Editorial 16 feb 2023

নিউটনের তৃতীয় সূত্র

সম্পাদকীয় বিভাগ

গোধরাকান্ড এবং অব্যবহিত পরে সংগঠিত গুজরাট দাঙ্গা ও সংখ্যালঘু গণহত্যার অভিযানকে তৎকালীন গুজরাটে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার নিউটনের তৃতীয় সূত্র বলে অভিহিত করেছিল। বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের তৃতীয় সূত্র হলো প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। অর্থাৎ তৎকালীন মোদী সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী গোধরায় ট্রেনের কামরায় অগ্নিকাণ্ডের ফলে অযোধ্যা ফেরত করসেবকদের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়াতেই নাকি গুজরাটে দাঙ্গার আগুন জ্বলেছিল এবং কয়েক হাজার সংখ্যালঘুকে পুড়িয়ে, কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল। মহল্লার পর মহল্লায় মুসলিমদের বাড়ি-ঘর, দোকানপাট পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল। মহিলাদের পাইকিরি হারে ধর্ষণ করে খুন করেছিল দাঙ্গা বাজরা।
সেই গুজরাট দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে বিবিসি’র তৈরি দুই পর্বের তথ্যচিত্র সম্প্রতি সম্প্রচার হয়েছিল বিবিসি টু চ্যানেলে। সারা পৃথিবী জুড়ে সেই ছবি দেখেছিল মানুষ। কিন্তু মোদী কথিত ‘গণতন্ত্রের জন্মদাতা’ ভারতে সেই ছবি যাতে ভারতবাসী দেখতে না পারে তার ব্যবস্থা করেছিল নরেন্দ্র মোদীর সরকার। যাবতীয় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং সোস্যাল মিডিয়ায় কার্যত সেই ছবি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কেননা ছবিতে ব্রিটিশ সরকারের তদন্ত রিপোর্ট সহ নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছিল। অর্থাৎ গুজরাট দাঙ্গার জন্য স্বয়ং নরেন্দ্র মোদীও দায়ী বিবিসি’র তথ্য চিত্র সেটাই স্পষ্ট করে দিয়েছিল। যদিও মোদী সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে উড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীরা সেই ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল। যুব সমাজও জায়গায় জায়গায় আমজনতাকে ছবিটি দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।


এই ঘটনার পর এক মাস কাটতে না কাটতেই দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে মোদী সরকারের আয়কর দপ্তর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সাজো সাজো রবে সদলবলে হানা দেয় বিবিসি’র দিল্লি ও মুম্বাই অফিসে। বিবিসি’র সমস্ত কর্মী ও সাংবাদিকদের কার্যত বন্দি করে তাদের মোবাইল-ল্যাপটপ বাজেয়াপ্ত করে চলেছে দীর্ঘস্থায়ী তল্লাশি। অভিযান চলাকালে অফিসে কারো ঢোকা বা বেরোনো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিবিসি’র তথ্যচিত্রে মোদীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পরেই বিবিসি’র দপ্তরে মোদীর সরকারের আয়কর দপ্তরের হানাকে নিউটনের তৃতীয় সূত্র কিনা নরেন্দ্র মোদী এখনো জানাননি। তবে আমজনতার বুঝতে এক মুহূর্তও বিলম্ব হয়নি যে এটা আসলে স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রী শাসনের প্রতিহিংসার কদর্যরূপ।
আয়কর দপ্তর জানিয়েছে কর ফাঁকি ও ট্রান্সফার প্রাইসিং নিয়ে তারা সমীক্ষা করছেন। এটা যদি সমীক্ষা হয় তাহলে তল্লাশি চেহারা কেমন হবে সেটা ভাবলেই চক্ষু চড়ক গাছে উঠে যাবে। বিপরীতে ‘সমীক্ষা’ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে শাসকদলের মুখপাত্র রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে বিবি‍‌সি’র বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন। মোদীর দলের মতে বিবিসি নাকি বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সংবাদমাধ্যম। ভারত বিরোধী প্রচারই তাদের নীতি। বোঝাই যাচ্ছে উচ্চস্তরে সিদ্ধান্ত নিয়েই এই অভিযান। তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো মোদী জমানায় আজ পর্যন্ত যতগুলি সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যমের দপ্তরে হানা দেওয়া হয়েছে সবক‘টিই মোদী সরকারকে চোখ বুঝে সমর্থন করে না। প্রয়োজনে সমালোচনার কাঠগড়ায়ও দাঁড় করায়। মোদীরা যেহেতু সমালোচনা বা বিরোধিতা সহ্য করেন না তাই সমালোচনা বা বিরোধিতা নজরে এলেই কোনও না কোনও অজুহাতে তাদের উপর শাসকের জুলুম নেমে আসে। এমন স্বাধীন সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশ করলে তাদের নানাভাবে হেনস্তা করা হয়, এমনকি মিথ্যা মামলায় জেলেও পোরা হয়। মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও নরেন্দ্র মোদীরা আসলে স্বৈরাচারী। বিরোধী কণ্ঠ রুদ্ধ করতে তারা পারে না এমন কোনও অপকর্ম নেই। সংবাদমাধ্যমকে তারা বশংবদ ভৃত্যে পরিণত করে মোদীর জয়গান করাতে বাধ্য করে। অবাধ্য হলেই নেমে আসে স্বৈরাচারের খাঁড়া। বিবিসি’র দপ্তরে হানা তার অন্যথা নয়। আসলে ক্ষমতার মদমত্ততায় মোদী-শাহরা দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছেন। ভাবছেন ক্ষমতার চাবুকে চাপকে সকলকে ঠান্ডা করে দেবেন। কিন্তু তা হবার নয়। হাজার চেষ্টা করেও সত্যকে বেশিদিন আড়াল করা যাবে না। ন্যায় ও সত্যের জন্য নিবেদিত প্রাণরা সেটা খুঁজে বার করবেই। মানুষের দরবারে সত্যকে হাজির করে স্বৈরাচারী শাসকের কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করবেই।

Comments :0

Login to leave a comment