KARL MARX

মার্কসও আজকের পৃথিবীতে ‘পুঁজির আদিম লুণ্ঠন’

উত্তর সম্পাদকীয়​

সাত্যকি রায়
মার্কসের পুঁজির ধারণাটি ধ্রুপদী অর্থনীতির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল এবং সে কারণেই আদিম পুঁজি গঠন সম্পর্কে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্ন ছিল। ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের মতে পুঁজির অর্থ ছিল জমিজমা, বাড়ি, টাকা, মেশিন ইত্যাদি যা উৎপাদনের কাজে দীর্ঘমেয়াদি সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় ও ব্যবহৃত হয়—এইসবকেই পুঁজি হিসাবে ধরা যায়। মার্কস প্রথম দেখালেন পুঁজি আসলে একটি সামাজিক সম্পর্ক এবং তা বস্তুর প্রকৃতির উপরে নির্ভরশীল নয়, বরং বস্তুটি কোনও সামাজিক সম্পর্কে অবস্থিত তার উপরে নির্ভরশীল। অর্থাৎ একটি মেশিনকে একটি বিশেষ সামাজিক সম্পর্কে পুঁজি হিসাবে গণ্য করা যায় আবার সেই একই মেশিন বা বাড়ি অথবা জমি অন্য একটি সামাজিক সম্পর্কে পুঁজি নাও হতে পারে। মার্কসের মতে পুঁজির উদ্ভব ঘটে তখনই যখন প্রকৃত উৎপাদককে উৎপাদনের উপকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। এখানেই প্রশ্ন আসে যে তাহলে পুঁজির উৎস কোথায়। অ্যাডাম স্মিথও এই প্রশ্নে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁর পুঁজির প্রাথমিক উৎসের ব্যাখ্যা ছিল মূলত মানুষের চরিত্রের প্রকৃতি নির্ভর। এ প্রসঙ্গে তার মত ছিল যে সমস্ত মানুষ বেশি পরিশ্রম করতে পারে, যারা বুদ্ধিমান এবং অর্থ সঞ্চয় করতে ইচ্ছুক তারাই ভবিষ্যতে পুঁজিপতি হতে পারে। অন্যদিকে যারা কুঁড়ে এবং সঞ্চয়ে অভ্যস্ত নয় তারা পুঁজি জোগাড় করতে পারে না। মার্কস এই ধারণা তীব্র বিরোধিতা করলেন। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগ ও পঞ্চদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের এনক্লোজার মুভমেন্টের বিস্তারিত আলোচনা করে মার্কস ক্যাপিটাল গ্রন্থে দেখালেন কিভাবে পুজির সৃষ্টি হয়েছিল উৎপাদককে বল প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদনের উপকরণ থেকে বিযুক্ত করার মধ্য দিয়ে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে একদিকে যেমন লুণ্ঠিত উপকরণ পুঁজিতে রূপান্তরিত হলো অন্যদিকে উৎপাদনের উপকরণ বা মূলত জমি থেকে বিযুক্ত নিঃস্ব মানুষকে পুঁজিবাদী সমাজের উদীয়মান শিল্পে শ্রম বিক্রিকরতে বাধ্য করা সম্ভব হলো। এই দুটি প্রক্রিয়া যে সমান্তরালভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে চলেছে তা নয়। একদিক থেকে বলতে গেলে এই দুটি প্রক্রিয়ার আলাদা ইতিহাস রয়েছে এবং এই দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যে সময়ের ফারাক ও যথেষ্ট পরিমাণ ছিল। কিন্তু এই দুটি প্রক্রিয়া ইউরোপে পুঁজি সম্পর্কের বিকাশের একটি পূর্বশর্ত রচনা করেছিল। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে আমাদের দেশের ক্ষুদ্র উৎপাদনকে ধ্বংস করা অথবা কৃষককে জমিতে নীল চাষে বাধ্য করা আদিম লুন্ঠনেরই প্রক্রিয়া ছিল। একদিকে এদেশের লুণ্ঠিত পুঁজি ও কাঁচা মাল বৃটেনের শিল্প বিপ্লবে রসদ জুগিয়েছিল। আবার অন্য দিকে ভারতীয় জনগণকে ব্রিটেনে উৎপাদিত পণ্য দ্রব্যের ক্রেতায় পরিণত করা হয়েছিল।
