নিজস্ব প্রতিনিধি: ডানকুনি, ২৪ ফেব্রুয়ারি– আর জি কর হাসপাতালে নিহত চিকিৎসক-ছাত্রীর বিচারের দাবিতে দ্রোহের উদযাপনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সিপিআই(এম) সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।
ডানকুনিতে পার্টির ২৭তম রাজ্য সম্মেলনে প্রতিনিধিদের আলোচনায় এই প্রত্যয় উচ্চারিত হয়েছে। সম্মেলন শুরু হয়েছে শনিবার। পার্টির সম্মেলনে বিগত কাজের পর্যালোচনার ভিত্তিতে আগামীদিনের দায়িত্ব, কর্তব্য নির্ধারিত হয়। স্বভাবতই সম্মেলনে আর জি কর হাসপাতালের নৃশংসতার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের কথা উঠে এসেছে।
উদ্বোধনী ভাষণে আর জি কর হাসপাতালের সেই ঘটনার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনে পার্টির ভূমিকার প্রশংসা করেছিলেন পার্টির কো-অর্ডিনেটর প্রকাশ কারাত। রাজনৈতিক সাংগঠনিক খসড়া প্রতিবেদন সেদিনই পেশ হয়েছিল। সেই খসড়া প্রতিবেদনের উপর আলোচনা শুরু হয়েছে সেদিনই। গ্রাম কিংবা শহর, এলাকা যেমনই হোক, প্রত্যেক ভূখণ্ডেই মানুষের মধ্যে আর জি কর হাসপাতালের নৃশংস ঘটনার প্রভাব স্পষ্ট, তা প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে।
পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সোমবার এই প্রসঙ্গে বলেছেন, আমরা সেই আন্দোলনকে প্রসারিত করার চেষ্টা করেছি। একদিকে ‘অভয়া মঞ্চ’ গড়ে উঠেছিল। অন্যদিকে বামফ্রন্ট সহ বিভিন্ন গণসংগঠনের মাধ্যমে আন্দোলন। বিভিন্ন মাত্রায় সেই আন্দোলনকে নিয়ে গেছি। ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতায় ঐতিহাসিক মিছিল হয়েছিল। ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল এগিয়েছে। পথের দু’পাশে স্বতঃস্ফূর্ত মানুষ। রাসবিহারী মোড় থেকে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস পর্যন্ত মিছিলে বিমান বসুও অংশ নেন। বিভিন্ন জেলায় সেই আন্দোলন হয়েছে। খেতমজুর, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষকদের সহ বিভিন্ন অংশের গণসংগঠন সেই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন যেভাবে তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে পাড়ের দিকে। সেই ইস্যু এখনও বিরাজমান। জোর করে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তৃণমূল-বিজেপি’র যে বোঝাপড়ার কথা আমরা বলে থাকি, তা এই ঘটনার মাধ্যমে অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে।
রাজ্য সম্পাদক এই পর্যালোচনা তুলে ধরার আগে প্রতিনিধিদের আলোচনায় উচ্চারিত হয়েছে আর জি কর হাসপাতালের নৃশংস ঘটনার বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়া দ্রোহের নানা অভিজ্ঞতা, তার বিশ্লেষণ।
একজন প্রতিনিধি বলেছেন, ‘‘এমন অংশের মানুষকে আমাদের জেলায় আমরা আর জি কর হাসপাতালের ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে, ‘রাত দখল'-এ দেখেছি, তাঁদের এর আগে কখনও কোনও আন্দোলনে দেখিনি। এ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা।”
