TRIPURA GROUND REPORT

ভিত টলেছে, মুখ্যমন্ত্রীর ঢুঁ ঘরে ঘরে

জাতীয়

TRIPURA ASSEMBLY ELECTION 2023 BJP CPIM CONGRESS TIPRA MOTHA BENGALI NEWS ত্রিপুরায় প্রচারে ঝড় তুলেছে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস

স্বর্ণেন্দু দত্ত

১৪ ফেব্রুয়ারি সকাল সকাল মেলার মাঠে দশরথ দেব ভবনের সামনে দিয়ে জনাকয়েক লোক নিয়ে বাড়ি বাড়ি প্রচারে বেরিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা। সপ্তাহ খানেকের বেশি রাজ্যের অন্যত্র না গিয়ে নিজের কেন্দ্র টাউন বড়দোয়ালির অলি-গলিতে ঘুরছেন মুখ্যমন্ত্রী। ত্রিপুরার মতো ছোট্ট রাজ্যের ভোটে এবার ২২টি হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে বিজেপি। মোদী, শাহ, যোগী থেকে মিঠুন, হেমা মালিনী, স্মৃতি ইরানি। শুভেন্দু, দিলীপ ঘোষ থেকে কিরেন রিজিজু। হিমন্তবিশ্ব শর্মা তো ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করেছেন হেলিকপ্টারে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে পায়ে হেঁটে ঢুঁ মারতে হচ্ছে গলিতে। মাস কয়েক আগে উপনির্বাচনে জেতা আসন ধরে রাখতে তাঁর গলদঘর্ম অবস্থা। শুধু যে বাইরের শঙ্কা, তা তো নয়। সাংসদও তো পড়ে আছেন তাঁর গদি কাড়তে। 

বিরোধী দলই শুধু নয়, সংবাদ মাধ্যমের ৪৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীদের হাতে। গণতান্ত্রিক এমন কোনও পরিসর অবশিষ্ট নেই যেখানে বিজেপি আক্রমণ করেনি। ভোটাধিকার লুট হয়েছে। তার জেরে ‘ছাপ্পা মুখ্যমন্ত্রী’ শিরোপা জুটেছে। কিন্তু শুধু গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ নয়। শুধু শহরের শিক্ষিত যুবকদের নিয়োগ নেই তা নয়, রেগায় ৮-১০ দিনের বেশি কাজ নেই। যা ত্রিপুরায় ছিল ৯০ দিনের বেশি। দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। গ্রাম-শহরে কাজের এই হাহাকারের বাস্তবতা এতটাই বেশি যে, এবার ইশ্‌তেহার হোক বা প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, কোথাও কর্মসংস্থানের কোনও কথা নেই। 


পাশাপাশি আগরতলা, বা জেলা সদরগুলি হোক বা গঞ্জগুলিতে ব্যবসায়ী-দোকানদারদের একই বক্তব্য কারবারের হাল খারাপ। শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। টেট উত্তীর্ণরা এখানেও চাকরির বদলে পুলিশের লাঠিপেটা খেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মতো। চাকরিচ্যুত দশ হাজারের বেশি শিক্ষককে নিয়ে চোর পুলিশ খেলা হয়েছে পাঁচ বছর ধরে। ফলে স্কুলে শিক্ষক নেই। ক্লাস হচ্ছে না। হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। মাদকে-নেশায় বিপর্যস্ত যৌবন। মহিলাদের নিরাপত্তা শিকেয়। আরও ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষায় যে পরিবর্তন এনেছিলেন মানুষ, সর্বস্তরে তা ধাক্কা খেয়েছে। ফলে ক্ষোভ আছে। সেটা উপলব্ধিও করা যায়।  

এই না পাওয়ার ক্ষোভ নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা এতদিন বিজেপি’র ছিল না। কারণ পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা ভোটে জয় এসেছে লুটের পথে। দুরমুশ হয়ে যাওয়া বিরোধীরা একযোগে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, এই ধারণা তিন মাস আগেও করতে পারেনি বিজেপি। স্বল্প সময়ের মধ্যে যে নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে, সেটা বিজেপি যেমন অনুমান করতে পারেনি, তাদের পোষ্য বাইক বাহিনীতেও অনিশ্চয়তায় ভিড় কমেছে। বিপরীতে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান বিরোধীরা দমিত অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এটাই এবারের ভোটে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ গুণগত পরিবর্তন। ফলে বিজেপি’কে নানা পন্থা নিতে হচ্ছে সরকার গঠনের জন্য।


দোস্তি-কুস্তির কথা বলতে হচ্ছে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। পাড়ায় পাড়ায় মূলত কংগ্রেস ভোটারদের টার্গেট করা হচ্ছে। বোঝানো হচ্ছে বাম জমানায় তাঁরা কত অত্যাচারিত ছিলেন। এখন তাদের নেতারা নিজেদের স্বার্থে সিপিআই (এম)’র সঙ্গে ‘জোট’ করে নিয়েছে। বিজেপি’র হিসাব বামপন্থীদের ভোট কংগ্রেসে যাবে, কিন্তু কংগ্রেসের ভোট সবটা যাবে না বামফ্রন্টে। ফলে আগরতলায় এই চেষ্টা আপ্রাণ চালাচ্ছে বিজেপি। 