আজকের সময়ে পুঁজিবাদকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কসের আদিম লুণ্ঠনের ধারণাটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। মার্কস আসলে দেখালেন যে শুধু পুঁজিবাদের সৃষ্টি নয়, পুঁজিবাদের নিরন্তর বেঁচে থাকা ও বিকশিত হওয়ার সঙ্গে বল প্রয়োগের একটা গভীর যোগাযোগ রয়েছে। সাধারণত পুঁজিবাদ সম্পর্কে চুক্তি-ভিত্তিক, সমমূল্যের বিনিময়ের উপরগড়ে ওঠা একটি সভ্য জগতের ছবি তুলে ধরা হয়, যেখানে বল প্রয়োগ যেন একেবারেই ব্যতিক্রম বা অস্বাভাবিক। যেখানে বাজারের নিয়ম সবকিছু ঠিক করে দেয়, এবং মূল ধারার অর্থনৈতিক তত্ত্বে বাজারের নিয়মকে ক্ষমতা ও শ্রেণি বিবর্জিত অমোঘ নিয়ম হিসাবে উপস্থিত করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। এই আখ্যানটির রাজনীতি হলো শোষিত মানুষ তাঁদের জীবনে নেমে আসা শোষণ ও বঞ্চনাকে অনিবার্য পরিণাম হিসাবে মেনে নেবে। মার্কস প্রথম দেখালেন পুজি সম্পর্কে ক্ষমতা প্রয়োগের একটি প্রয়োজনীয় কাঠামো সর্বদা ক্রিয়াশীল। শুধু আদিম পুঁজিগঠন নয় পুঁজি সম্পর্কের প্রাচীরটি সতত পরিবর্তনশীল। ওই প্রাচীরের মধ্যে যখনই মুনাফার সঙ্কট দেখা দেয় তখনই পুঁজি বহির্ভূত সম্পর্ককে পুঁজির অধীনে আনার প্রক্রিয়াপুঁজিবাদের ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে। এবং এই কাজ চিরকালই হয়েছে নিয়ম ভেঙে বল প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে। আসলে পুঁজি সম্পর্কের আওতার পুনর্নির্মাণের আরেক নামই হলো পুঁজির আদিম লুণ্ঠন। এই ‘আদিম’ কথাটির অর্থ এটা নয় যে এই লুণ্ঠন শুধুমাত্র পুঁজিবাদের উদ্ভবের সময়কালেই ঘটেছে এবং তার পরে পুঁজিবাদ তার চিহ্নিত গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। আসলে এই গণ্ডির আওতার মধ্যে পুঁজি বহির্ভূত সম্পর্কগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া নিরন্তরভাবে ঘটে চলে। যা কিছু ব্যক্তিগত সম্পত্তির আওতার বাইরে, যা কিছুর উপরে রাষ্ট্রীয় বা কোনও ধরনের সমবেত মালিকানার অস্তিত্ব আছে,  তাকে ক্রমাগত ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করা আসলে পুঁজি সম্পর্কের গণ্ডিরই পুনর্নির্মাণ এবং পুঁজির আদিম লুণ্ঠেনের রূপ মাত্র। এই গণ্ডি যখন বল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রসারিত হয় তখন এই লুট এবং বল প্রয়োগ প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়। কিন্তু যেই ওই চৌহোদ্দির পুনর্নির্মাণ হয়ে যায় তখন অতীতে যা লুট ছিল তা স্বাভাবিক নিয়ম হিসাবে স্বীকৃতি পায়, বল প্রয়োগের ক্ষতগুলি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়। এ কথা ঠিক যে পুঁজিবাদী সম্পর্কের দৈনন্দিন কার্যপ্রণালীতে কোনও সরাসরি বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটে না তা মূলত স্বীকৃত চুক্তির ভিত্তিতেই চলে, কিন্তু মনে রাখতে হবে পুঁজি