শেষ পর্যন্ত টাকার বিনিময়ে পুরস্কার ‘কিনে’ আত্মপ্রচার করতে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারকে? এই অভিযোগে অভিযুক্ত উত্তর প্রদেশের যোগী সরকারও।
গত প্রায় একদশক ধরে প্রায় প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একের পর এক দপ্তর, একের পর এক সরকারি প্রকল্পের জন্য ‘স্কচ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে এবং সেগুলিকে তাঁর সরকারের ‘সুশাসনের স্বীকৃতি’ বলে মমতা ব্যানার্জি হামেশাই দাবি করে থাকেন। কিন্তু সম্প্রতি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (ক্যাগ)-এর হিসাব পরীক্ষার তথ্য থেকে জানা গিয়েছে, রাজ্য সরকারের একটি সংস্থা থেকে পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থা স্কচ গ্রুপকে শুধুমাত্র ২০২২ সালেই প্রায় ১২ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে একটি পুরস্কার পাওয়ার জন্য। ওয়েস্ট বেঙ্গল মিনারেল ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড একটি খাতে ১১ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা খরচ দেখিয়েছে। টেন্ডার ছাড়া কেন এই খরচ তার ব্যাখ্যায় ক্যাগ-এর প্রশ্নের উত্তরে কর্পোরেশন জানিয়েছে, স্কচ গ্রুপের অ্যাওয়ার্ড সামিটে অংশগ্রহণের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ১১ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে বলেই এক্ষেত্রে কোনও টেন্ডার বিধি অনুসরণ করা হয়নি।
রাজ্য সরকার এবং তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা বহুবার স্কচ অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি নিয়ে বহু কৃতিত্ব জাহির করলেও কখনও প্রকাশ করেনি যে এই পুরস্কার পাওয়ার জন্য সরকারি তহবিল থেকে কোটি কোটি টাকা পাঠানো হয়েছে স্কচ গ্রুপকে। সমাজ ও আইন গবেষক এবং তথ্যের অধিকার কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামী ‘রাইট টু ইনফরমেশন’ আইন অনুসারে ক্যাগ-এর কাছ থেকে সম্প্রতি এই তথ্য জানতে পেরেছেন। আর তাতেই স্কচ পুরস্কার এবং তা প্রাপ্তির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
স্কচ গ্রুপ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা ২০১৪ সাল থেকে প্রতি বছর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সরকারকে, তাদের দপ্তর ও প্রকল্পকে ‘গভর্ন্যান্স’ বা সরকারি পরিষেবাদানের কৃতিত্ব হিসাবে পুরস্কার প্রদান শুরু করেছে। স্কচ গ্রুপের দাবি, তারা নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুরস্কার প্রদান করে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক মহলের বাইরে আর্থ-সামাজিক গবেষকদের অনেকেই স্কচ গ্রুপের রেটিং-য়ে অস্বচ্ছতার জন্য কোনও আমল দিতেই রাজি নয়। ২০১৫ সাল থেকে মমতা ব্যানার্জির সরকার একের পর স্কচ পুরস্কার পেয়ে চলেছে, ২০২১ সালের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নানা দপ্তর নানা ক্ষেত্রে ৩০টির বেশি পুরস্কার আদায় করেছে, বর্তমানে রাজ্যের ঝুলিতে আছে প্রায় চল্লিশটির মতো স্কচ পুরস্কার। এমনকি, যে ট্রামকে রাজ্য সরকার কলকাতার বুক থেকে প্রায় তুলেই দিয়েছে সেই ট্রামকে সাজানোর জন্যও স্কচ পুরস্কার মিলেছে! অবশ্য স্কচ পুরস্কার আদায়ে এবং স্কচের মূল্যায়নে উত্তর প্রদেশের যোগী সরকার বাংলার থেকেও অনেক এগিয়ে আছে। আবার স্কচের নিরিখে গোয়ার মতো ছোট রাজ্যগুলি অনেক পিছিয়ে, সুশাসনে তাদের নাকি এতটাই ‘খামতি’।
কিন্তু সরকারি সংস্থার তহবিল থেকে বেসরকারি পুরস্কার প্রদানকারী গ্রুপকে টাকা দেওয়ার বিনিময়ে পুরস্কার আদায়ের তথ্য পেয়ে বিস্মিত বিশ্বনাথ গোস্বামী বলেছেন, কেবল সরকারি সংস্থা মিনারেল ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন থেকেই যদি এত টাকা দিয়ে পুরস্কার নিয়ে আসা হয়, তাহলে এভাবে অন্যান্য দপ্তর এবং সরকার পরিচালিত সংস্থাগুলির থেকে মোট কত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে? পুলিশ, পরিবহণ, শিক্ষা, পর্যটন, এমনকি জেলা প্রশাসনগুলিও বন্যার মতো পুরস্কার পেয়েছে। এগুলির জন্য কোন খাত থেকে সরকার টাকা দিয়েছে? এভাবে টাকার বিনিময়ে পুরস্কার আনায় রাজ্যবাসীর কী লাভ হয়েছে?
রাস্তায় হোর্ডিংয়ে এবং মিডিয়াতে বিভিন্ন জ্যোতিষীরাও অনেক ভুয়ো সংস্থার থেকে পুরস্কার প্রাপ্তির দাবি করে নিজেদের বিজ্ঞাপিত করে থাকে। স্কচ গ্রুপ সম্পর্কে তেমন কোনও প্রমাণ না থাকলেও তাদের পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা উড়িয়ে দিয়ে অনেকেই বলেছেন, এরা পুরস্কারের জন্য নাম নথিভুক্ত করতে বিভিন্ন অছিলায় টাকা নেয় সরকারি দপ্তরগুলির কাছ থেকে। প্ল্যাটিনাম, গোল্ড, সিলভার ইত্যাদি নানা ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেয় এবং একেকটা ক্যাটাগরির জন্য টাকা দিতে হয় একেক অঙ্কের। তবে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে বা বিশিষ্ট ব্যক্তিকে টাকা ছাড়াও পুরস্কার প্রদান করতে পারে।
বিশ্বনাথ গোস্বামীর মতে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোন খাতে কীভাবে স্কচ গ্রুপকে টাকা দিয়েছে তা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। অন্যদিকে, ইডি’র মতো সংস্থার অবিলম্বে এই ধরনের পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও অন্যান্য কার্যকলাপ খতিয়ে দেখা উচিত। নইলে ভবিষ্যতে হয়তো ডিয়ার লটারির মতো কেলেঙ্কারি ধরা পড়বে যেখানে কার্যত দুর্নীতির টাকা তছরূপ করে সরানো হয়েছে।
Mamata's government buying Award with money
টাকা দিয়ে পুরস্কার ‘কিনে’ আত্মপ্রচার মমতা সরকারের

×
Comments :0