FOOD CORPORATE

সঙ্কটে বিশ্ব, মুনাফার পাহাড়ে খাদ্য কর্পোরেট

রাজ্য বিশেষ বিভাগ

food movement bengali news

অনিন্দ্য হাজরা

 

বিশ্বের খাদ্য শস্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বৃহৎ পুঁজি। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমলেও তাঁদের মুনাফার পাহাড়ে কোনও আঁচ পড়েনা। রেশন ব্যবস্থার জোরে ভারতবর্ষে সেই পরিস্থিতি ঠেকানো গিয়েছে অন্তত ৫ দশক ধরে। কিন্তু সরকারী ভাবে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে সেই সুরক্ষাবর্ম। সবটাই করা হচ্ছে কর্পোরেট পুঁজিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে। এই অবস্থায় উঠছে প্রশ্ন- ফের কী তাহলে ১৯৪৩ বা ১৯৫৯ সালের খাদ্য সঙ্কটের মুখোমুখি হতে পারে ভারতবর্ষ? 
 

১৯৪৩—এ সত্যিই বর্ধমান, বগুড়া মুর্শিদাবাদ, ময়মনসিং-এ চাল ছিল না? 
 

ছিল! গোরা সেনার গুদামে ভর্তি ছিল হরেক কিসিমের চাল। ব্রিটিশ সরকারই যুদ্ধের প্রস্তুতিতে মজুত করেছিল শস্য, বাংলাকে নিঃস্ব করে। জোতদার-আড়তদারদের গুদামে ভর্তি ছিল হরেক কিসিমের চাল। চালের গুদামে লেঠেল নামিয়েছিল বাজারে আকাল তৈরি করে চড়া দামে মুনাফা করতে। 

স্বাধীন দেশে, ১৯৫৯ সালের খাদ্য সঙ্কটের জন্যও দায়ী সেই মজুতদারি, আড়তদারি। ‘দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’-র সনদের অন্যতম ছিল এই চক্র ভাঙার দাবি। আড়তদারের গুদামে মজুদ রয়েছে চাল। উল্টোদিকে কলকাতার রাস্তায় ফের শোনা যায়, ‘‘মা,দুটো ফ্যান দিবি মা?’’ 

১৯৫৮’র খাদ্য আন্দোলনে ৮০ জন শহীদ, ১২,৮৪৫টি গ্রেপ্তারি। পরবর্তীকালে ষাটের দশকে সুসংহত গণবন্টন ব্যাবস্থা এই আন্দোলনের ফসল। পোক্ত এবং বিস্তৃত হয় ১৯৫৫ সালে পাশ হওয়া  অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের পরিধি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যদিও বলেছেন, ফলনে যখন সমস্যা নেই তখন এই আইন রেখে লাভ কী! সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থাকে কার্যকরী এবং শক্তিশালী করার দাবিও ওই আন্দোলন থেকে।

তারপর কেটে গিয়েছে ৬৪ বছর। আরও একটা ৩১ আগস্টের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। ২০১৯ সালে সংসদে পাশ হয় ৩টি কৃষি আইন। সেই আইনের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন কৃষকরা। আইন তিনটিতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য তুলে দেওয়ার পাশাপাশি বলা হয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনেও কাটছাঁট করা হবে। তিন আইন বিজেপি সরকারকে বাতিল করতে হয়েছে কৃষক আন্দোলনের চাপে। মনোভাব কিন্তু বদলায়নি। 

২০২২ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত রয়েছে ১২১টি দেশের মধ্যে ১০৭ তম স্থানে। খাদ্যের বাজারে একচেটিয়া দাপট বেড়েই চলেছে। আদানি উইলমার গোষ্ঠী এই মুহূর্তে ভোজ্য তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ভোজ্য তেলের দাম আর কেজি’তে একশোর নিচে নামেই না। এমনই অবস্থা ডালের দামের। কেবল আদানি কিন্তু নয়। একগুচ্ছ দেশি-বিদেশি কর্পোরেটের লক্ষ্য খাবারের বাজারে একচেটিয়া রাজ কায়েম করা। 

রেশনিং ব্যবস্থা যেটুকু রয়েছে, তা-ও ভেঙে ফেলার পক্ষে সরব এদেরই তাঁবেদাররা। কেবল খাদ্য না এখন কৃষিকেই দখলে নেওয়া লক্ষ্য। কৃষকনেতা হান্নান মোল্লার কথায়, এদের মতলব কৃষকের কৃষিকে বদলে কর্পোরেট কৃষি ব্যবস্থা চালু করা।

খাদ্যের বাজারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ এক বা একাধিক কর্পোরেট সংস্থার হাতে চলে গেলে কী হয়, তা বিলক্ষণ টের পেয়েছে পশ্চিমী বিশ্ব। পশ্চিমী বিশ্বে খাদ্য শস্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ৪টি সংস্থা— আর্চার ড্যানিয়েল্‌স মিডল্যান্ড কোম্পানি, বার্জ, কার্গিল এবং লুই ড্রেফাস। খাদ্য শস্য বাজারের ৭০-৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ এই ৪ সংস্থা। 

কোভিড পরবর্তী ইউরোপ এবং আমেরিকায় দেখা দিয়েছে মুদ্রাস্ফীতি এবং আর্থিক মন্দা। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য কেনার আগেও ২বার ভাবছেন সাধারণ মানুষ। সেই অবস্থাতেও রেকর্ড মুনাফার মুখ দেখেছে এই ৪ সংস্থা। 

২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, কার্গিলের মুনাফার পরিমাণ ১৬৫ কোটি মার্কিন ডলার, যা সংস্থার ইতিহাসে সর্বোচ্চ। অপরদিকে লুই ড্রেফাসের মুনাফার পরিমাণ একই সময়কালে প্রায় ৮০ শতাংশ!

একদিকে যখন এই ছবি, তখন রাষ্ট্রসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ৩৪.৫ কোটি মানুষ খাদ্য অনিশ্চয়তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্ট বলছে,  গরীব এবং নিম্নবিত্ত মানুষ প্রতিদিন খাদ্য শস্য কেনার ক্ষমতা হারাচ্ছেন। 

ভারতবর্ষে রেশন ব্যবস্থা স্তব্ধ হয়ে গেলে একই পরিস্থিতি তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ফের একবার তৈরি হতেই পারে ১৯৫৯ বা ১৯৪৩ সালের পরিস্থিতি।

Comments :0

Login to leave a comment