সম্পর্কের পুনরুৎপাদন প্রতিদিন ঘটে চলেছে প্রকৃত উৎপাদকে উৎপাদনের উপকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার সামাজিক সম্পর্কটির মধ্যে দিয়ে। পুঁজিবাদে শ্রমিক ও গরিব মানুষ উৎপাদনের উপকরণের সমস্ত মালিকানা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে কোনও অমোঘ নিয়মের কারণে নয়। একটাই কারণ— এই মানুষেরা চিরকাল শ্রমশক্তি বিক্রি করেই বেঁচে থাকতে বাধ্য হবে সেই ব্যবস্থাটি কায়েম রাখার সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শগত পরিকাঠামো কার্যকর করা হয়। ফলে প্রকৃত উৎপাদক উৎপাদনের উপকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল শুধুমাত্র পুঁজিবাদের উষাকালে এমনটা নয়, প্রতিদিন শ্রমজীবীদের নিঃস্ব করার মধ্য দিয়েই পুঁজিসম্পর্ক পুনরুৎপাদিত হতে থাকে।  ফলে লুণ্ঠনের প্রক্রিয়া একদিকে ঐতিহাসিক আবার একই সাথে নিরন্তর।
নয়া উদারবাদের যুগে পুঁজির আদিম লুণ্ঠনের প্রক্রিয়াটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। এ কথা ঠিক যে নয়া উদারবাদ বাজারের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ ক্রমাগত সঙ্কুচিত করে। কিন্তু এই বাজার ভিত্তিক সামাজিক ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাষ্ট্র সবচেয়ে সরাসরি ভূমিকা পালন করে থাকে নয়া উদারবাদের যুগে। পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠিত গণ্ডিও নিয়মগুলির মধ্যে থেকে মুনাফার হার যখন ক্রমাগত কমতে থাক, পুঁজি সম্পর্ক বহির্ভূত আর্থিক ব্যবস্থাগুলোর উপরে আধিপত্য স্থাপন করা ও তাকে পুঁজি সম্পর্কের অধীন করে তোলা নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার অন্যতম প্রকরণ হয়ে ওঠে। জল, জঙ্গল, জমি যা কিছু আঞ্চলিক সম্প্রদায়ের সমবেত কর্তৃত্বের অধীন ছিল, অথবা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র যা দেশের সরকারের মালিকানায় ছিল অথবা পেনশন ফান্ড যা শ্রমিক কর্মচারীদের সমবেত মালিকানার অধীন ছিল- এই সমস্ত কিছুকে বাজারের অধীন করা নয়া উদারবাদী যুগে পুঁজির আদিম লুণ্ঠের রূপ। ফিন্যান্স পুঁজির বিনিয়োগ ও মুনাফা করার জন্য এ যুগে নতুন নতুন রাস্তা খোলার অন্যতম পন্থা হলো যা কিছু সমবেত মালিকানার অধীন তাকে ব্যক্তিগত মালিকানায় রূপান্তরিত করা। এর মধ্যে দিয়ে আসলে নতুন অ্যাসেট তৈরি হয় যাতে বিনিয়োগ করে ফাটকা কারবারের পাহাড় গড়ে ওঠে। মনে রাখা দরকার এই ফাটকা কারবারের বাজারে সাধারণ মানুষকেও জোর করে টেনে আনা হয়। শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড এই সমস্ত ক্ষেত্রে রিটার্ন ব্যাঙ্কের তুলনায় বেশি হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষও এই ধরনের বিনিয়োগে অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নানা পরিষেবা ক্রমাগত বিমা ও লোন নির্ভর হয়ে যাওয়ার কারণে যে সমস্ত পরিষেবাগুলি রাষ্ট্র সরবরাহ করত,  সেগুলিও ধীরে ধীরে ফাইনান্সিয়াল মার্কেটের উত্থান পতনের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ এই ধরনের