UK Election

ইউরোপের দেশে দেশে অতি দক্ষিণপন্থার উত্থানের মাঝে স্বস্তি লেবারের জয়ে

আন্তর্জাতিক

সৌম্যজিৎ পাল: কভেন্ট্রি
ব্রিটেনের নির্বাচনে আমাদের মতো বর্ণাঢ্য প্রচার হয় না। জয়েও সমর্থকদের আবির মেখে, ঢোল-নাগাড়া নিয়ে উচ্ছ্বাস নেই। ভোট সেই অর্থে প্রাণহীন। তবে এবারের নির্বাচন নিয়ে ব্রিটেনে উত্তেজনা তো ছিলই। কলেজ ইউনিয়ন, কারখানাগুলির ইউনিয়ন, সিটি সেন্টারগুলোতে ট্যাবলো এনে প্রচার চলেছে। যেখানে চল্লিশ-পঞ্চাশ জনের বেশি জড়ো হয় না— এইরকমই প্রচারের কায়দা। ইউনিয়নগুলির প্রচারে হয়তো কিছু বেশি লোক হয়। বাড়ি বাড়ি প্রচার শহরাঞ্চলে বিশেষ চোখে পড়ে না। কাউন্টি সাইডগুলোতে কিছুটা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করে রাজনৈতিক দলগুলি। যদিও ঋষি সুনক ও বিদায়ী সরকারের আরও কেউ কেউ এবার বাড়ি বাড়ি প্রচারে গিয়েছেন। ভোটার স্লিপ এসেছে ডাক মারফত। আগে থেকে নথিভুক্ত করলে যে কেউ পোস্টাল ব্যালটেও ভোট দিতে পারেন। সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ভোট দেওয়া যায়। ফলে কাজ ফেলে রেখে ভোট দিতে যেতে হবে এমন নয়, অফিস থেকে ফিরে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরেও দিব্য ভোট দেওয়া যায়। তবে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা আছে বাসিন্দাদের। মাত্র ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে। 
বাইরে থেকে মনে হয়, ব্রিটেনে বোধ হয় লেবার আর কনজারভেটিভদের মধ্যেই ভোট। বিষয়টি কিন্তু এত সরল নয়। উত্তর আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস আর ইংল্যান্ড নিয়ে ভোট। স্কটল্যান্ডে এতদিন জিততো স্কটল্যান্ড ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এসএনপি)। নর্দান আয়ারল্যান্ডেও এইরকম প্রগ্রেসিভ ইউনিয়নিস্ট পার্টি (পিইউপি) নামে একটি দল শক্তিশালী। এসএনপি এবারে বড় ধাক্কা খেয়েছে। 
সরকার বিরোধিতা এই নির্বাচনে বিপুলভাবে কাজ করেছে সেটা তো স্পষ্ট হয়েই গিয়েছে। ব্রেক্সিটের পরে কোভিড, ব্রিটেনের অর্থনীতিকে যে ধাক্কা দেয় তার ফলে মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া জায়গায় পৌঁছেছে। গ্যাসের দাম, বিদ্যুতের দাম মারাত্মক হারে বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতিতে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। নির্বাচনী ইশ্‌তেহারে লেবার পার্টি বলেছে, গ্যাস এজেন্সিকে ‘সেন্ট্রালাইজড’ করবে। সোলার, উইন্ড মিল ইত্যাদির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলেছে। রাশিয়ার মতো অন্য দেশের উপরে নির্ভরশীলতা কমিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাকে ঘিরে কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। এর সঙ্গে আছে স্বাস্থ্য পরিষেবা। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বা এনএইচএস ভেঙে পড়া কনজারভেটিভদের বিরুদ্ধে গিয়েছে। এখানের সব ধরনের মানুষের কাছেই সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে গলব্লাডার অপারেশন করার মতো সাধারণ চিকিৎসার জন্যেও দুই বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। যা গরিব বা নিম্নবিত্তদের ক্ষেত্রে বিপর্যয়কর হয়ে উঠেছে। যারা বেসরকারি চিকিৎসা পরিষেবা বহন করতে পারেন না, সেই অধিকাংশ অংশের কাছেই এনএইচএস জরুরি। এই অবস্থার পরিবর্তন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল লেবার পার্টি। দীর্ঘ ১৪ বছর সরকার চালানোর পরে এই সব বিষয় নিয়ে কোনও যুৎসই জবাব দিতে পারছিলেন না কনজারভেটিভরা। ১৫ লক্ষ নতুন বাড়ি তৈরি করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে লেবাররা। সরকারি বাস সেন্ট্রালাইজড করার কথাও বলা হয়েছে। এইরকম অনেক কথা বলেছে, যা নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের কাছে বিশ্বস্ত হয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে কিয়ের স্টার্মারকে নিয়ে ভোটাররা বিশেষ আগ্রহী ছিলেন এমন নয়। সেই ক্ষেত্রে বলা যায়, ব্যক্তি বা মুখ হিসাবে স্টার্মারের বিরাট কিছু ভূমিকা নেই এই জয়ের পিছনে। স্টার্মার দলের মধ্যে ‘বামপন্থী’ বলে পরিচিতদের কোণঠাসা করেছেন। করবিন, ডাইয়েন অ্যাবট প্রমুখদের সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে অ্যাবট সহ অনেকেই ফিরলেও করবিনকে ফিরতে দেননি স্টার্মার। তারপরেও লেবারদের নীতিতে একটা মধ্যপন্থা থাকায় সবটাই নিজের মতো করতে পারেননি স্টার্মার। 
