GEETA PRESS

'গীতা প্রেস'- উগ্র হিন্দুত্ব এবং মোদি-মমতা (১)

জাতীয় বিশেষ বিভাগ

GEETA PRESS

গৌতম রায়

জয়দয়াল গোয়েঙ্কা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলা কেন্দ্রিক একজন মারোয়ারি ব্যবসায়ী। তুলো, কেরোসিন তেল, নানা ধরনের কাপড় চোপড়, আর বাসনপত্রের ব্যবসা ছিল তাঁর। কেবল যে বাঁকুড়া জেলাকে কেন্দ্র করে তাঁর ব্যবসা চলত তা নয়, পাশাপাশি চক্রধরপুর,  আজকে যেটি ঝাড়খন্ড রাজ্যে অবস্থিত এবং বিহারের সীতামারি জেলাতেও ব্যবসা বিস্তৃত ছিল। ব্যবসার কাজে কলকাতা এবং খড়গপুর তাঁকে নিয়মিত যাতায়াত করতে হত।

সততার জন্য জয়দয়ালের যথেষ্ট পরিচিতি ছিল বলে জানা যায়। সেই সময়ে জিনিসপত্র তিনি খুব সঠিক দামে বিক্রি করতেন। সঠিক ওজন দিতেন। ব্যবসা পত্রের কাজ শেষ করে তিনি খরিদ্দার এবং পরিচিতদের মধ্যে ধর্মগ্রন্থ ‘গীতা’ নিয়ে আলোচনা করতেন। পরস্পরকে ‘গীতা’ উপহার দিতেন।

এভাবে বেশ কিছুকাল চলার পর তিনি মূলত ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটা ছোট্ট গোষ্ঠী তৈরি করলেন। যে গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল, ধর্ম কেন্দ্রিক নানা ধরনের সৎ প্রসঙ্গ সেখানে আলোচিত হবে। এই গোষ্ঠীটি কলকাতায় বিভিন্ন ধরনের ধর্মসভার আয়োজন করে। জয়দয়ালের বাড়িতে বড় রকমের জমায়েত হয়। তারপর ইডেন গার্ডেনসের সামনে এই গীতা অনুধ্যায়ী গোষ্ঠীর একটা বড় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

১৯২২-এ কলকাতার বাঁশতলা স্ট্রিটের 'গোবিন্দ ভবন' নামে একটি বাড়িতে, এই সংগঠনটি মোটামুটি স্থায়ীভাবে নিজেদের কর্মকাণ্ড শুরু করে। এই ‘গোবিন্দ ভবন’ ক্রমেই জয়দয়ালের কলকাতার নতুন বাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী জয়দয়াল ক্রমে ব্যবসা সম্বন্ধে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং গীতা বিতরণ, গীতাকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের আলাপ আলোচনা তাঁর পরিবর্তিত জীবনের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় ।

 এই গোবিন্দভবন থেকে বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দু দফায় প্রায় ১১ হাজারের অধিক গীতা ছাপা হয়। এই ছাপার প্রক্রিয়াটি চলেছিল কলকাতারই বণিক প্রেস থেকে। বিপুল সংখ্যায় বই এরা বিতরণ করবার পর ঠিক করেন, নিজেরাই একটি প্রকাশনা সংস্থা খুলবেন।

জয়দয়ালের বিশিষ্ট বন্ধু এবং দূর সম্পর্কে আত্মীয় ঘনশ্যাম দাস জালান, যিনি উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুরের বাসিন্দা। তিনি জয়দয়ালকে তাঁর গোরখপুর প্রকাশনা সংস্থা খোলার প্রস্তাব দেন। গোরক্ষপুরে এই প্রকাশনা সংস্থা খোলা হলে, ঘনশ্যাম দাস তাঁর নিজের ব্যবসায়ী বন্ধু মহাবীর প্রসাদ পোদ্দারের সঙ্গে জয়দয়ালকে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। বলেন যেন মহাবীর প্রসাদ এই প্রেসে সবরকম আর্থিক, মানসিক, সামাজিক সাহায্য করবেন।   

