই। পুলিশ যা করার করবে।’’
করিমপুরের নতিডাঙায় স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার বাড়ির পাশে শুভরাজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বুথ হয়েছিল। সেখানে দূরে দাঁড়ানো গ্রামবাসীরা এগিয়ে এসে বলেন,‘‘আমরা অনেকদিন ভোট দিতে পারিনি। ভোট দিতে চাই। যেতে দিচ্ছে না।’’ মহম্মদ সেলিম সেখানে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। গ্রামবাসীরা ভোট দিতে যান। করিমপুরের দোগাছীতে ডাব্বিপাড়া, মণ্ডলপাড়ার বুথের সামনে জাহাঙ্গীর মণ্ডল বলেন, ‘‘পঞ্চায়েতেও কেরালা থেকে এসেছিলাম শুধু ভোট দিতে। এবারও এসেছি। এবার ভোট দেবোই ঠিক করেছিলাম। ভোট দিয়েছি। এমন কথা এদিন আরও অনেকের মুখেই শোনা গেছে। 
কিন্তু এত কাণ্ডের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দল কোথায়? এদিন মুর্শিদাবাদ আর করিমপুর ছাড়া মুর্শিদাবাদ লোকসভার বিস্তীর্ণ এলাকায় বিজেপি’র কোনও চিহ্ন ছিল না।
মঙ্গলবারের মুর্শিদাবাদ একটি কথা স্পষ্ট জানিয়েছে। মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য মরিয়া ছিলেন। দিনের শেষে মহম্মদ সেলিম এই প্রসঙ্গে বলেছেন,‘‘মানুষ ভরসা পেয়েছিলেন। জেদের বশে তারা ভোট দিয়েছেন।’’ মানুষের এই জেদের জোরেই সিপিআই(এম) সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা স্ট্রং রুম পাহারা দেবে। 
এছাড়া মঙ্গলবারের রানিনগর, করিমপুর, ডোমকল, হরিহরপাড়া কী আর কিছু জানালো? উত্তর আছে এক এসইউসি কর্মীর মুখে। ডোমকলের মোমিনপুরে মহম্মদ সেলিম যখন বুথে ঢুকেছেন, কিছুটা দূরে গাব গাছের নিচে আরও অনেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন আনারুল হক। করিমপুর কলেজে পড়ার দিন থেকে এসইউসি কর্মী। প্রবল সিপিআই(এম) বিরোধী বছর পঞ্চাশের আনারুল গ্রামের মসজিদের স্থাপত্য বোঝাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পরে ভোটের কথায় ঢুকে বললেন,‘‘আমি সিপিএম’র বিরোধী। এবারও ওদের ভোট দিইনি। কিন্তু মানুষের ভোট সিপিএম’র দিকে চলে গেছে অনেকটা। তৃণমূলের প্রতি ঘৃণায় আর বিজেপি’কে ভোট দেওয়ার কথা এই তল্লাটে কেউ কল্পনা করে না বলেই তারা সিপিএম’র দিকে চলে গেছে। এবারের ভোটে মিরাকল ঘটতে পারে।’’
৪ জুন তার উত্তর মিলবে। তবে মঙ্গলবারের মুর্শিদাবাদ রক্তপাতহীন। সকালে ডোমকলে কংগ্রেস কর্মীর বাড়িতে তৃণমূলে বোমা ছোঁড়া ছাড়া কোনও মাঝারি ঘটনাও নেই এদিনের ডোমকল, রানিনগর, ইসলামপুর, হরিহরপাড়ায়। 
ঘটনা বলতে একটিই—  ভুয়ো বুথ এজেন্ট তৃণমূলের। মহম্মদ সেলিমের কথায়,‘‘প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর ভুয়ো ডিগ্রির পর ভুয়ো এজেন্ট। নকল ফরম ব্যবহার করে ভুয়ো এজেন্ট দিয়েছিল তৃণমূল। আর কী আশ্চর্য তাদের দাবি। ভুয়ো এজেন্ট বুথে থাকতে পারবে, কিন্তু প্রার্থী বুথে ঢুকতে পারবে না!’’
 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment