Ukraine Kalimpong Mercinery

ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে রাশিয়ার ‘ভাড়াটে সেনা’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে কালিম্পঙের বাসিন্দাকে

রাজ্য

কালিম্পঙের চিবো বস্তি থেকে সরাসরি রাশিয়ায়, যুদ্ধক্ষেত্রে। বেসরকারি সংস্থায় কাজের টোপ দিয়ে এজেন্ট চক্র নিয়ে যায় রাশিয়ায়। সেখানে গিয়েই উর্গেন তামাঙ বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি চক্রব্যুহে আটকে পড়েছেন, ফেরার রাস্তা বন্ধ!

ছয় মাস পেরিয়ে গিয়েছে। দেশে, নিজের পরিবার দুই সন্তানকের কাছে ফেরার আকুল আর্তি নিয়ে কোনও মতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই ভিডিও করে পাঠতে পেরেছিলেন কালিম্পঙে তাঁর স্ত্রী অম্বিকা তামাঙের কাছে। সেখানেই জানিয়েছিলেন তিনি- ‘‘আমার সঙ্গে আরও ১৫ জন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমি আর শ্রীলঙ্কার একজন বেঁচে আছি এখনও। আমাকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হোক।’’ কালিম্পঙে তাঁর পরিবার, পরিজন, প্রতিবেশীরা উর্গেন তামাঙের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন। ইতিমধ্যে একাধিক স্বেচ্ছ্বাসেবী সংস্থা তৎপর হয়েছে, দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁকে ফেরানোর দাবিতে মিছিলও হয়েছে পাহাড়ে। ভারত থেকে বেশ কয়েক জন এভাবেই কাজের সন্ধানে রাশিয়ায় গিয়ে সম্পূর্ণ প্রতারিত হয়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সহায়ক হিসাব কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। 

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের মধ্যে রাশিয়ার ‘ভাড়াটে সেনা’হয়ে লড়তে গিয়েই মৃত্যু হয়েছিল পাঞ্জাবের অমৃতসরের বাসিন্দা তেজপাল সিংয়ের। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে চাকরির খোঁজে বন্ধুদের সঙ্গে থাইল্যান্ডে যান বছর তিরিশের এই যুবক। সেখানে কয়েক দিন থাকার পর এবছরের  জানুয়ারি মাসে ট্যুরিস্ট ভিসায় রাশিয়ায় যান তাঁরা। ওই দেশে পৌঁছেই সেনা শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের, নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়েই নিয়ে যাওয়া হয় রণাঙ্গনে। গত মার্চ মাসে ইউক্রেনে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। 

ঠিক একইভাবে বেশি টাকায় বিদেশে কাজের টোপ দিয়ে এজেন্ট চক্র নিয়ে যায় উর্গেন তামাঙকে। উদ্বেগ, শঙ্কায় প্রতি মুহুর্ত কাটানো উর্গেন তামাঙের স্ত্রী অম্বিকা তামাঙের কথায়- ‘‘ নিরাপত্তারক্ষীর কাজের প্রস্তাব দেওয়ায় রাশিয়ায় যান আমার স্বামী, সংসার চালানোর দায়েই। কিন্তু সেখানে গিয়েই তিনি এজেন্টের প্রতারণায় পড়েন।  পরে রাশিয়ার ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। দুই সন্তান আছে, কীভাবে চলবে জানিনা! যেভাবেই হোক ওকে ফিরিয়ে আনা হোক, কী করবো জানি না, প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিন।’’

ভারতীয় সেনার গোর্খা রেজিমেন্টের প্রাক্তন জওয়ান উর্গেন তামাং কালিম্পঙের ১৯ ওয়ার্ডের চিবো বস্তির বাসিন্দা। বাড়িতে আছেন দুই সন্তান ও স্ত্রী। স্থানীয়দের সুত্রেই জানা গেছে, বছর কয়েক আগে সেনা বাহিনী থেকে অবসর নিয়েছিলেন উর্গেন তামাং।  তারপর মাঝে ভিনরাজ্যে বেসরকারি সংস্থায় নিরাপত্তার কাজও করেছেন। এরপর বিক্রম থাপা নামে পাহাড়ের এক এজেন্টের খপ্পরে পড়েন। ভিনরাজ্য থেকে বাড়িতে ফেরেন। তারপর সেই এজেন্ট জানায় রাশিয়ায় নিরাপত্তা সংস্থার কাজ আছে। বিপুল টাকা। এরপর গত ১৮ জানুয়ারি বাড়ি ছাড়েন উর্গেন তামাং।  প্রথমে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। তারপর সেখান থেকে পর্যটক ভিসায় রাশিয়ায়। সেখানে পৌঁছেই ্তামাং টের পান প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন। গোর্খা রেজিমেন্টের প্রাক্তন  এই সেনাকে নামমাত্র প্রশিক্ষন দিয়েই ওয়ার ফ্রন্টে ঠেলে দেওয়া হয়। 

