Trafficking

ফের ৩৪ যুবতীকে পাচারের চেষ্টা, শিলিগুড়ির বিলাসবহুল বাস থেকে উদ্ধার

রাজ্য জেলা

অনিন্দিতা দত্ত- শিলিগুড়ি
রেলের পরে এবার সড়ক পথে নারী পাচারের চেষ্টা ভেস্তে দিলো পুলিশ। পাচার হওয়ার আগে শিলিগুড়িতে বাস টার্মিনাস থেকে উদ্ধার হলো ৩৪ জন যুবতী। সম্প্রতি শিলিগুড়ি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ট্রেনে চাপিয়ে পাচারের পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার ঘটনার সাত দিনের মাথায় সড়কপথে একটি বিলাসবহুল বাসে চাপিয়ে যুবতীদের পাচারের ছক কষা হয়েছিলো। সেই পরিকল্পনাও ভেস্তে গেলো। যুবতী পাচারের চেষ্টার অভিযোগে এক মহিলা সহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ধৃতরা হলো শিলিগুড়ির হায়দারপাড়ার বাসিন্দা গৌতম রায়, ডুয়ার্সের মেটেলির বাসিন্দা পেট্রাস বেক ও শিলিগুড়ির জনতানগরের বাসিন্দা জয়শ্রী পাল। ধৃতদের সোমবার শিলিগুড়ি মহকুমা আদালতে ততুলে পাঁচদিনের জন্য পুলিশী রিমান্ডে নেবার আবেদন জানানো হয়েছে প্রধাননগর থানার পুলিশের তরফে।
রবিবার বিকেলে এসএসবি’র দেওয়া গোপন খবরের ভিত্তিতে সন্ধ্যার পর শিলিগুড়ির বাসস্ট্যান্ডে অভিযান চালায় শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের প্রধাননগর থানার পুলিশ। বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চলাকালীন সময়ে একটি বিলাসবহুল বাস থেকে ৩৪ জন যুবতীকে উদ্ধার করা হয়। এই খবর চাউর হতেই গোটা শহর জুড়ে হইচই পড়ে যায়। উদ্ধার হওয়া ৩৪ যুবতীদের বাসে চাপিয়ে ঝাড়খন্ডের রাঁচিতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিলো। পরে সেখান থেকে ট্রেনে চাপিয়ে তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুর নিয়ে যাবার ছক কষেছিলো পাচারকারীরা। যুবতীদের মাথা পিছু চার হাজার টাকার বিনিময়ে পাচারকারীরা পাচারের এই কাজ করছিলো। প্রাথমিক তদন্তে এমনটাই জানতে পেরেছে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে আরও জানা গেছে, উদ্ধার হওয়া যুবতীরা আলিপুরদুয়ার জেলার কালচিনির বাসিন্দা। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের ক্যাপিটাল এক্সপ্রেস থেকে উদ্ধার হওয়া যুবতীদের যেরকম ব্যাঙ্গালোরে ইলেকট্রনিক্স সংস্থায় চাকরি দেবার প্রলোভন দিয়ে পাচারের চেষ্টা হয়েছিলো, একইরকমভাবে বাসস্ট্যান্ড থেকে উদ্ধার হওয়া যুবতীদেরও চাকরির টোপ দিয়ে পাচারের পরিকল্পনা ছিলো বলেই পুলিশ জানতে পেরেছে। কিন্তু কোয়েম্বাটুরে একটি কাপড়ের সংস্থায় সেলাইয়ের কাজে নিয়োগ করা হবে বলে যুবতীদের জানানো হয়েছিলো। যুবতীদের উদ্ধারের ঘটনার পরে প্রধাননগর থানার আইসি বি ডি সরকার জানান, উদ্ধার হওয়া যুবতীদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনার তদন্তে শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের পাশাপাশি রেল পুলিশের পক্ষ থেকেও ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এমনটাই জানা গেছে। 
প্রসঙ্গত গত ২১ জুলাই অর্থাৎ সোমবার নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের শিলিগুড়ি—পাটনাগামী ক্যাপিটাল এক্সপ্রেস থেকে টিকিটহীন অবস্থায় ৫৬ জন যুবতীকে উদ্ধার করা হয়। রাতের বেলার রুটিন তল্লাশি চালানোর সময় ট্রেনের কামড়ায় নজর পড়ে জিআরপি ও আরপিএফের। এরপরেই উদ্ধার করা হয় যুবতীদের। ব্যাঙ্গালোরে কাজ দেবার টোপ দিয়ে যুবতীদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো পাটনা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পের ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে তার আড়ালেই চলছিলো নারী পাচার। দিন দয়াল উপাধ্যায় গ্রামীন কৌশল্য যোজনার প্রকল্পের আড়ালেই চলছিলো এই গুরুতর অপরাধমূলক কাজ। তদন্তে এই তথ্যই উঠে আসে রেল পুলিশের হাতে। শহরের ইস্টার্ন বাইপাস এলাকায় একটি বানিজ্যিক ভবনে অফিস খুলেই চলছিলো এই চক্রের কার্যকলাপ। ঘটনায় এক মহিলা সহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের পুলিশী রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে পুলিশ। 
উদ্ধারের পরে যুবতীদের সোমবার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনকে ব্যবহার করে ৫৬জন যুবতীদের ভিন রাজ্যে পাচারের চেষ্টা পরিকল্পনা ভেস্তে যাবার পরে, ফের শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে ৩৪ জন যুবতী উদ্ধারের পেছনে কি আন্তঃরাজ্য নারী পাচার চক্রের সক্রিয়তা রয়েছে? দুটি পৃথক ঘটনার পাচারের আগে শতাধিক যুবতী উদ্ধারে এমনটাই অনুমান পুলিশের। সোমবার পুলিশী জেরায় ধৃতরা জানিয়েছে, বন্ধ ও রুগ্ন চা বাগানে কাজ নেই। রোজগারের কোন দিশা নেই। তাই সেখানকার যুবতীদের চাকরির জন্য ভিন রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। নারী পাচারের মতো কোন বেআইনী কাজ হচ্ছিলো না বলেই তামিলনাড়ুতে পাচারের চেষ্টার অভিযোগে ধৃতদের দাবি। 
গ্রেপ্তার হওয়া শিলিগুড়ি হায়দারপাড়ার বাসিন্দা গৌতম রায় জানান, কোন বেআইনী কাজ করিনি। প্রত্যেক যুবতীর ববস আঠারোর উর্ধে। প্রত্যেকের চাকরির নথি আছে। আমাদের ফাঁসানো হচ্ছে। চাকরি সংক্রান্ত নথি পুলিশের হাতে জমা দিয়েছি। চাকরির জন্যই যুবতীদের কোয়েম্বাটুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। পুলিশ ও আইনের ওপর আস্থা আছে। গৌতমের মা চাঁদনি রায়ের দাবি আমার ছেলে এর আগেও অনেককে চাকরি দিয়েছে। ও নির্দোষ। 
সোমবার শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের ডিসিপি বিশ্বচাঁদ ঠাকুর বলেন, নাগরাকাটা, মেটেলি, বানারহাট সহ ডুয়ার্সের চা বাগান অধ্যুসিত এলাকার মোট ৩৪জন যুবতীদের উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া যুবতীদের চাকরিক টোপ দিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। উদ্ধার হয়েছে কিছু চাকরির নথিপত্রও। সেগুলি যাচাই করে দেখা হবে। মানব পাচার বন্ধে বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতা মূলক শিবির করা হবে। 
রেল পুলিশের সূপার কুনওয়ার ভূষন সিং বলেন, এই ঘটনার কিনারা করতে আমরাও শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের সাথে মিলে ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করব। 
শিলিগুড়ি শহরকে কেন্দ্র করে একের পর এক নারী পাচারের ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। রেল ও সড়ক দুই পথে যুবতী পাচারের চেষ্টার নেপথ্যে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে উত্তরবঙ্গের তরাই ও ডুয়ার্সের বিস্তীর্ন চা বলয়ে পাচারকারীদের নজর রয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ভুয়ো নথিপত্র দেখিয়ে বাগিচা শ্রমিকদের ঘরের মেয়েদের কাজের প্রলোভন দিয়ে ভিন রাজ্যে পাচারের চেষ্টা চালাচ্ছে পাচারকারীরা। কাজের প্রয়োজনে ও টাকার অভাবে পাচারকারীদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে চা বলয়ের শ্রমিক পরিবার ও ঘরের যুবতীরা। স্বাভাবিকভাবেই উত্তরবঙ্গের নারী পাচার চক্রের সক্রিয়তা নিয়ে আরও একবার প্রশ্ন উঠেছে।

Comments :0

Login to leave a comment