Debt economy

‘গুপ্ত’ ঋণের বোঝায় ভারতের অর্থনীতি নড়বড়ে, উদ্বেগ আইএমএফ’র রিপোর্টে

জাতীয়

মুখে ভারতকে ৫ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দেশে পরিণত করার কথা যত গলা ফুলিয়েই বলুন না কেন মোদী-শাহ থেকে শুরু করে বিজেপি নেতারা, এক অতি জটিল অবস্থার মধ্যে রয়েছে ভারতীয় অর্থনীতি। চাহিদায় মন্দা, শিল্পোৎপাদনে বদ্ধদশা, নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, টাকার দামের নজিরবিহীন পতন, স্থায়ী চাকরির অভাব, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বাড়বাড়ন্তে আয়ের নিরাপত্তাহীনতা— এসব তো আছেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গুপ্ত ঋণ, যা নিয়ে আলোচনা হয় খুবই কম। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা চালিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ)। তাতে উঠে এসেছে, গোটা বিশ্বেই বড় সমস্যা হয়ে উঠছে গুপ্ত ঋণ। সব দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সামনেই তা বিপদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, বিশেষত ভারত সহ নিম্ন ও মাঝারি আয়ের দেশগুলির সামনে।
আইএমএফ’র গবেষণার রিপোর্ট জানিয়েছে, এই গুপ্ত ঋণ মানে বাজেট-বহির্ভূত ঋণ, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির অঘোষিত আপৎকালীন দায় এবং স্মার্ট সিটির মতো বিশেষ প্রকল্পের জন্য গঠিত তহবিল। ভারতে গুপ্ত ঋণ ইতিমধ্যেই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে, দ্রুত যার দিকে নজর দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সরকারের। এখনই ভারতের সরকারি ঋণের পরিমাণ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) বা জিডিপি’র  ৮৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। এই ঋণ ইতিমধ্যেই সরকারি কোষাগারের উপর ব্যাপক চাপ তৈরি করেছে। এর সঙ্গে বিরাট পরিমাণ গুপ্ত ঋণকে যোগ করা হলে বাস্তবের খুবই খারাপ চিত্র সামনে চলে আসবে। কারণ, এই গুপ্ত ঋণের চেহারাকে আড়াল করে রাখা গেলেও এর আর্থিক দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। 
আইএমএফ’র রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কোষাগারীয় স্বচ্ছতার সূচকে দেশগুলির ক্রমতালিকায় ভারতের যে অবনমন ঘটেছে, তা বাস্তবের আর্থিক সঙ্কটের গভীরতাকেই তুলে ধরেছে। সরকার এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ। ২০১৪ সাল থেকেই এই সূচকে ভারতের অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণভাবে নিচে নেমেছে। এই অবনমনে শুধু দেশ পরিচালনা নিয়েই প্রশ্ন ওঠেনি, বিনিয়োগকারীদের আস্থাও কমেছে। এই গুপ্ত ঋণ নেওয়ার প্রবণতায় আপস করা হচ্ছে কোষাগারীয় শৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে। রাজ্য সরকারগুলির দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, তারা অনেকেই বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল অর্থ খরচ করছে ঋণ নিয়ে। কিন্তু তারা এই ঋণ শোধ করতে পারছে না ঠিক মতো। আসলে গুপ্ত ঋণ ভিতর থেকে রাজ্যগুলির অর্থনীতিকে এতটা ভঙ্গুর করে রেখেছে যে, এই কাজ তারা করে উঠতে পারছে না। ঋণের উপরে ঋণ নেওয়া হচ্ছে আগের ঋণ কিছুটা শোধ করার জন্য আর বাকিটা ক্রমপুঞ্জিত ঋণের চেহারাকে স্ফীত করে তুলছে।