 ঘনশ্যাম দাস জালান ‘গীতা প্রেস’ তৈরি করার উদ্দেশ্যে গোরখপুর শহরে একটি ছোট বাড়ি ভাড়া নেন। সভাপতি মিশ্র নামক এক ব্যক্তিকে এই গোটা ব্যবসার কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকবার জন্য নিয়োগ করেন। এই সভাপতি মিশ্রর মাধ্যমেই প্রথমে গোরখপুর শহর এবং সন্নিহিত গ্রামগুলিতে বিনামূল্যে গীতা বিতরণ করা হতো। শিশুদের উপযোগী গীতার সংস্করণ তৈরি করে, শিশুদের মধ্যেও তা বিতরণ করা হতো। এই যে গীতা ছাপা হতো, সেগুলির পান্ডুলিপি কিন্তু আসতো কলকাতা থেকেই। ১৯২৩ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত কলকাতা থেকেই এই পান্ডুলিপি আসার ব্যবস্থা ছিল।

১৯২৩’র এপ্রিলের হিসেবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে , ৬০০ টাকার গীতা, সেই সময় বিতরণের উদ্দেশ্যে এই ‘গীতা প্রেস’ থেকে ছাপা হয়েছিল। ১৯২৬ থেকে একেবারে হিন্দি ভাষাভাষী মানুষদের ভেতরে, হিন্দুত্ববাদী ভাষ্য সহ গীতা ছাপা হওয়া এবং সেই গীতা কার্যত বিনামূল্যে বিতরণ করবার কর্মকাণ্ডটি খুব পরিকল্পিতভাবে শুরু হয়। 

১৯২৫-এ আরএসএস’র জন্মের পর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি সামাজিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সেই রাজনৈতিক ধ্যান ধারণার সলতে পাকানোর ক্ষেত্রে এই গীতা প্রেসের মতো নানা ধরনের সংগঠন আরএসএস’র জন্মের আগে থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবির তৈরি করে ।

এই সংগঠন গুলির মতাদর্শের ভিত্তি হিসেবে রাজনৈতিক হিন্দুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্পর্কে প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থগুলির বিকৃত ব্যাখ্যা হাজির করে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে প্রথাগত শিক্ষা না পাওয়া অংশের মধ্যে। হিন্দিভাষী সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক হিন্দুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে আরএসএস’র অন্যতম প্রধান ভিত্তি রচনার কাজে এই ‘গীতা প্রেস’-কে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই কাজে 'সারা ভারত মারোয়ারি আগারওয়াল মহাসভা' ভূমিকা নেয়। এই সংগঠনটি আরএসএস’র ভিত্তি তৈরির জন্য গীতা প্রেসের ছাপা বই বিলি করতে থাকে গত শতাব্দীর বিশের দশকে।

এই সংগঠনটির অষ্টম অধিবেশন হয় ১৯২৬ সালে। আমাদের মনে রাখা দরকার, গীতা প্রেসের আনুষ্ঠানিক প্রকাশের আগে এই সারা ভারত মারোয়ারি আগরওয়াল মহাসভার আরো সাতটি অধিবেশন হিন্দি বলয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই অধিবেশনগুলির মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় ধ্যান ধারণাকে একটা বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে, সাম্প্রদায়িক ভাবনায়, গোটা দেশে প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে, রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীদের একত্রিত করবার কাজটি চলেছিল।

এই বিষয়টি এত বিস্তারিতভাবে এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে তার কারণে এই যে, আরএসএস’র আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার আগেই সামাজিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রসার বুঝতে। আরএসএস প্রতিষ্ঠার শতবর্ষের প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয় মূল্যবোধের প্রতিশব্দ হিসেবে 'হিন্দুত্ব'-কে প্রতিষ্ঠা করা চেষ্টা চালাচ্ছে। ‘গীতা প্রেস’কে মহাত্মা গান্ধীর নামাঙ্কিত পুরস্কার দেওয়ার মধ্যে রয়েছে সেই উদ্দেশ্য।