মিছিলে আসেননি, কিন্তু পথের পাশে দাঁড়িয়ে সমর্থন জানানো মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা গিয়েছে, তাও প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে। এই আন্দোলন আর জি কর হাসপাতালের নৃশংসতার বিরুদ্ধে বটেই, পাশাপাশি এই আন্দোলনের মধ্যে রাজ্যের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। এমন মতই খসড়া প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিনিধিদের আর একজন বলেছেন, “এই আন্দোলনে এমন অংশকেও দেখা গেছে, যাঁরা নানা কারণে অংশ নেননি। কিন্তু তাঁদের সহমর্মিতা ছিল আন্দোলনের পাশে। আবার বিরোধীদের একটি প্রচার ছিল যে, এই আন্দোলন মূলত শহরের ধনী, মধ্যবিত্তদের। নানাভাবে, নানা অংশ এই আন্দোলনকে ভাঙার চেষ্টাও দেখা গেছে। এই সব চক্রান্তের বিরুদ্ধেও আমাদের লড়তে হয়েছে।” সংখ্যালঘু প্রধান একটি জেলার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ‘‘গ্রামাঞ্চলগুলিতেও যেভাবে মহিলারা বেরিয়ে এসেছিলেন প্রতিবাদে, তা নিঃসন্দেহে আমাদের কাছে একটি শিক্ষা। আসলে তৃণমূলের দুর্নীতি, থ্রেট কালচারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ওই আন্দোলনে প্রকাশিত হয়েছে।”
কয়েকটি জেলার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন যে, এই আন্দোলনের চরিত্র প্রাথমিকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত। তবে এই আন্দোলনেই বিভিন্ন এলাকায় এমন মানুষকে সংগঠক, স্বাভাবিক নেতা হিসাবে দেখা গিয়েছে, যাঁরা নির্দিষ্টভাবে কোনও রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী নন। এই আন্দোলনে এমন অনেক গান, কবিতা, গ্রাফিতির ব্যবহার দেখা গিয়েছে, যা আসলে বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাকেই ফের সামনে এনে হাজির করেছে। উত্তরবঙ্গের এক প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ‘‘আর জি কর হাসপাতালের ঘটনায় যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তাতে আমাদের কর্মী, নেতারা অংশ নিয়েছেন। কিন্তু আমরা থেকেছি আন্দোলনের মধ্যে। সামনে গিয়ে দাঁড়াইনি। আর তৃণমূল যখন ভয় দেখিয়ে সেই আন্দোলনকে ভাঙতে চেয়েছে, মানুষ নিজের অভিজ্ঞতায় থ্রেট কালচারের সরাসরি মুখোমুখি হয়েছেন।”
এই আন্দোলনের চরিত্র কী?
সম্মেলনে তা নিয়েও আলোচনা উঠে এসেছে। প্রথমত, এই আন্দোলনে মহিলা এবং তরুণ প্রজন্মের বিপুল অংশগ্রহণ ঘটেছে। দ্বিতীয়ত, যাকে গণআন্দোলন বোঝায়, সেই অর্থে এই আন্দোলন প্রকৃত অর্থেই একটি গণআন্দোলন। তৃতীয়ত, এই আন্দোলনে সমাজের ঘাড়ে চেপে থাকা দীর্ঘদিনের পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে। চতুর্থত, তৃণমূল এবং বিজেপি লাগাতার চেষ্টা করেছে এই আন্দোলনকে ভুল পথে চালিত করতে অথবা ভাঙতে।
খসড়া প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ‘‘প্রতিবাদী এই গণ আন্দোলনে রাজনৈতিক দলের পতাকা বা প্রকাশ্য ঘোষণা অনুপস্থিত থাকলেও আন্দোলনে বৃহত্তর রাজনৈতিক আবেদন ও আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই রয়েছে।… ন্যায় বিচারের দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ সময়ের অভিজ্ঞতায় ক্রমশ উপলব্ধি করেছে তার প্রতিপক্ষ হিসাবে সরকার, শাসক দল এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি হাজির হয়েছে। ফলে আন্দোলনকারীদের স্পষ্ট রাজনৈতিক ঘোষণা না থাকলেও এই আন্দোলন উচ্চমাত্রার রাজনৈতিক গুণ ও উপাদান সম্পন্ন।”
এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যই প্রতিনিধিদের আলোচনায় উচ্চারিত হয়েছে।
Comments :0