জয়নগরের দলুয়াখাকি গ্রামে সিপিআই(এম) কর্মী, সমর্থকদের বাড়ি ভাঙচুর, লুট, আগুন লাগানোর ঘটনায় অভিযুক্ত ৩ জনকে অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ধৃত ৩ জনই দলুয়াখাকি গ্রামে তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী। ঘটনার সাত দিন পর প্রবল চাপের মুখে পড়ে রবিবার রাতে জয়নগর থানার পুলিশ অভিযুক্ত আকবর ঢালি, আমানুল্লাহ জমাদার, নজরুল মণ্ডল নামে ওই ৩ তৃণমূল কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। ধৃতরা সহ মোট ৪০ জনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। বাকিরা গ্রামে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশের কাছে এখনো অধরা। এদিন ধৃতদের বারুইপুর আদালতে হাজির করলে বিচারক তাদেরকে ৩ দিন পুলিশ হেপাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
গত সোমবার ভোরে জয়নগরের বাঙালবুড়ির মোড়ের কাছে তৃণমূল নেতা সইফুদ্দিন লস্কর খুন হয়। এই ঘটনার পর সাহাবুদ্দিন লস্কর নামে একজনকে পিটিয়ে খুন করা হয়। এরপর ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৬ কিমি দূরে তৃণমূলের বাহিনী দলুয়াখাকি গ্রামে বর্বরোচিত আক্রমণ ও তাণ্ডব চালায়। সিপিআই(এম) কর্মী, সমর্থকদের বাড়িতে তৃণমূলের সশস্ত্র বাহিনী চড়াও হয়ে নির্বিচারে ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুট, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। দুষ্কৃতীদের হাত থেকে রেহাই পাননি আক্রান্ত বাড়ির মহিলা এমনকি শিশুরাও। গ্রামে বেপরোয়া তাণ্ডব, ভাঙচুর, লুট, অগ্নি সংযোগের ঘটনায় তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য মোরসেলিম লস্কর সহ মোট ৪০ জনের বিরুদ্ধে জয়নগর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন গ্রামের আক্রান্ত এক মহিলা।
অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার না করায় জয়নগর থানার পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আক্রান্ত ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীরা। অভিযুক্তরা গ্রামে ঘুরলেও পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার না করায় পুলিশের উপর ভরসা না করে তাঁরা সিবিআই তদন্তর দাবি তুলেছেন। পাশাপাশি দলুয়াখাকি গ্রামকে ঘিরে রাখার অভিযোগ তাঁরা তুলেছেন পুলিশের বিরুদ্ধে। তাঁদের কথায়, ত্রাণ নিয়ে আসা সিপিআই(এম), কংগ্রেস, আইএসএফ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকেও গ্রামে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে পুলিশ। মমতা ব্যানার্জির পুলিশ দলদাস। এই পুলিশের কাছে আমরা বিচার পাব না। বহিরাগতর তকমা দিয়ে অসহায়, সম্বলহীন মানুষদের পাশে দাঁড়াতে ত্রাণ নিয়ে আসা মানুষদের বাধা দিয়ে গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। জয়নগর থানার এই ভূমিকায় পুলিশের বিরুদ্ধে রাজ্য জুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। প্রবল চাপের মুখে পুলিশ। এদিন গ্রামবাসীরা জানান, চাপের মুখেই অভিযুক্ত ৩ জনকে ধরতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। আমরা অভিযুক্তদের সকলকের গ্রেপ্তার ও কঠোর শাস্তি চাই।
সোমবার গ্রামবাসীরা ফের অভিযোগ করে বলেন, দলুয়াখাকি গ্রামে পুলিশের উপস্থিতিতেই আক্রমণ, ভাঙচুর, লুট, অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটে। বামনগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য মরসেলিম লস্করের নেতৃত্বে গফফর মোল্লা, করিম হালদার, আমান জমাদার, আজিজ মণ্ডল, মারফত মণ্ডল, কাজেম মোল্লা, জুম্মান মোল্লা, সহর আলি লস্কর, জাকীর লস্কর, তাইজুল খাঁ, হাফিজুল খাঁ, তকদির লস্কর, আমানউল্লা লস্কর, মইউদ্দিন লস্কর, সহারাজ লস্কর, আবুজফর হালদার সহ মোট ৪০ জনের বিরুদ্ধে গত ১৪ নভেম্বর জয়নগর থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযুক্তদের সকলেরই বাড়ি দলুয়াখাকি গ্রামে। তারা শাসক দলের সক্রিয় বাহিনী।
