Editorial

শ্রমিকের ধন চুরি!

সম্পাদকীয় বিভাগ

রবি ঠাকুর লিখেছিলেন ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’। বাস্তবিকই এখন এরাজ্যের নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণের টাকা রাজহস্তেই চুরি হয়ে যাচ্ছে। যে রাজ্য সরকারের দায়িত্ব ছিল নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ খাতে সংগৃহীত সেস বাবদ অর্থ শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করা, তারাই সেই অর্থ গায়েব করে দিয়ে মেলা খেলা উৎসবে খরচ করছে। এই অর্থ নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণের নির্দিষ্ট খাতে খরচ করার উদ্দেশ্যেই সংগৃহীত, এক্ষেত্রে শ্রমিক কল্যাণের জন্য বরাদ্দ সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। তবুও রাজ্য সরকার খাত ঘুরিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপব্যয় করেছে। শ্রমিকদের বঞ্চনা করে তাঁদের জন্য সংগৃহীত অর্থ অন্য খাতে সরকারের খরচ করাটা আসলে শ্রমিকের ধন চুরি, এর চেয়ে কম রূঢ় কোনও শব্দই সরকারের অপরাধকে চিহ্নিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। 
ঠিকাদারদের অধীনে কর্মরত নির্মাণ শ্রমিকদের জীবনের দুর্দশার কথা, তাঁদের জীবনের ঝুঁকি, তাঁদের পরিবারের স্বাস্থ্য শিক্ষার সুযোগহীনতা ইত্যাদি সর্বজনবিদিত। ঠিকাদার যাদের সামান্য মজুরি দিয়েই খালাস, বাকি কোনও দায়িত্ব নেয় না, তাঁদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই বামফ্রন্ট সরকার শ্রম দপ্তরের অধীনে ওয়েস্ট বেঙ্গল বিল্ডিং অ্যান্ড আদার কনস্ট্রাকশান ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড তৈরি করেছিল বিধানসভায় আইন পাশ করিয়ে। সেই আইন অনুসারে রাজ্যে প্রতিটি নির্মাণ কাজে ঠিকাদার সংস্থার কাছ থেকে সেস বাবদ অর্থসংগ্রহ করে নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ খাতে জমা পড়ার কথা এবং এই অর্থে শ্রমিকদের নানা সুরক্ষা প্রকল্প চালানোর কথা সরকারের। কিন্তু তৃণমূল সরকার আসার পরে সেই আইনে অদলবদল করা হয়েছে, শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা তলানিতে চলে গেছে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে কোটি কোটি টাকা খরচে গড়ে ওঠা আবাসন প্রকল্পের ঠিকাদার প্রোমোটাররা সেস দেওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে, স্রেফ শাসকদলকে খুশি রাখলেই তারা ছাড় পাচ্ছে। একমাত্র সরকারি প্রকল্প ও রেল মন্ত্রকের প্রকল্পগুলি থেকে সেস আদায় হচ্ছে। এরাজ্যের নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণের জন্য নির্মীয়মাণ আবাসন থেকে সেস বাবদ আদায় হয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে ২ হাজার ২১১ কোটি টাকা খাত পরিবর্তন করে সরিয়ে নিয়েছে মমতা ব্যানার্জির সরকার! আর শ্রমিকদের জন্য খরচ করেছে মাত্র ১১০ কোটি টাকা। এই সামাজিক সুরক্ষার জন্য শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার চালিয়ে তাঁদের নাম নথিভুক্ত করতে বলা হয়েছিল। ৩২ লক্ষ নির্মাণ শ্রমিক নাম নথিভুক্তও করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা কী পেয়েছেন? প্রাপ্য তো দূরের কথা, শ্রমিক পিছু সামাজিক সুরক্ষায় সংগৃহীত তহবিল থেকে মাত্র ৩ টাকা ৪১ পয়সা খরচ করেছে নবান্ন। অন্যদিকে ২হাজার ২১১ কোটি টাকা শ্রমিকদের তহবিল থেকে থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে রাজ্য সরকার নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করেছে।
অর্থনীতিতে অআকখ জানা ব্যক্তিরাও সরকারের এই আচরণকে আর্থিক বিশৃঙ্খলা বলে মানবেন। বাজেট যেমন সরকারের সামগ্রিক পরিকল্পিত পদক্ষেপের রূপায়ণকে নিশ্চিত করতে পথ বেঁধে দেয়, তেমনই সেসের টাকায় পুষ্ট শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের অর্থ কেবল ঘোষিত শ্রমিক কল্যাণেই খরচ করা যায়। অন্যকিছুতে খরচ করাটা আর্থিক নিয়মানুগ নয়। কিন্তু যে সরকার এমনিতেই আর্থিক বিশৃঙ্খলায় ভুগছে, আয়ের সংস্থান করতে না পেরেও যুক্তিহীন দেদার খরচ করছে, তারা সেই অবিমৃশ্যকারী খরচ জোগানোর জন্যই শ্রমিকের ধন চুরি করছে। আর্থিক প্রশাসনিক বিধিভঙ্গের অপরাধ আড়াল করার জন্য রাজ্য সরকারের মন্ত্রীরা কখনোই কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে না পেরে মমতা ব্যানার্জি রাজ্যবাসীকে কতরকম অর্থ সাহায্য করছেন তার ঢালাও প্রচার করে থাকেন। সরকারের টাকা জনগণেরই টাকা, সেটা খরচের মধ্যেও তৃণমূল তাদের জমিদারি ঠাঁট বজায় রেখেছে। অধিকারবোধ সম্পন্ন নাগরিকদের তারা দেখতে চায় না, কেবল অনুগত প্রজা দেখতে চায়। তাই নির্মাণ শ্রমিকদেরও অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখে।

Comments :0

Login to leave a comment