পরিষেবা কিনতে বাধ্য হয়। তারা পুঁজিপতি নয় তাই মুনাফায় অর্জিত টাকা থেকে তারা এইসমস্ত ক্ষেত্রে খরচ করছে তা নয়। বরং মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত অর্থ ও সঞ্চয়ের একটি অংশ ক্রমাগত ফাইনান্সিয়াল সংস্থাগুলির মুনাফার উৎসে পরিণত হচ্ছে। একথাও খেয়াল করা দরকার যে আজকের দিনেও উৎপাদকে উৎপাদনের উপকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য বল প্রয়োগের ঘটনা যেমন দেখতে পাওয়া যায় সেরকম আরেকটি রাস্তা হলো দীর্ঘমেয়াদি সময়ের জন্য একটি উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ক্রমাগত অচল করে তোলা। ভারতবর্ষের কৃষি ক্ষেত্র হচ্ছে তার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সারের দাম, বিদ্যুতের দাম, উৎপাদনের খরচবৃদ্ধি এবং ফসলের ন্যূনতম দামের নিশ্চয়তার অভাব কৃষিকে ক্রমাগত অচল আয়ের পন্থায় পরিণত করছে। এর জন্য কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। শিকড়ছিঁড়ে শহরাঞ্চলে কাজ খোঁজার চেষ্টা করছে কৃষি থেকে বিযুক্ত মানুষ, ক্ষুদ্র জোত ক্রমাগত বিক্রি হয়ে জমি-হাঙ্গরদের কবলে চলে যাচ্ছে। এরকম ভাবার কোনও কারণ নেই কৃষির এই পরিণতি অনিবার্য। পৃথিবীতে এরকম বেশ কিছু উন্নত দেশ রয়েছে, যেমন কানাডা বা হল্যান্ড যাদের জিডিপি’র বেশিরভাগ অংশটাই আসে এগ্রিফুড সিস্টেম অথবা ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে যা সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর। ফলে কৃষির ক্রমাগত একটি অলাভজনক প্রকল্পে রূপান্তরিত হওয়াটা কোনও অনিবার্য পরিণতি নয়। নয়া উদারবাদের সম্প্রতিক পর্যায়ে বিশেষত ২০০৮-০৯ সালের ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিসের পর জমিকে ক্রমাগত একটি ফাইনান্সিয়াল অ্যাসেটে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া পৃথিবী জুড়ে শুরু হয়েছে। তার অংশ হিসাবেই কৃষি থেকে কৃষককে বিযুক্ত করার প্রক্রিয়া দ্রুত কার্যকরী হয়ে চলেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ২০০১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কর্পোরেটদের হাতে স্থানান্তরিত জমির পরিমাণ পশ্চিম ইউরোপের মোট ভৌগোলিক আয়তনের সমান।  ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিসের পর আর্থিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের কাছে জমি একটি নির্ভরযোগ্য অ্যাসেট হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই অ্যাসেট থেকে আয় বৃদ্ধির জন্য কৃষির দ্রুতহারে বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে চলেছে। রাবার, কফি, ইউক্যালিপটাস, কোকো, বায়োফুয়েল, সয়াবিন উৎপাদনের কাজে প্রথাগত খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত জমির রূপান্তর দ্রুত হারে ঘটে চলেছে। অতএব পৃথিবী জুড়ে ব্যাপকহারে সন্তর্পণে উৎপাদনের উপকরণ জীবিকা নির্বাহের উপায় থেকে কর্পোরেট সংস্থাগুলির পুঁজিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের পরিপ্রেক্ষিত যা নিয়ে মার্কস ক্যাপিটালে পুঁজির আদিম লুণ্ঠনের ধারণাটি উপস্থিত করেছিলেন আজকের সময়ের বাস্তবতা তার থেকে গভীরভাবে বদলে গিয়েছে। উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা থেকে উৎখাত হওয়া মানুষ পুঁজিবাদের জন্ম লগ্নে কারখানার শ্রমিকে নিযুক্ত হয়েছিল।  