Mursalim

গেঞ্জি খুলে মোরসালিমের দৌড়, বেঁচে গেল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস

রাজ্য

 ছোটবেলার পাঠ্যপুস্তকে সেই ‘বাঁধরক্ষা’র গল্পই যেন বাস্তবে ধরা দিল। ওলন্দাজ কিশোর হান্স সারারাত বাঁধের গর্তে হাত ঢুকিয়ে রেখে গোটা গ্রামকে রক্ষা করেছিল।
আর, মালদহের হরিশচন্দ্রপুরের ছোট্ট মোরসালিম ট্রেন লাইনের ফাটল দেখে নিজের পরনের লাল গেঞ্জি খুলে তা ওড়াতে ওড়াতে রেললাইন ধরেই দৌড়ে বড়সড় দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচালেন হাজারো মানুষকে। ছোট্ট হান্স বাঁচিয়েছিল বাঁধ, রক্ষা পেয়েছিল তার গ্রাম। মোরসালিম শিয়ালদহ-শিলচর আপ কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে এক মারাত্মক দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করে বাঁচালেন হাজার দুয়েক যাত্রীর জীবন।
ছোট্ট মোরসালেম মুহুর্তেই হান্সের মতই হয়ে উঠলো গোটা গ্রামের, গোটা জেলার গর্ব। সব মহল থেকে আসছে উপচে পড়া প্রশংসা, অভিনন্দন। 
সেই লাল গেঞ্জিটা গত দু’দিন ধরে আর ছাড়েনি সপ্তম শ্রেণির মোরসালিম। ওটা পরেই সারা দিন ঘুরছে, কত মানুষ তার প্রশংসা করছে! মোরসালিম নির্বিকার। দুপুরে তার ঘরের দাওয়ার সামনে বসে গ্রামবাসীদের সামনেই বলছিল, ‘তখন বৃষ্টি পড়ছিল, পুকুরে মাছ দেখতে গেছিলাম। রেললাইনে একটা গর্ত দেখলাম। অনেক বড় গর্ত। তারপর দেখলাম ট্রেন আসছে। সবাই চিৎকার করেছে, কিন্তু শুনতে পাচ্ছিল না ট্রেন। তখন আমার গেঞ্জিটা খুলে রেললাইনের ওপর দিয়েই ট্রেনের দিকে ছুটে যাই। ট্রেন থেমে যায়। তারপর পুলিশ নেমে আসে। আমার কাছে শুনে এসে দেখে কত বড় গর্ত ছিল’। 
কিশোর মোরসালিমের উপস্থিত বুদ্ধি, সাহসিকতার পরিণামে এক বড়সড় দুর্ঘটনার মুখ থেকে রেহাই পেলো কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ও তার হাজার দুয়েক যাত্রী। ঘটনাস্থল মালদহের ভালুকা রোড স্টেশন ও হরিশচন্দ্রপুরের মাঝামাঝি মশালদা গ্রাম পঞ্চায়েতের পুরাতন কোলিয়ারি গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইনের মাটির নিচে ধস থেকে বড়সড় গর্ত তৈরি হয়েছে, লাগাতার বৃষ্টিতে তা রীতিমত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। বৃহস্পতিবার দূপুরে গ্রামেরই ওয়াহেদপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মোরসালেম ও তাঁর বন্ধুরা রেললাইনের ধার দিয়ে যাওয়ার সময়তেই সেই লাইনের নিচে সেই গর্ত দেখতে পেয়েছিল। সেই সময়েই আসছিল দ্রুত গতির কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস।
দরিদ্র পরিবারের সন্তান মোরসালিম। বাবা পরিযায়ী শ্রমিক। গ্রামের কাজের আকালের কী চেহারা তা মোরসালিমের পরিবারের দিকে চোখ রাখলেই স্পষ্ট। বাবা ইসমাইল পরিযায়ী শ্রমিক। গুজরাটে রয়েছেন, রাজমিস্ত্রীর কাজে। মা মর্জিনা খাতুন বিড়ি বাঁধেন বাড়িতে। সরকার নির্ধারিত মজুরি দৈনিক ২৯৩ টাকা, চুক্তি হয়েছে ১৭৮ টাকায়। পাচ্ছেন দৈনিক ১৩০ টাকা মজুরি। শুধু বাবা নয়, মোরসালিমের দুই কাকাও ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন কাজের খোঁজে। এক কাকা কেরালায়, আরেকজন কাশ্মীরে আপেল বাগানে। ঘরে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নেই, সকলেই পরিযায়ী শ্রমিক। 
