সঞ্চারী চট্টোপাধ্যায়
বিহারে ভোট শুরুর দিনই একাধিক ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত স্বঘোষিত ধর্মগুরু আসারাম বাপুকে ফের অন্তর্বর্তী জামিন দিয়ে দেওয়া হলো। অসুস্থতার দোহাই দিয়ে গুজরাট হাইকোর্ট আসারাম বাপুকে সাত-দশ দিন নয়, ছ’মাস জেলের বাইরে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। নাবালিকা থেকে তরুণী, তথাকথিত ‘শিষ্যা’, ‘ভক্ত’দের ধর্ষণ, শ্লীলতাহানিতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এই স্বঘোষিত ধর্মগুরু প্রায়শই জামিন পেয়ে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু বিনা বিচারে বছরের পর বছর ফাটকের ওপারে থাকতে হয় শারজিল ইমাম, উমর খালিদ, নাফিসা ফতিমা, মীরান হায়দরদের। সরকারের ভাষায়, তাঁরা ‘বুদ্ধিজীবী সন্ত্রাসবাদী’।
ধর্মের মোহজালে সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে ধর্ষণ-শ্লীলতাহানি সহ বিভিন্ন রকমের শারীরিক হেনস্তায় পটু ওই স্বঘোষিত ধর্মগুরুরা মোদী-রাজে এভাবেই ছাড়া পেয়ে যায় বারবার। রাম রহিমের উদাহরণও জ্বলজ্বল করছে। সে-ও দুই সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণের অপরাধে কারাবাসের সাজা পেয়েছিল। কিন্তু ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন ভি হ্যায়’। স্বামী চিন্ময়ানন্দ সহ এরকম ভেকধারী সাধু-সন্ন্যাসীরা একজন মহিলার সম্ভ্রম, সম্মান নিয়ে ছেলেখেলা করে জেলে গেলেও জেলজীবনের যন্ত্রণা তাদের ভোগ করতে হয় না। অন্তত দশ-পনেরো-কুড়ি বার প্যারোলে ছাড়া পেয়ে যায় তারা। আর যে ক’দিন জেলে থাকে, সে ক’দিনও রাজকীয় ‘ট্রিটমেন্ট’ পায়।
যশবন্ত নাই, গোবিন্দভাই নাই, শৈলেশ ভাট, রাধেশ্যাম শাহ, বিপিনচন্দ্র জোশী, কেশরভাই বোহানিয়া, প্রদীপ মোর্ধিয়া, বাকাভাই বোহানিয়া, রাজুভাই সোনি, মীতেশ ভাট এবং রমেশ চন্দনা— নামগুলো মনে আছে আপনাদের? ২০০২ গুজরাট গণহত্যার সময় দাহোদের এক গ্রামে এদের হাতেই আক্রান্ত হয়েছিল বিলকিস বানোর পরিবার। সশস্ত্র আততায়ীরা বানোর পরিবারের ১৪ জনকে খুন করে। তিন বছরের শিশু সালেহা ছিল বিলকিসের কোলে। কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মায়ের সামনেই পাথরে আছাড় মেরে হত্যা করা হয় তাকে। বিলকিসের মা, শাশুড়িকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ২১ বছরের বিলকিস তখন অন্তঃসত্ত্বা। ১১ জন মিলে পর পর তাঁকে ধর্ষণ করে। আরও আট জন মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। তাঁদের মধ্যে একজন মারা যান। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী তখন নরেন্দ্র মোদী।
বিলকিস বানোকে কি আমাদের দিনান্তে একবারও মনে পড়ে? যশবন্তরা ওঁর ধর্ষক। শুধু ধর্ষক নয়, খুনিও। কেমন বিচার হয়েছে যেন ওদের?