তথ্য বলছে, পাঞ্জাব ও রাজস্থান এই ঋণ নিয়ে কল্যাণমুখী প্রকল্প ও বিদ্যুতে ভরতুকি বাবদ অর্থ খরচের প্রবণতা বাড়িয়ে চলেছে। তাতে স্বল্পমেয়াদে কিছু আর্থিক স্বস্তি মিললেও রাজ্য তথা দেশের ঘাড়ে আর্থিক বোঝার ভার বেড়ে যাচ্ছে। ঋণ তো একসময়ে শোধ করতেই হবে। ঋণ শোধ না করলে ফেলে রাখলে সুদ বাড়তে থাকবে, তাতে ভবিষ্যতে ঋণ শোধ করার কাজ আরও জটিল আকার নেবে। তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্র প্রদেশেও এই গুপ্ত ঋণের পরিমাণ বিরাট। তেলেঙ্গানায় বাজেট-বহির্ভূত আর্থিক দায়বদ্ধতার পরিমাণ কমবেশি এক লক্ষ কোটি টাকা, যা রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ১০ শতাংশ। আবার অন্ধ্র প্রদেশে বা‍‌জেট-বহির্ভূত আর্থিক দায়বদ্ধতার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে কমবেশি ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ঠিকই যে, এর বেশিরভাগটাই ঋণ নেওয়া হয়েছে রাজ্যের উন্নয়নমূলক ও ভরতুকির প্রকল্পের জন্য। অনগ্রসর অংশের জন্য এমন প্রকল্পের অবশ্যই দরকার আছে। কিন্তু তার জন্য রাজ্যগুলির এই যে বাজেট-বহির্ভূত ঋণ নেওয়ার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, তা আশু প্রয়োজন মেটালেও দীর্ঘমেয়াদে রাজ্যগুলির উপরে ব্যাপক আর্থিক বোঝা তৈরি করবে। 
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, এখনই ভারতে ঋণের সুদ পরি‍‌শোধ করতেই সরকারের মোট রাজস্ব সংগ্রহের ৪২ শতাংশ চলে যায়। তার জেরে বাজেট বরাদ্দ কমছে পরিকাঠামো নির্মাণে, শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, একশো দিনের কাজের মতো কর্মসংস্থানের সু‍যোগ সৃষ্টির প্রকল্পে। গত দশ বছরে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ ছাঁটাই করে স্মার্ট সিটি, মডেল স্টেশনের মতো কিছু গালভরা প্রকল্প ঘোষণা করে সেগুলি রূপায়নের জন্য গুপ্ত ঋণের উপর সরকারের নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। দরকার সামাজিক ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো। তার জন্য বেশি জোর দিতে হবে রাজস্ব সংগ্রহে, বিশেষত আয়কর ও কোম্পানি কর বাবদ রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর উপরে। আসন্ন বাজেটে তেমন উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন। অতি-ধনীদের উপর আয়করের হার বাড়ানো দরকার। দেশে যেসব মিলিওনেয়ার আর বিলিওনেয়ারের উৎপত্তি হয়েছে, তাঁদের আর্থিক রমরমা তো নিজেদের মালিকানাধীন অজস্র কোম্পানির বিপুল মুনাফা থেকেই। গত কয়েক বছর ধরে বাজেটে নানা কায়দায় কোম্পানি করে ছাড় দেওয়া হলেও এই ধনকুবের শিল্পপতিরা তেমন বিনিয়োগ বাড়ানোর পথে হাঁটেননি। উলটে তাঁদের মুনাফাই বেড়েছে। তাই কোম্পানি করে ছাড় না দিয়ে তার হার বাড়ানো দরকার। রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো গেলে শুধু সামাজিক ও উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোই সম্ভব হবে না, কমানো যাবে বাজেট-বহির্ভূত ঋণ অর্থাৎ গুপ্ত ঋণ নেওয়ার প্রবণতাকেও। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও চাকরিতে নিয়োগের রাস্তা দেখাতে হবে বাজেটে। রোজগার মানুষের হাতে অর্থ দেবে, বিকাশ ঘটাবে ক্রয়ক্ষমতার, তৈরি করবে বাজারে চাহিদা। তখন বর্ধিত চাহিদা মেটাতে বাড়াতে হবে উৎপাদন, তার জন্য বাড়বে বিনিয়োগ। তা আবার চাকরি সহ কর্মসংস্থানের নতুন রাস্তা খুলে দেবে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, আরও অনেক দেশের মতোই ভারতের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো, অর্থনৈতিক স্তরে উপরের দিকে থাকা ধনী ও অতি-ধনীদের হাতে সম্পদের পুঞ্জিভবন। গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষের আয় বদ্ধদশায় পড়ে রইল আর এই ধনী ও অতি-ধনীদের আয় আরও ফুলে-‍ফেঁপে উঠল, তাতে ভারত ৫‍‌ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে পারে, কিন্তু আয় ও সম্পদের অসম বণ্টনের তীব্রতায় গরিব ও নিম্নবিত্তরা শেষ পর্যন্ত ভরতুকি-নির্ভর জীবনের চক্রে আটকা পড়ে থাকবেন। আর সেই ভরতুকি চালিয়ে যেতে আবার সরকারকে ওই গুপ্ত ঋণের দ্বারস্থ হয়েই থাকতে হবে।

 

 

Comments :0

Login to leave a comment