শুভ্রজ্যোতি মজুমদার
হুগলী নদী ক্রমশ হারাচ্ছে তার লোভনীয় জিভে জল আনা রুপোলি সম্পদ। একে একে বেলে রিটে আড় ট্যাংরার মতো সুস্বাদু মাছ ও কমছে বলছেন মৎসজীবীরা। নোনা জলের ইলিশ ডিম পাড়তে নদীর উজান ঠেলে আসে মিষ্টি জলে। ডিম ছেড়ে আবার ভাটিতে গা ভাসিয়ে ধরে সাগরের পথ। এর জন্য প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত জলপ্রবাহের। তবে নাব্য সংকট, চর ও বাঁধ-সেতুসহ নানা অবকাঠামোর প্রভাবে নদীতে এসে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে ইলিশ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নদী দূষণ এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের অভিঘাতে উষ্ণায়ন ও কম বৃষ্টিপাত। সারা বছর নদীতে বিচরণ থাকলেও সাধারণত মৎসজীবীদের জালে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে জুলাই থেকে। তবে চলতি বছর এখনো তেমন ইলিশের দেখা মিলছে না। ঝির ঝিরে বৃষ্টি হলেই আগে বৈদ্যবাটির রাজবংশীপাড়া, শ্রীরামপুর ধুবিঘাট, চন্দননগর থেকে বলাগড়ের হুগলি নদী পাড়ের মৎসজীবীরা মাছ ধরতে বেরোতেন। শ্রাবণ মাসে একে একে জালে ধরা পড়তো রুপোলি জলের শস্য ইলিশ। মৎসজীবীরা আশায় থাকতেন একটা দুটো মাছ পাবার। কারণ এখন গঙ্গার ইলিশের বাজার দর ওই কেজি প্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকার মতো। কিন্তু বছর পাঁচেক উত্তরপাড়া থেকে বলাগড় গঙ্গার স্রোতে ইলিশ সহ বিভিন্ন মাছের সংখ্যা বর্ষাকালে হু হু করে কমছে।
মৎসজীবী তরুণ মন্ডল, তপন মন্ডল জানান গঙ্গায় মাছ মিলবে কিকরে প্লাস্টিক পচা ফুল সবাই গঙ্গায় ফেলে। কারখানার আবর্জনা থেকে নর্দমার কালো পচা জল পড়ছে। তারপর ইলিশের বাচ্চা ও মীন ধরা পড়ায় ক্রমশ ইলিশ কমছে। আগে সিফরি ও মৎস বিভাগ থেকে কথা বলতে ডাকতো আমাদের এখন আর ডাকে না। গঙ্গায় বছর পাঁচেক ধরে মাছ কমছে এরকম চলতে থাকলে আমাদের পেশাটা আর থাকবে না। এমনিতেও ছেলে পিলেরা এখন ভেড়ি তে মাছ ধরার কাজে যাচ্ছে বেশি। গঙ্গায় মাছ ধরার কাজে কেউ যেতে চাইছে না।
শেওড়াফুলি হাটের মৎস বিক্রেতা নেপাল দাস বলেন, ‘‘এখন ৫০০-৬০০ গ্রামের টাটকা ইলিশের দাম প্রায় হাজার টাকা। ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের মাছ ১২০০ টাকা। এক কিলোর মাছের দাম দেড় হাজার ছুঁয়েছে। কোল্ড স্টোরেজের মাছ এক কিলো সাইজ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গঙ্গায় মাছ নেই। আড়, রিটে, বেলে সহ যেসব মাছ পাওয়া যেত এখন আর বাজারে সেসব মাছের দেখা মিলছে না। আগে তো আসেপাশের মৎসজীবীরা হাটে মাছ আড়তে বিক্রি করতে আসতেন। এখন মাছের আকালের জন্য তাঁরা আর আসছেন না।
পরিবেশবিদ তপন সাহা জানান, ‘‘সমুদ্রের যেমন ৩০০০ মিটার পর্যন্ত জলের তাপমাত্রা বেড়েছে তেমনি নদীর জলের তাপমাত্রা বেড়েছে। এই বর্ধিত তাপমাত্রার জন্য হুগলি নদীর বিভিন্ন এলাকা মৎসহীন হয়ে পড়ছে। আসলে মাছ পরিযান করে যেখানে তাপমাত্রা তাদের পক্ষে স্বাভাবিক বলে মনে হয় সেখানে তারা চলে যায়। হরিদ্বারে দেখুন আগে এমনি মাছ পাওয়া যেতোনা এখন যাচ্ছে। মাছেদের সেখানকার জলের তাপমাত্রা সহনীয় মনে হচ্ছে তাই তারা সেখানে চলে যাচ্ছে। এই সবটাই হচ্ছে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বাড়ার কারণে। শুধু তাই কেন মাছের ডিম পাড়ার সময় বদলে গেছে। যে মাছ ধরো আগে মার্চ মাসের কাছে ডিম পাড়তো আজ সেটা করছে জুন জুলাই মাসে। এভাবেই সবকিছু হচ্ছে আর কি।’’
মৎস গবেষকরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে অর্থাৎ জুলাই থেকে অক্টোবরে নদীর নিম্নাঞ্চলের জল স্বচ্ছ হয়ে ওঠে এবং লবণাক্ততা থাকে না। আবার প্রবল স্রোত এবং জোয়ার-ভাটার কারণে ইলিশ সমুদ্র থেকে নদীতে আসতে শুরু করে। পাশাপাশি ইলিশের ডিম ছাড়ার সময় প্রচুর অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। যেহেতু বর্ষায় নদীর জল জোয়ার-ভাটার কারণে অশান্ত হয়ে ওঠে ফলে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে যায়। বিকাল থেকে সন্ধ্যা ইলিশের ডিম ছাড়ার উপযুক্ত সময়। এরপর নভেম্বর থেকে জাটকা পরিপক্ব হতে শুরু করে এবং জুন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। তাছাড়া মাছের বংশবিস্তারে জলের তাপমাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এর ওপর নির্ভর করে মাছের ডিম ছাড়ার সময়। সামান্য তারতম্য হলেই মা-ইলিশ তার ডিম নষ্ট করে ফেলে। সাম্প্রতিক সময়ে অনাবৃষ্টি ও নদীর গতিপথ পরিবর্তনে জল কমেছে, বেড়েছে তাপমাত্রা। তাই নদীতে কমেছে ইলিশের বিচরণ।
Hilsa
হুগলী নদীতে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ, হতাশ মৎসজীবীরা
×
Comments :0