সেবার (২০২২ সাল) স্বাধীনতার ৭৫ বছর। সেজেগুজে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ক্যামেরা ‘সেট’ করে লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভাষণ দিলেন। মেয়েদের কথা বিশেষভাবে উঠে এসেছিল তাঁর বক্তৃতায়। ভক্তকূলের ঘোর কাটার আগেই ঝটকা দিয়ে সেদিনই গুজরাটের বিজেপি সরকার বেকসুর খালাস করে দিয়েছিল বিলকিস বানোর ধর্ষকদের। মুক্তির নির্দেশ অনুমোদনে সই ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। মোদীর সর্বাঙ্গীন দোসর অমিত শাহের মন্ত্রক। জেল থেকে ওই ১১ জন ধর্ষক বেরনোর পর প্রধানমন্ত্রীর ‘হোমটাউন’ গুজরাটে যখন তাদের মালা পরিয়ে বীরের সম্মান দেওয়া হচ্ছে, তখন প্রধানমন্ত্রীর ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লালকেল্লা থেকে ভাষণের সেই কথা কি কারো কানে বাজছিল? নির্লজ্জতার চরমে পৌঁছে তিনি বলেছিলেন সেদিন, ‘আমাদের প্রতিদিনের জীবনে আমরা কি মহিলাদের প্রতি নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারি না?’ বিজেপি সরকার নিজেদের ক্ষমতা বলে এবং অবশ্যই মহিলাদের প্রতি তাদের নিম্ন দৃষ্টিভঙ্গির আরও এক জীবন্ত প্রমাণ দিয়ে ধর্ষকদের ছেড়ে দেয়। ধর্ষকদের একজনকে পরে সরকারি মঞ্চেও দেখা গিয়েছিল। আর বিলকিস জুতোর শুকতলা খুইয়ে আদালতে ঘুরেছেন দিনের পর দিন ধর্ষকদের ফের জেলের ঘানি টানাতে।
প্রশাসনের মদতে যখন ফ্যাসিবাদ এবং পৌরুষের আস্ফালন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তখন কার কাছে কোথায় গিয়ে বিচার চাইবেন মেয়েরা? নয়া ফ্যাসিবাদী রাজত্বে মেয়েদের উপর শারীরিক নির্যাতন এবং দোষীদের বেকসুর করে দেওয়ার এমন নানা ‘নজির’ তৈরি হয়েছে। ধর্ষণ-শ্লীলতাহানি সহ মহিলাদের উপর যাবতীয় শারীরিক নির্যাতন আইন অনুযায়ী অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্তদের লোক দেখিয়ে জেলে ভরে দেওয়া হলেও, এমনভাবেই পরে মুক্ত করে দেওয়া হয় যে, কষ্ট হলেও সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হন, মেয়েদের শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়া হলেও তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ নয়। আর ঠিক তাই, মেয়েদের পোশাককে দায়ী করা হয় ধর্ষণের জন্য বারবার। ফতোয়া জারি হয়, মেয়েরা রাত আটটার পর বাইরে বেরবে না, নাইট ডিউটি করবে না, সেজন্য আবার বিল আনার চেষ্টা হয়— দেশে, রাজ্যে ফ্যাসিবাদী কায়দায়। এসবের বিরুদ্ধে মেয়েদের চোখে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে, অপমানে-অসম্মানে শারীরিক ভাবে নির্যাতিত না হওয়া মেয়েদেরও প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে মানসিকভাবে একটু একটু করে ভেঙে পড়তে হয়।
একটা হাথরস, একটা উন্নাও, একটা দিল্লি, একটা কলকাতা দেশজুড়ে আলোড়ন ফেলে দেয়। কেউ হয়ে ওঠেন নির্ভয়া, কেউ অভয়া-তিলোত্তমা। মোমবাতি মিছিলে হাঁটি আপনি-আমি। স্লোগানে স্লোগানে আকাশ মুখরিত করে তুলি। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসক সুচারু কায়দায় সেই বিক্ষোভের স্ফুলিঙ্গকে ধীরে ধীরে নিভিয়ে দেয়। যেটকু আগুনের ফুলকি এদিক-ওদিক পড়ে থাকে, সেটুকু পুরুষতন্ত্রের পদলেহনে পিষে মরে। নিজেদের পেট চালানোই যেখানে কষ্টসাধ্য, সেখানে মেয়েদের সুরক্ষা-নিরাপত্তা-সম্মান-সম্ভ্রম নিয়ে রোজ-রোজ পথে নামা, আওয়াজ তোলা তো বিলাসিতা! এরই মধ্যে উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, ওডিশা, ত্রিপুরা, বিহার, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে-গ্রামে মেয়েদের ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া যায়। দলবেঁধে উল্লাস করতে করতে ছোট-ছোট শিশুদের শরীরের উপরও অকল্পনীয় অত্যাচার চালিয়ে খুন করে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় গাছে।
মাসকতক আগের ঘটনা। আদিত্যনাথের রাজ্য বাদাউঁতে গাছে পুতুল ঝুলছে ভেবে সামনে এগিয়ে গিয়ে মাসি দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর বোনঝির দেহ। দিদি বাড়ি নেই বলে বোনঝির দেখাশোনা করতে এসেছিলেন তিনি। এভাবেই খালের জলে, চাষের খেতে আকছার মেয়েদের দেহ পাওয়া যায়। শুধু গ্রাম নয়, শহর-শহরতলির আনাচে-কানাচে রোজ মেয়েদের শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ হয়ে চলেছে। ক’টা খবর সামনে আসে? ক’টা অভিযোগ পুলিশ নেয়? ক’টা ঘটনায় বিচার পায় মেয়েরা?