দলুয়াখাকি গ্রামে বিরোধীদের ঢুকতে পুলিশ বাধা দিলেও বারুইপুর পূর্ব কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক বিভাস সরদার এদিন সভা করেন। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে প্রায় এক কিমি দূরত্বে তৃণমূলের সভা হয়। শাসক দলের এই সভা নিয়ে ফের প্রশ্নের মুখে জয়নগর থানার পুলিশ।
এদিনই ‘আক্রান্ত আমরা’র সদস্যদেরও দলুয়াখাকি গ্রামে ঢুকতে বাধা দেয় পুলিশ। সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক অম্বিকেশ মহাপাত্র ও অরুণাভ গাঙ্গুলি, প্রমিলা রায়বিশ্বাস, মৌসুমী ঘোষ দাস, অরুণিমা পাল, অলক প্রামাণিক, রঞ্জনা হাজরা সহ ৭ জনের এক প্রতিনিধিদল ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে দলুয়াখাকি গ্রামে ঢুকতে গেলে মনসাতলা মোড়ে তাঁদেরকে বাধা দেয় পুলিশ। গ্রাম থেকে প্রায় ৪ কিমি দূরে তাঁদের পথ আটকায় জয়নগর থানার পুলিশ বাহিনী। এই প্রসঙ্গে অম্বিকেশ মহাপাত্র জানান,‘‘জয়নগর থানার মনসাতলা মোড়ে পৌঁছে দেখি, গ্রামে যাওয়ার রাস্তায় বিরাট পুলিশ ব্যারিকেড। গাড়ি থেকে নেমে জয়নগর থানার আইসি’র সঙ্গে কথা বললাম। বললাম, আমরা কোনও রাজনৈতিক দলের তরফে আসিনি। কোনও ঝান্ডা, প্ল্যাকার্ড ছাড়া এসেছি। কোনও স্লোগান সাউটিং প্রোপাগান্ডা করার জন্য আসিনি। আমরা কেবলমাত্র গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলব এবং আধঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসব। আমাদের গাড়ি, আমাদের ব্যাগপত্র সার্চ করতে পারেন। আমাদের সঙ্গে কোনও বোমা বন্ধুক পিস্তল কিছুই নেই। আপনারা আমাদের রাস্তা ছেড়ে দিন। আমরা আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব। আইসি জানালেন গ্রামবাসী ছাড়া অন্য কোনও বহিরাগতদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে যেতে দেওয়া যাবে না। জানতে চাইলাম, দেশের সংবিধান এবং আইন অনুযায়ী আমরা কিভাবে বহিরাগত হলাম? আর আপনাদের কাছে কি কোনও কোর্টের নির্দেশ বা ১৪৪ ধারা জারির নির্দেশ রয়েছে? নিরুত্তর। কেবলমাত্র দু’টি শব্দবন্ধ আমাদের উদ্দেশ্যে বারেবারে বলে চলেছেন, সহযোগিতা করুন। এখন ফিরে যান। পরে আসবেন। আমরা এও বললাম, আপনারা বেআইনিভাবে আমাদের আটকাচ্ছেন। আইনের রক্ষক হয়ে কি করে বেআইনি পদক্ষেপ নিচ্ছেন? তারপরেও বলছেন সহযোগিতা করুন!
কিছুক্ষণ এভাবে কথাবার্তা হওয়ার পর বুঝলাম, পুলিশ প্রশাসন বেআইনিভাবে, অনড় মনোভাব নিয়ে, উপরের নির্দেশের দোহাই দিয়ে আমাদের আটকে রেখেছে। কবে এলে আক্রান্ত গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে দেবেন? বলুন। এক্ষেত্রেও নিরুত্তর। আমরা ঘটনাস্থল থেকে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি তথা রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন সভাপতি তথা 'আক্রান্ত আমরা' মঞ্চের অভিভাবক মাননীয় অশোককুমার গাঙ্গুলি মহাশয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলি। বিস্তারিত জানাই। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাক্তন মুখ্যসচিব তথা 'আক্রান্ত আমরা' মঞ্চের অভিভাবক মাননীয় অর্ধেন্দু সেনের সঙ্গেও কথা বলি। উভয়ে ফোনের মাধ্যমে জয়নগর থানার আইসি’র সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। জয়নগর থানার আইসি কথা বলতে রাজি হলেন না! শেষমেশ মাননীয় অশোককুমার গাঙ্গুলি মহাশয় এবং মাননীয় অর্ধেন্দু সেন মহাশয়ের পরামর্শে আমরা ফিরে আসি।’’
Joynagar murder
দলুয়াখাকিতে বাড়ি লুট, পোড়ানোয় ধৃত ৩
×
Comments :0