প্রবন্ধ — মুক্তধারা, বর্ষ ৩
"মোদের গরব মোদের আশা
আ'মরি বাংলা ভাষা"
আনজু বানু
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন "মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ"
মাতৃদুগ্ধ যেমন প্রতিটি শিশুর শরীর মন মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ করতে প্রতিটি শিশুর জন্য অপরিহার্য।
ঠিক তেমনি মাতৃভাষাও একজন মানুষের জীবনে সাহিত্য সংস্কৃতি ও বিভিন্ন বিষয়ে সাবলীল পদচারণে মনের কথা ব্যক্ত করতে প্রতিটি ভাষাভাষী মানুষের কাছেই নিজস্ব মাতৃভাষা অপরিহার্য।
আজ ১৯শে মে।
২১শে ফেব্রুয়ারির মতই আজকের দিনে নিজের ভাষা, নিজের মায়ের মুখের ভাষা, যে ভাষা একটি শিশু জন্মের পর থেকেই শুনে শুনে শিখে বড় হয়।সেই ভাষা, যে ভাষা একান্ত নিজের ভাষা,সেই ভাষাতে কথা বলা লেখাপড়া ও কাজকর্ম করার দাবিতে আন্দোলন করে ছিনিয়ে নিয়ে তবেই সেই ভাষায় কথা বলতে হয়।
সে নজির গড়েছে একমাত্র বাঙালিরাই।
ভাষার জন্য প্রাণ বলিদান।
পৃথিবীর আর কোন দেশেই বোধহয় এমন ইতিহাস নেই।
আসামের শিলচরের বরাক উপত্যকার মানুষেরা বেশির ভাগই বাংলা ভাষা ভাষী বাঙালি। তাই তাদের দাবি ছিল বাংলা ভাষাকেই সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে আসাম সরকার অসমিয়া ভাষাকে বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দিয়ে অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাবের সূচনা করেন।
আসামের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা এর প্রতিবাদ করতে "কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ" নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। বরাকের জনগণকে সজাগ করতে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা এক দীর্ঘ পদযাত্রার আয়োজন করেন।
সেই পদযাত্রায় অংশ গ্রহণকারী সত্যাগ্রহীরা ২০০মাইল পথ পরিক্রমা করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে বাঙালিদের বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রচার চালিয়ে ছিলেন।
পদযাত্রার শেষ দিনে সংগঠনের মুখ্য পদাধীকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেন। ১৯৬১সালের ১৩ই এপ্রিলের মধ্যে যদি বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা না করা হয়।তাহলে তারা আরও বৃহত্তর হরতাল আন্দোলনে নামবেন।
শিলচরের বরাক উপত্যকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীদের দাবি উপেক্ষা করে অসমিয়া ভাষাকেই সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে বিল পাশ হয়ে যায়।
এর প্রতিবাদে ১৯৬১সালের ১৯শে মে বরাক উপত্যকার সমস্ত অঞ্চলের সত্যাগ্রহী বাঙালিরা রেলওয়ে স্টেশন,আদালত ও সরকারি অফিসের সামনে হরতাল শুরু করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল থেকে ধর্মঘট শুরু হলেও বিকেল ৪টেয় হরতাল ভেঙে ফেলা হবে এমনি ঠিক ছিল।
কিন্তু দুপুর ২,৩০মিনিটে একটি পুলিশের গাড়ি একদল আন্দোলন কারিকে তুলে নিয়ে যায়।পুলিশের গাড়ি অন্য স্টেশনের আন্দোলনকারীদের তুলে নিয়ে আর একটি রেল স্টেশনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওই স্টেশনে অবস্থান রত আন্দোলনকারীরা খবর পেয়ে। তারা পুলিশের গাড়ি আটকে বিক্ষোভ দেখায়।
তখন পুলিশ ও গাড়ির চালক পালিয়ে যায়।
সেই সময় অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
কোন হতাহত ছাড়া দমকল বাহিনী আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে এবং আন্দোলনকারীদের গাড়ি থেকে উদ্ধার করে।
সেই সময় আসাম রেজিমেন্টের একদল পুলিশ বাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালায়।
নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নয়জন সত্যাগ্রহীকে হত্যা করে।আহত হন শতাধিক।পরদিন হাসপাতালে আরও দু'জনের মৃত্যু হয়।
১১জন বাঙালির প্রাণ বলিদানের পর অসম সরকার বাংলাভাষাকেই সরকারী ভাষা হিসেবে শিলমোহর দিতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশ ও আসামের অমর শহিদ বাঙালির রক্তধৌত বাংলাভাষা আমরা আর কতদিন রক্ষা করতে পারব জানি না।
হিন্দির অগ্রাসনে আক্রান্ত আমাদের বাংলাভাষা।
আমরা কী এমনি মৌন চেয়ে থেকে আমাদের মাতৃভাষার শেষ নিঃশ্বাসের অপেক্ষায় দিন গুনে যাব?
Comments :0