আমাদের রাজ্যেও আমরা দেখেছি, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলি সম্পর্কে তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রী, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া। কখনও মমতা ব্যানার্জি বলেছেন ‘লাভ অ্যাফেয়ার্স’, কখনও বলেছেন প্রতিবাদীরা ‘মাওবাদী’ নয়তো ‘ছোট ঘটনা।’ নারী নির্যাতনের ঘটনায় রাজ্যে শাস্তি পাওয়ার হার খুবই কম।
জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা যখন কেড়ে নিয়েছিলেন মোদী-শাহ, তখন বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা মজা করে প্রায়ই বলতেন, এবার যে কেউ কাশ্মীরি মেয়েদের বিয়ে করতে পারবে। নিজেদের ঘনিষ্ঠ আসরে নয়, একথা তাঁরা বলতেন প্রকাশ্যে। আমার-আপনার বহু চেনা মানুষ সেই মন্তব্যে হেসেছে, মজা পেয়েছে। এভাবেই খুব সুক্ষ্মভাবে মেয়েদের পণ্যসম করে দেওয়া হয়েছে আবার। সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার সঙ্গে লড়াই করে, বলা ভালো রীতিমতো যুদ্ধ করে মেয়েরা পরিবারের বোঝা থেকে নিজেদের উত্তীর্ণ করে যে জায়গা অর্জন করেছেন এত বছর ধরে, মনুবাদী সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে এনে আবারও মেয়েদের সেই যুদ্ধের ময়দানেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। প্রচারসর্বস্ব ঢক্কানিনাদের মুখোশের আবডালে এসব হয়েই চলেছে। তাই ধর্ষণ সাজানো ঘটনা, ছোট ঘটনা বলা যেমন খুব সহজ হয়ে গিয়েছে, তেমনই দেশজুড়ে এই বাতাবরণ ছড়িয়ে দেওয়াও সম্ভব হয়েছে যে, মেয়েদের সঙ্গে যা খুশি কদর্য আচরণ করাই যায়। এটাই ‘নিউ নর্ম্যাল’।
অ্যাসিড হামলা, গার্হস্থ্য হিংসা সব ধরনের অত্যাচারের রেখচিত্রই দেশে গত কয়েকবছর ধরে উর্ধ্বমুখী। মহিলা-সুরক্ষা শব্দবন্ধটিই বিপন্ন হয়ে গিয়েছে। মোদীর নেতৃত্বে জাতপাতের বিভাজন, সাম্প্রদায়িক উসকানির জেরেও মহিলাদের ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়। এনসিআরবি’র সাম্প্রতিক রিপোর্টও দেখিয়েছে, কীভাবে পরপর বছরে নির্যাতন বেড়েছে মহিলাদের উপর। প্রতি এক লক্ষ মহিলা জনসংখ্যায় ৬৬.২% ঘটনার উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। এসব মামলায় সামগ্রিক চার্জশিট দাখিলের হার ৭৭.৬%। বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশ নারী নির্যাতনের শীর্ষে। ওডিশায় বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বেড়েছে ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি। এরকমই যে রাজ্যগুলিতে বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে, সেখানে ধর্ষণ-শ্লীলতাহানি রোজনামচা হয়ে গেলেও একটি ক্ষেত্রেও কড়া শাস্তি হয় না অভিযুক্তদের। উলটে জম্মুর কাঠুয়ায় আট বছরের ছোট্ট মেয়েটিকে সাত দিন ধরে ধর্ষণের দায় ধৃতদের ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে মিছিলে হেঁটেছিলেন বিজেপি নেতারা। হাথরসে দলিত তরুণীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা তথাকথিত উচ্চবর্ণের যুবকদের বাঁচাতে নির্যাতিতার চিকিৎসায় গাফিলতি করে প্রমাণ লোপাট করা হয়। পরে নির্যাতিতা তরুণীকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হলেও মারা যান তিনি। আর রাতের অন্ধকারে মা-বাবার কোল থেকে মেয়ের দেহ কেড়ে নিয়ে পুড়িয়ে দেয় পুলিশই। নির্যাতিতার পরিবারকে একঘরে করে দিয়ে খাপ পঞ্চায়েত বসিয়েছিল স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব। তাহলে কার কাছে বিচার চাইবে মেয়েরা? কোথায় গেলে ন্যায় পাবে?
কবে থেকে আর বিচার চাইতে যেতে হবে না? এমন ‘আচ্ছে দিন’ আর আসবে কবে?
Comments :0