সারা ভারত মারোয়ারি আগরওয়াল মহাসভার অষ্টম অধিবেশন বসে দিল্লিতে। ১৯২৬ সালের মার্চ-এপ্রিল দীর্ঘ দু’মাস সম্মেলন হয়েছিল। এই সম্মেলনেই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ঘনশ্যাম দাস বিড়লা অংশ নেন। জিডি বিড়লা তাঁর বক্তৃতায় সারা ভারত মাড়োয়ারি আগরওয়াল মহাসভার অন্যতম বিশিষ্ট নেতা আত্মারাম খেমকার বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন। গীতা প্রেসের কর্মকাণ্ডের আড়ালে উগ্র হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দেওয়ার সমালোচনায় মুখর হন। 

বস্তুত ‘গীতা প্রেস’ থেকে হিন্দি ভাষায় বিতরণের জন্য যেসব গীতা ছাপা হচ্ছে, সেখানে ভাষ্য হিসেবে যে সমস্ত প্রসঙ্গের অবতারণা করা হচ্ছে , তার সঙ্গে ভারতীয় ঐতিহ্যের সম্পর্ক নেই, এই অভিযোগ তোলেন জিডি বিড়লা। গীতার ভাষ্যের আড়ালে অত্যন্ত কৌশলে সাম্প্রদায়িকতাকে ঢুকিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের মনে বিকৃত ধর্মবোধ হাজির করা হচ্ছে, এমন অভিযোগও মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ এই শিল্পপতি জোরালো ভাবে তুলে ধরেন। মারোয়ারি সমাজকে ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আবেদন জানান বিড়লা। 

ওই অধিবেশনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন আত্মারাম খেমকার। কিন্তু মারোয়ারি মহাসভার ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল বিড়লার অনুগামী অপর এক বিশিষ্ট শিল্পপতি যমুনালাল বাজাজের। পরবর্তীকালে যমুনালাল বাজাজ বাংলা ভাগের পক্ষে অত্যন্ত জোরদার অবস্থান নিয়েছিলেন।

 এখানে একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় যে ঘনশ্যাম দাস বিড়লা ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর অনুগামী। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর চিন্তায় তিনি ছিলেন বিশ্বাসী। বিবাহ, বিশেষ করে অসবর্ণবিবাহ ইত্যাদি প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর চিন্তাধারার প্রভাব মারোয়ারি সমাজে পড়ুক,  চাইতেন তিনি।

অপরপক্ষে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী একটি বড় অংশের প্রতিনিধিরা কোনো অবস্থাতেই চাইতেন না বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার পরিপন্থী কোনো সামাজিক রীতিনীতির প্রভাব মারোয়ারি সমাজ গ্রহণ করুক। রাজনৈতিক হিন্দু সংস্কৃতি ,ভারতীয় সংস্কৃতির নাম করে চাপিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে আত্মারাম খেমকা অত্যন্ত উগ্র ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। খেমকার হয়ে যিনি সমস্ত বক্তৃতা হনুমান প্রসাদ পোদ্দার।

একটা সময় এই হনুমান প্রসাদ পোদ্দারের সঙ্গে ঘনশ্যামদাস বিড়লার বন্ধুত্ব ছিল। হনুমান প্রসাদ পোদ্দার নিজেকে ধার্মিক বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন। গীতা, রামায়ণ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থের তিনি অনুগামী বলে প্রচার করতেন। কিন্তু ধর্মগ্রন্থ এবং পুরানের ভাষ্য রচনার ক্ষেত্রে ভারতের বহুত্ববাদী চেতনার পরিপন্থী  এবং সমন্বয়ী চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করতেন। 

গত শতাব্দীর বিশের দশকে হিন্দু মুসলমানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে চাপান উতোর দেখা গিয়েছিল, সেখানে এই ধরনের সংগঠনগুলির ভূমিকা, একাংশে, আরএসএস প্রতিষ্ঠার পটভূমি নির্মাণ করে। ১৯২৫ সালে আরএসএসের প্রতিষ্ঠাকালে গোটা ভারত জুড়ে হিন্দু মুসলমানের ভেতর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা একটা ভয়াবহ আকার নিয়েছিল। তার পরিবেশ তৈরিতে এই সংগঠনগুলি বিশেষ রকমের সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।

(দ্বিতীয় এবং শেষ অংশের জন্য চেখ রাখুন আগামীকাল)

Comments :0

Login to leave a comment