অনুকূল চন্দ্রের নামে ক্যান্টিন চালুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বিজেপি’র ইশ্‌তেহারে। জনসংখ্যার বিপুল অংশের নাথ সম্প্রদায়ের কথা বিবেচনায় রেখে পাড়ায় পাড়ায় গোরক্ষনাথের মন্দির প্রতিষ্ঠা চলছে। এমনকি বিজেপি’র ভোট প্রচারে চলে এসেছেন তিতাসের অদ্বৈত মল্লবর্মণও! নলছড় কেন্দ্রের বড় অংশের মানুষ তিতাসের তীর থেকে আসা বর্মণ পদবির। তাদের মধ্যে আবেগ তৈরি করতে বিজেপি প্রার্থীও বর্মণ। আর ভোটের ব্যানারেও অদ্বৈত। প্রতিটি কেন্দ্রে এইরকম বিশেষত্ব নিয়ে আসরে নেমেছে বিজেপি। 


কিন্তু তাতেই বা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে কোথায়! এবারের সভা-সমাবেশগুলি কেমন যেন নিস্তেজ। ‘চলো পালটাই’ এর সেই উত্তাপ উধাও। এমনকি আগরতলা শহরেও। শেষবেলায় মোদীর সভায় ভর্তি হলো না আস্তাবল ময়দান। হিমন্তবিশ্ব শর্মা পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি প্রচারে। বলেছেন, ভোট যদি ক’দিন পিছিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে প্রধানমন্ত্রী মোদী আর অমিত শাহও আপনাদের দোরে দোরে আসতেন! বিরোধীদের প্রশ্ন, পরিস্থিতি কি তাহলে এতটাই খারাপ? 


তাই টি-টোয়েন্টিতেই ভরসা বিজেপি’র। সরাসরি বলছেও মণ্ডল স্তরের নেতারা। কিন্তু ম্যাচ সবাই খেলবে এমন ভরসাও পুরোপুরি পাচ্ছে না। খেলোয়াড়রা ম্যাচের ফলাফল নিয়ে সংশয়ে পড়ে যাওয়ায় খেলতে নামার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত। টাকার খেলা শুরু হয়েছে। গত কয়েকদিনে বিভিন্ন গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে নগদ দেড় কোটি টাকার বেশি উদ্ধার হয়েছে। ত্রিপুরায় এই অর্থ অনেকটাই। আসল খেলা শুরু হয়েছে শেষবেলায়। সোমবার রাত থেকে নাকা চেকিং তুলে নেওয়া হয়েছে!

ওইদিনই রাজ্য নির্বাচন কমিশন বিচিত্র সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। প্রচারের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও প্রার্থী চার জনকে সঙ্গে নিয়ে ভোটারদের কাছে যেতে পারবেন। কিন্তু ‘প্রচার’ করতে পারবেন না। প্রশ্ন উঠেছে দাদন দেওয়ার সুবিধে করতেই কি এমন নিয়ম? ধনপুর, বামুটিয়ার বিজেপি প্রার্থীদের টাকা বিলির ভিডিও ছড়িয়েছে। বেকায়দায় থাকা বামুটিয়াতে বিজেপি বিধায়ক কৃষ্ণধন দাসের একাধিক টাকা বিলির ছবি সামনে এসে গেছে। যার একটায় তিনি নিজেই উপস্থিত! একইভাবে মন্ত্রী রামপ্রসাদ পাল রিটার্নিং অফিসারকে ধমকাচ্ছেন সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। 


এদিকে দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে অমিত শাহ ত্রিপুরা এলেই গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠক করছেন আধিকারিকদের সঙ্গে। কংগ্রেস নেতা গৌরব গগৈ অভিযোগ করেছেন এই নিয়ে। মঙ্গলবার জীতেন্দ্র চৌধুরি এই অভিযোগ তুলে ধরে চিঠি দিয়েছেন দেশের নির্বাচন কমিশনকে। নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে ভোট করতে পারে, মানুষের এমন ধারণা ভেঙে দেওয়ারও আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি।

পশ্চিমবঙ্গে বিএড প্রতিষ্ঠানগুলির পরীক্ষা ছিল ভোটের আগে পরে। যেখানে ত্রিপুরার বহু ছেলেমেয়ে পড়ে। বিজেপি এই নিয়ে কমিশনে যায়। পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ার পরে এদিন সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় বিরাট করে বিজ্ঞাপন দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ দিয়েছে বিজেপি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটা আসলে মানুষের উপরে চাপ তৈরির কৌশল। তারা দেখাতে চাইছে নির্বাচন কমিশন তাদের হাতের মুঠোয় আছে। যেকোনোভাবে ভীতির পরিবেশটা বজায় রাখতে চাইছে বিজেপি। তাহলে মানুষ ভোট দিতে বেরবে না। সেই ভরসাতেই আছে বিজেপি।
 

Comments :0

Login to leave a comment