সেই পরিবারের সন্তানের এমন কীর্তিতে গোটা গ্রামের মানুষ প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ঘটনাটি বৃহস্পতিবার ঘটলেও শুক্রবার রাতে সেই খবর সামনে আসে। আশ্চর্যজনকভাবে রেলের তরফেও গোটা ঘটনাটি চেপে যাওয়া হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল বৃহস্পতিবার দুপুরে। পৌনে দুটো নাগাদ মালদহ স্টেশন ছেড়ে যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। পৌনে তিনটে নাগাদ ভালুকা ছেড়ে এগোনোর পরেই মোরসালিমের লাল গেঞ্জি খুলে দৌড়ানো দেখে এমার্জেন্সি ব্রেক চেপে ট্রেন থামান চালক। নামেন আরপিএফ’র কর্মীরা। তাঁরা ঘটনাস্থলে এসে চমকে যান। বাস্তবিকই যে বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেল ট্রেন তা জানান তাঁরা। এরপর পাথর ফেলে কিছুক্ষণ পরে লাইনের নিচে ঐ গর্ত বোজানো হয়। বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার ট্রেন রওনা দেয় শিলচরের অভিমুখে। 
বিভিন্ন মহলের তরফে আসছে অভিনন্দন বার্তা। এত মানুষের প্রশংসা, শুভেচ্ছায় খানিকটাই লজ্জাই পাচ্ছে মোরসালিম। এদিন দুপুরে বলছিল-লাইনের নিচে মাটি সরে গেছে, ‘গর্তটা দেখে আমি গেঞ্জিটা খুলে ফ্ল্যাগের মতো ওড়াত ওড়াতে ছুটছিলাম ট্রেনের দিকে। লাল রঙের গেঞ্জি ওড়াতে হয় জানতাম। সবাই আমার কাছে আসছে দেখতে, কেমন লাগছে যেন’। রেলের তরফেও শুভেচ্ছা জানানো হলেও এত বড় সাহসিকতার নজিরের জন্য পুরস্কৃত করা উচিত এই কিশোরকে, উঠছে দাবিও।
এদিনই সকালে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সামাজিক মাধ্যমে মোরসালিমের এই কীর্তির কথা জানিয়ে অভিনন্দন জানান। তিনি লেখেন, ‘মোরসালিম‌কে তার উপস্থিত বুদ্ধি ও সাহসিকতার জন্য কুর্নিশ জানাই।’
শনিবার বিকালে হরিশচন্দ্রপুর বিধানসভা এলাকার এই পুরাতন কোলিয়ারি গ্রামে আসেন সিপিআই(এম) নেতা দেবজ্যোতি সিনহা, আরজাউল হক সহ সিআইটিউ, এসএফআই, ডিওয়াইএফআই নেতৃবৃন্দ। তাঁরা মোরসালিমের বাড়িতে যান, ছোট্ট মোরাসালিমকে ফুলের স্তবক দিয়ে অভিন্দন জানান। তাঁকে একটি স্কুলের ব্যাগও উপহার দেওয়া হয়। সিপিআই(এম) নেতা দেবজ্যোতি সিনহার কথায়, ‘আমরা গ্রামে এসে কুর্নিশ জানাচ্ছি এই কিশোরকে। উপস্থিত বুদ্ধির জেরে ও যা করেছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। গ্রামে এসে শুনছি ওর বন্ধুরাও সঙ্গে ছিল। তাঁদেরও অভিনন্দন। একইসঙ্গে আমরা রেল কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি করছি শুকনো প্রশংসা বার্তা নয়। এরকম একটি কাজের জন্য মোরসালিম সহ তার বন্ধুদেরও পড়াশোনার দায়িত্ব নিক রেল।’ 
প্রতিনিধিদলে এছাড়াও ছিলেন  সিআইটিইউ নেতা মহম্মদ আসলাম, ছাত্রনেতা সইদুল ইসলাম, আখতারুল আলম, দীপঙ্কর ঘোষ, যুবনেতা প্রবীণ চন্দ্র। ছাত্র-যুবদের তরফে সামান্য আর্থিক সাহায্যও তুলে দেওয়া হয় মোরসালিমের হাতে। 
 

Comments :0

Login to leave a comment