গত মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রথম একটি ভিডিও করে তিনি বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে তখন প্রবল ঠান্ডা। ভিডিওতে বোঝা যায় মুখ থেকে কথা বলার সময় ধোঁয়া বেরোচ্ছে, গরম পোশাক পড়ে কোনোমতে সেই ভিডিও করেছিলেন তিনি। আকুল আর্তি জানিয়েছিলেন - ‘ ইউক্রেনের সঙ্গে লড়াই করতে ফ্রন্টলাইনে আমাকে পাঠানো হচ্ছে। আর দিন দুয়েকের মধ্যে আমাকে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হবে, ভারত সরকার আমাকে বাঁচাক।’

কীভাবে এই খপ্পড়ে পড়লেন তা বলতে গিয়েই উর্গেন তামাং ভিডিওতে বলেন - পাহাড়ের এজেন্ট আমাকে প্রথমে দিল্লিতে পাঠায়। ওখানে হোটেলে আসে আরেক এজেন্ট। আমাকে সেখানে ভিসা, টিকিট ধরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর মস্কোর বিমানে উঠিয়ে দেয়। ওখানে এক নেপালি আমায় রিসিভ করে। সেখানে রাতে একটি হোটেলে রাখে। পরের দিন তামিলনাড়ুর দুই এজেন্টের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে একটি হোটেলে ৮-১০ দিন রাখে। তারপর সেখান থেকে একটি ফৌজি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে ১৭-১৮ দিন রাখে, নর্মাল ট্রেনিংয়ের জন্য। তারপর সেখানে সইসাবুদ করার পরে ফের গাড়িতে করে একটি জঙ্গলে ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে বলা হয়, ইউক্রেনের সঙ্গে লড়ার জন্য ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা হিসাবে তারা নিয়েছে আমায়, ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ আমাকে প্লিজ বাঁচান’। কালিম্পঙে পৌরসভার প্রশাসকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোহ হয়েছে বলে ভিডিও বার্তায় জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তারপরেও তিন মাস পেরিয়ে গেছে। আটকে রয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রেই। তাঁর সঙ্গেই থাকা ১৩ জনের ইতিমধ্যে মৃত্যু হয়েছে। গোটা ঘটনাটি সম্পর্কে অবহিত বিদেশমন্ত্রকও। 

কালিম্পঙের দীর্ঘদিনের সংগঠক, সিপিআই(এম) নেতা তারা সুন্দাসের কথায় - গোটা কালিম্পঙের মানুষের একটাই আর্জি, সুস্থভাবে ফিরে আসুক উর্গেন তামাং। পরিবারের জন্য, সংসারের জন্যই তো ছুটে যেতে হয়েছে তাঁকে। পাহাড়ে কাজ নেই। কোভিড পর্বের সময় জিটিএ’র নিজস্ব সমীক্ষার তথ্য বলছে, কালিম্পঙ থেকে ৪৭ হাজার যুবক পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিন রাজ্যের পাশাপাশি সৌদি, দুবাইতে কাজের খোঁজে চলে গেছেন। এজেন্টরা এদের ভুল বুঝিয়ে টাকার লোভ দেখিয়ে নিয়ে যায়। পাহাড়ের উন্নয়ন, কাজের চেহারা বেহাল। তবে এখন আমাদের সবাইকে চেষ্টা করতে হবে উর্গেন যাতে ফিরে আসে, কেন্দ্রীয় সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এখানকার বিজেপি সাংসদ মুখে বলেছেন তিনি দেখছেন ব্যাপারটা, কিন্তু কী হচ্ছে তা তো বোঝা যাচ্ছেনা। 

অন্যদিকে এভাবে কাজের সন্ধানে যাওয়া ভারতীয়দের ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে যুদ্ধক্ষেত্রে কাজে লাগানোর অভিযোগ ইতিমধ্যে আবার অস্বীকার করেছে করেছে রাশিয়া। ভারতীয়রা রাশিয়ায় কাজের খোঁজে গিয়ে সেনায় যোগ দিতে বাধ্য  হচ্ছেন বলে অভিযোগ ওঠার পরে দুই দেশের কূটনেতিক মহলে তা নিয়ে মত বিনিময় হয়েছে। তবে দিল্লিতে কর্তব্যরত রুশ রাষ্ট্রদূত দাবি করেছেন, ভারতীয়রা সম্পূর্ণ আর্থিক কারণে সেনাবাহিনীতে অংশ নিলেও কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে নারাজ ছিল। প্রয়োজনীয় ভিসা না থাকলেও অবৈধভাবে তারা রুশ সেনাবাহিনীতে সহায়ক কর্মী হিসাবে যুক্ত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সেখান থেকে উর্গেন তামাংদের ফিরিয়ে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কী উদ্যোগ নিচ্ছে তা নিচ্ছে তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে।

Comments :0

Login to leave a comment