মানুষ যে স্বেচ্ছায় এই আয়ের পন্থা বেছে নিয়েছিল তা নয়। তার কারণ মানুষের সময়ের ধারণা, জীবনচর্যা এসব কিছুই পুঁজি সম্পর্কের বা কারখানা উৎপাদনের নিয়মানুবর্তিতার থেকে শত যোজন দূরে ছিল। উচ্ছেদ হওয়া মানুষকে জোর করে, আইন প্রয়োগ করে কারখানার শ্রমিকে রূপান্তরিত করতে হয়েছিল। মানুষকে নিঃস্বকরণের এই প্রক্রিয়া প্রায় তিনশতক ধরে চলার পর অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে পুঁজিবাদ এক নতুন সমস্যার সম্মুখীন হলো।  মেশিনের ব্যবহারবৃদ্ধির সাথে সাথে শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমতে শুরু করল। পুঁজিবাদ এই সমস্যার সমাধান করেছিল বিপুল সংখ্যক মানুষকে নতুন ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত করে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এই সমস্ত দেশে শ্বেতাঙ্গরা এসে নতুন করে বসতি গড়েছিল। আজকের পৃথিবীতে পুঁজির আদিম লুণ্ঠনের মধ্যে দিয়ে উচ্ছেদ হওয়া মানুষকে শিল্পে নিয়োগ করার সম্ভাবনা আরও কম। পৃথিবীর অন্য ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের সাথে সাথে উৎপাদনে সরাসরি শ্রমের প্রয়োজনীয়তা আরও কমে আসবে। অতএব পুঁজিবাদ তার মুনাফা বৃদ্ধির স্বার্থে আদিম লুণ্ঠনের নানা ধরনের প্রক্রিয়া অবলম্বন করবে আবার একই সাথে এই লুণ্ঠনের মাধ্যমে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের জীবন জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। পুঁজিবাদ ক্রমাগত এই সংঘাতের মুখে পড়বে এবং সমাজকে রূপান্তরিত করার বাস্তব ভিত্তিকে শক্তিশালী করবে। যদিও রূপান্তর কোনও স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া নয়, মানুষের সংগঠিত সচেতন প্রয়াসই এই রূপান্তরের বাস্তবতাকে কার্যকর করতে পারে। সবশেষে এটা মনে রাখা দরকার যে মার্কস সামন্ততন্ত্রের চেয়ে পুঁজিবাদকে একটি প্রগতিশীল ব্যবস্থা বলে মনে করেছিলেন তার মানে এটা নয় যে পুঁজিবাদ তার কাছে একটি কাঙ্ক্ষিত গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা ছিল। তার শেষ বয়সে রাশিয়ার পপুলিস্টদের প্রসঙ্গে পত্রালাপ দেখলে বোঝা যায় যে যেখানে যেখানে মানুষের সমবেত মালিকানার কোন ধরনের ব্যবস্থা বাঁচিয়ে রেখেছিল তাকে ধ্বংস করে পুঁজিবাদে রবিকাশের কথা মার্কস কখনও সঠিক বলে মনে করেননি বরং তাকে পুঁজিবাদ উত্তর সামাজিক অবস্থায় সরাসরি রূপান্তরের পথকে মার্কস যথাযথ মনে করেছিলেন। অতএব আজকের সমাজে যা কিছু সমবেত, সরকারি বা যৌথ মালিকানার অধীন, যা বাজারের নিয়মের বাইরে তাকে রক্ষা করা এবং বিকশিত করার কাজ নয়া উদারবাদের যুগে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের অন্যতম একটি ক্ষেত্র।

Comments :0

Login to leave a comment