অন্যদিকে, নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বাধীন অতি দক্ষিণপন্থী রিফর্ম ইউকে পার্টি এবারে কনজারভেটিভদের ভোট কেটে নিয়েছে বলেই প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। কনজারভেটিভদের ‘কোর’ ভোটারদের অনেকেই এবার রিফর্মকে দিয়েছে। ফারাজ নিজেও এই বার প্রথম সাংসদ হিসাবে জয়ী হলেন, আট বারের চেষ্টায়। তাঁর দলের আরও চার জন সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। গোটা ইউরোপজুড়ে অতি দক্ষিণপন্থার বাড়বাড়ন্তের সময়ে ব্রিটেনে লেবার পার্টির জয় যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনই সংখ্যায় কম হলেও রিফর্মদের এই সাফল্যও ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। ৭১টি আসন পেয়েছে লিবেরাল ডেমোক্র্যাট পার্টি। গতবারের তুলনায় বিপুল বৃদ্ধি হয়েছে তাদের। 
অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়টি এখানের ভোটের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তালিবানদের ফিরে আসা, ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্য প্রাচ্যে অস্থিরতা— সব মিলিয়ে অবৈধভাবে আসা শরণার্থীদের সংখ্যা বিপুল বৃদ্ধি পেয়েছে। যা ব্রিটেনের সঙ্কটে থাকা অর্থনীতির উপরে আরও চাপ তৈরি করেছে বলে জোরদার প্রচার আছে। এটাও কনজারভেটিভদের বিরুদ্ধে গেছে। এই অবস্থায় অভিবাসন নীতি ঘোষণা করে কনজারভেটিভ সরকার বলে, অবৈধ অভিবাসীদের রায়ান্ডায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তার জন্য যে বিপুল খরচ ব্রিটেনের কোষাগার থেকে হবে, তার সংস্থান কোথা থেকে হবে, সেই উত্তর দিতে পারেননি সুনক। বিপরীতে লেবাররা বলেছেন, তারা সীমানা সুরক্ষিত করবে, যাতে আর কোনোভাবেই অবৈধ অভিবাসীরা ঢুকতে না পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে আলোচনার মাধ্যমে অভিভাসী সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হবে। 
এশীয় এবং দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে সমর্থন প্রাপ্তির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন সুনক। ভোটের দুই দিন আগে পর্যন্ত মন্দিরেও ঘুরেছেন মোদীর ‘বন্ধু’। কিন্তু ঋষি সুনক বিষয় নন, কনজারভেটিভদের বিরুদ্ধেই এবার ভোট দেওয়ার বিষয়ে মনস্থির করে ফেলে ব্রিটেনবাসী। গাজার উপরে ইজরায়েলের আগ্রাসনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে অনেক জায়গায়। ভারত ছাড়া পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তুরস্ক, সিরিয়া সহ মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবং পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যাই এখানে বেশি। নানা কারণে এঁরা ইজরায়েল বিরোধী। গাজায় ইজরায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে লন্ডন সহ ব্রিটেনের নানা জায়গায় বিশাল বিশাল প্রতিবাদ মিছিল-সভাও হয়েছে। বৈধ অভিভাসীদের অধিকাংশ ভোট গিয়েছে কনজারভেটিভদের বিরুদ্ধেই। লেবার পার্টি থেকে বহিষ্কৃত যুদ্ধবিরোধী ও বামপন্থী হিসাবে পরিচিত জেরেমি করবিন ইজরায়েলের বিরুদ্ধে, গাজার পক্ষে সরাসরি দাঁড়িয়ে ভোট চেয়েছিলেন। লেবার-ঝড়েও করবিন জয়ী হয়েছেন লেবার প্রার্থীকে হারিয়ে। 
ইউরোপে অতি-দক্ষিণপন্থার রমরমা দেখা যাচ্ছে। ইতালিতে মুসোলিনির দলের আবার উত্থান হচ্ছে, ফ্রান্সে অতি দক্ষিণপন্থীরা প্রথম দফার ভোটে এগিয়ে আছে। সেই সময়ে মধ্য-বাম বলে ঘোষিত লেবার পার্টির বিপুল জয় ব্রিটেনবাসীর জন্য স্বস্তির। বিশেষ করে রিফর্ম ইউকে-র মারাত্মক প্রতিক্রিয়াশীল প্রচারের পরেও লেবারদের ঐতিহাসিক জয় অতি-দক্ষিণপন্থার বিপদকেও এখানে আপাতত ঠেকালো বলা যায়।  

Comments :0

Login to leave a comment