Messi Argentina

শিকলছেঁড়া পায়ের খোঁজে ফুটবল

খেলা

বুয়েনস আয়ার্সের রাস্তায় প্রায় প্রতিদিন বিক্ষোভ চলছে। মুদ্রাস্ফীতির হার হুহু করে বাড়ছে। আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি চাপ বাড়াচ্ছে। দেশের উপরাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শাস্তির নিদান দিয়েছে আদালত, বিতর্ক চলছে তা নিয়ে। 
হতেই পারত, এই সময়ে ‘ধুর বিশ্বকাপ’ বলে তিতিবিরক্ত মানুষ উড়িয়ে দিতে পারতেন ফুটবলকে। কিন্তু দিয়েগো মারাদোনার দেশে তা হয় না, হয়ওনি। বরং বিশ্বকাপ এমন এক মোহ তৈরি করেছে যেন সেখানে জিততে পারলেই যন্ত্রণার অবসান হবে। এই যে তীব্র, সংরক্ত আবেগ আর প্রত্যাশার চাপ, তা ভর করেছে একটি কাঁধে। মঙ্গলবার রাতে একজন, শুধু একজনের কাছেই ম্যাজিক মুহূর্ত প্রার্থনা করছে একটা গোটা দেশ। 
এই প্রত্যাশার চাপ এবার তুঙ্গে, কেননা এরপর লিওনেল মেসি আর বিশ্বকাপে খেলবেন না। রেকর্ডের স্বর্ণতবকে মোড়া এমন একজন প্লেয়ার শতাব্দীতে একবার-দু’বারই আসেন। বিশ্বের ফুটবল বোদ্ধাদের বিরাট অংশই যাঁকে এই খেলার ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মানেন, তাঁর শেষ সুযোগ। মাঠে যেমন ছ’জন বিপক্ষের ডিফেন্ডার তাঁকে ঘিরে রাখছেন, তেমন এই ইতিহাসই তাঁকে তিরবিদ্ধ করছে, তোমার হাতে বিশ্বকাপ নেই। প্রথমটি টপকানো সোজা, দ্বিতীয়টি মারাত্মক কঠিন। 
এক কাহিনির শুরু এবং শেষের সমাপতন লক্ষ্য করার মতো। মারাদোনা যুগের অবসানের পরে আর্জেন্টিনা যখন বিশ্ব ফুটবলে সাফল্যের খরায় ভুগছিল, তখন অনূর্ধ্ব ২০’র বিশ্বকাপ জয়ী হয় ১৯৯৫ সালে। এই কাতারেই। মেসির তখন ৮ বছর বয়স। জোস পেকারম্যানের প্রশিক্ষণে যুব দল সেই সময়ে এই প্রতিযোগিতার সাতবারের মধ্যে পাঁচবারই চ্যাম্পিয়ন হয়। মেসির যখন ১৮, তখন নেদারল্যান্ডসে ২০০৫-এ এই দলের সদস্য ছিলেন। ফাইনালে নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে দুটি পেনাল্টি থেকেই তিনি গোল করেন। ‘যুব বিশ্বকাপ’ তাঁর হাতে ওঠে। তার আগে অবশ্য বার্সেলোনার হয়ে ময়দান কাঁপাতে শুরু করে দিয়েছেন, স্পেন এবং আর্জেন্টিনার মধ্যে তাঁকে নিয়ে একপ্রস্থ টানাটানিও হয়ে গেছে। পেকারম্যানের তৈরি সেই দলের দু’জন, ডি মারিয়া এবং পাপু গোমেজ এখন আর্জেন্টিনা দলে রয়েছেন। তাঁরা এই প্রতিযোগিতা জিতেছিলেন ২০০৭-এ। 
২০০৬-এ জাতীয় দলে মেসিকে ডাকেন পেকারম্যান। বিশ্বকাপে সার্বিয়া-মন্টেনেগ্রোর বিরুদ্ধে ৭৪ মিনিটে মাঠে নামেন। সহজ ম্যাচ, মেসি গোলও পান। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির বিরুদ্ধে ম্যাচ আটকে গেছে দেখে পেকারম্যান তাঁকে নামাননি। শোনা যায়, দলের সিনিয়র খেলোয়াড়রাও কোচকে বলেছিলেন, ওকে নামান, পারলে ও-ই ম্যাচ বের করতে পারবে। শেষ পর্যন্ত পেনাল্টি শুট আউটে ২-৪ গোলে আর্জেন্টিনা হারে। তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয় পেকারম্যানকে। 
ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড যখন বার্সেলোনার এক কিশোরকে তাঁর স্বাভাবিক লেফট উইং পজিশন থেকে সরিয়ে ডানদিকে খেলান, মেসির আপত্তি ছিল। কিন্তু এর পর থেকে আজ পর্যন্ত ওটিই হয়ে উঠেছে মেসির ভয়ঙ্করতম খেলার বিশেষত্ব। ডানদিক থেকে ক্রমশ ভেতরে ঢোকেন এবং বাঁ পা-কে কাজে লাগান গোল বা চুলচেরা পাসের জন্য। ওই রকম একটি মুভমেন্ট তিনি শুরু করার পরেই বিপক্ষের রক্ষণে ত্রাহি রব ওঠে, ধারাভাষ্যকারদের কণ্ঠ চড়তে থাকে। সকলেই জানেন, স্বয়ং মারাদোনাও বলেই গিয়েছেন মেসির থেকে ভালো বল কন্ট্রোল কারও নেই। তাঁর পা থেকে বল কেড়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। 
কিন্তু, এই কোনোকিছুই ‘মেসি’ না। মেসি হচ্ছেন আপাত-উদাসীনতা থেকে হঠাৎই তরবারির মতো ধারালো হয়ে ওঠা। বিপক্ষ যখন শূন্যতা দেখছে, শূন্যের ভেতরে হঠাৎ ঢেউ হয়ে ওঠা। মেসি ঘুরছেন-ফিরছেন, সারাক্ষণ ঝাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন না, এই দৃশ্যকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পান বিপক্ষের কোচ। মার্কার রাখবেন? তাঁকে এমন জায়গায় টেনে নিয়ে যাবেন যে রক্ষণে ভারসাম্য টলে যাবে। নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে প্রথম গোলে হঠাৎ গতি বাড়িয়ে সোজা বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের দিকে দৌড়চ্ছিলেন, ডাচ ডিফেন্ডারা ঘিরে ধরতে শুরু করেছেন, এমন সময়েই একটি ন্যানো সেকেন্ডের থমকে যাওয়া এবং অবিশ্বাস্য রিভার্স পাস। ভ্যান ডাইক ভাবছেন পাস যাবে বাঁ দিকে, মেসি দিলেন ডানদিক থেকে ছুটে আসা মোলিনাকে। একটি পাস যা গুণে গুণে নেদারল্যান্ডসের ছ’জন ডিফেন্ডারকে স্থবির বানিয়ে দিল। এই রকম পাস ১০০১ ম্যাচে মেসি অগুন্তি করেছেন। কিন্তু আসল কথা হলো, এই পাস তিনি এখনও করছেন। 
আর্জেন্টিনার দল তত ভালো নয়, ফাঁক আছে, মেসিকে যথাযথ সাহায্য দিয়ে যেতে পারেন, ডি মারিয়া ছাড়া তেমন কেউ নেই। এইসব কথা ইত্যাদি। মারাদোনার ১৯৮৬-র দলেও কি সেই ভারসাম্য ছিল? ১১ জনের খেলাকে একজনের খেলায় পরিণত করে ফেলা ছাড়া এখন মেসির সামনে কোনও বিকল্প আছে কি? 
মঙ্গলবার রাতে মেসিকে নামতে হবে কঠিন প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে। যাদের কোচের মুখে বারবার শোনা যাচ্ছে ‘শৃঙ্খলার’ কথা। যা দিয়ে তিনি আসলে মেসিকে আটকাতে চান। আর্জেন্টিনা সহ কোটি অনুরাগী থাকবেন শিকলছেঁড়া পায়ের খোঁজে।

Comments :0

Login to leave a comment