CPIM State Conference

যে লক্ষ্যে ২৭তম রাজ্য সম্মেলনে পার্টি

উত্তর সম্পাদকীয়​


মহম্মদ সেলিম

আমাদের পার্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ পর্যায় সম্মেলন। সম্মিলিত উদ্যোগ, গণতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে পার্টিকে তার লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ। পার্টির পথ কী হবে, তার জন্য রাজনৈতিক দলিল গৃহীত হয়। তার খসড়া পার্টির শাখা স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত আলোচনা হয়। পার্টি কংগ্রেসে তা চূড়ান্ত হয়। আমাদের পার্টির ২৪তম কংগ্রেস আগামী ২ থেকে ৬ এপ্রিল মাদুরাইতে হবে। 
পার্টি কংগ্রেসে যে রাজনৈতিক কৌশলগত লাইন ঠিক হয় তার ভিত্তিতেই নির্বাচনী কৌশল নির্ধারিত হয়। একটি কংগ্রেস থেকে আর একটি কংগ্রেসের মাঝে সেই রাজনৈতিক লাইন প্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করতে গিয়ে এবং নির্বাচনী সংগ্রামে যা অভিজ্ঞতা হয় তারও পর্যালোচনা হয়। সেই রিপোর্ট পেশ করা হয় পার্টি কংগ্রেসে। এবারই প্রথম, যা বিশেষ, তা হলো আগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে গত তিন বছরের কাজের পর্যালোচনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। সেই পর্যালোচনার ভিত্তিতে আগামী সময়কালের জন্য রাজনৈতিক দলিলের খসড়া লিখিত হবে। জ্যোতি বসু নগরে আগামী ১৭ থেকে ১৯ জানুয়ারি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক। সেখানেই তা চূড়ান্ত হবে। এবারই প্রথম দুটি দলিল আসবে। পর্যালোচনা রিপোর্ট, রাজনৈতিক কৌশলগত লাইনের প্রশ্নে সংশোধন, সংযোজনের সুযোগ থাকে। একটি পর্যায় হয় পার্টি কংগ্রেসের আগে। আর একটি পার্টি কংগ্রেসে। পার্টি কংগ্রেসের আগে পার্টিকর্মী, সমর্থক, দরদিরা সেই রিপোর্ট বিচার বিশ্লেষণ করে মতামত, সংশোধনী, সংযোজনীর প্রস্তাব দিতে পারেন। পার্টি কংগ্রেসে প্রতিনিধিরা তা করেন। পার্টির দলিল গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও সিপিআই(এম) এমন সম্মিলিত উদ্যোগ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হয়।
সম্মেলন পর্যায়ে আলোচনার ক্ষেত্রে স্থানীয়, জেলা এবং রাজ্যভিত্তিক অভিজ্ঞতা, সমস্যাবলী এবং করণীয়র উপর জোর দেওয়া হয়েছে। তার জন্য আন্তর্জাতিক, জাতীয়, ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার খসড়া হাজির হওয়ার পরে তা নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক সংগঠিত করা হয়। যাতে পরামর্শগুলি সংশোধনী আকারে পাওয়া যায়। যে ইস্যুগুলির আমরা প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হচ্ছি সেই বিষয়গুলি বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায় জেলা এবং রাজ্যস্তরে সম্মেলনে। এবার রিপোর্ট এবং খসড়া আসার পরে আরও সুসংগঠিতভাবে আলোচনা করতে হবে। পার্টিকে মতাদর্শগত প্রশ্নে, রাজনৈতিক বিষয়ে আরও বেশি সংহত ও সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। জানুয়ারি মাসে খসড়া পেশ হওয়ার পরে ফেব্রুয়ারি, মার্চ— দু’মাস সেই কাজে ব্যবহার করতে হবে। 
রাজ্য সম্মেলনের প্রাক্কালে যখন জেলা সম্মেলনগুলি সংগঠিত হচ্ছে সেখানে রাজ্যের পরিস্থিতি, বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা, আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে সাফল্য, দুর্বলতা, পার্টির দৈনন্দিন সাংগঠনিক কাজকর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে লব্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা চলছে। সব রকমের দুর্বলতা কাটিয়ে আন্দোলনমুখী সতেজ, সক্রিয়, বলিষ্ঠ, যে কোনও পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়ার দক্ষতাসম্পন্ন সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চিহ্নিত বাধাগুলি অতিক্রম করার পথ সন্ধান করা এখন একটি বড় কাজ।  
জাতীয় ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য ছিল উগ্র দক্ষিণপন্থী বিজেপি-কে পরাজিত করতে বামপন্থী, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে সন্নিবিষ্ট করার উদ্যোগ নেওয়া। সেই কাজে পার্টির ভূমিকার মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ, বিশেষত বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কায় ঘটে চলা বিষয়েও আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে। সেই ঘটনাগুলির প্রভাব আমাদের দেশে ও রাজ্যে কী পড়ছে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের করণীয় ঠিক করতে হবে। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়ার চক্র, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি, দক্ষিণপন্থার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধি এবং সমাজের চিন্তা ভাবনার উপরে তার প্রভাব অনুধাবন করতে হবে। তেমনই প্রচার মাধ্যম, সমাজ মাধ্যমকে হাতিয়ার করে দক্ষিণপন্থী বিভাজনকারী শক্তি সাধারণের মননের মধ্যে যে হিংসা, দ্বেষ, বিদ্বেষ ইত্যাদিকে প্রোথিত করার চেষ্টা করছে তার বিরুদ্ধে সচেতন থেকে শ্রেণি ঐক্য বাড়িয়ে তোলার কাজ এবং শ্রেণির দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামের গতিমুখ আমাদের নির্দিষ্ট করতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিয়ে বৃহত্তর বাম পরিমণ্ডল গড়ে তোলার যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে তাকে রক্ষা করা, এগিয়ে নিয়ে চলার ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা কেমন হবে, সেই সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী, বিশ্ব মানবতার, মুক্তির দিশারি, শ্রেণি বৈষম্য ও শোষণের অবসানের আকাঙ্ক্ষী কমিউনিস্ট পার্টি কখনোই নির্দিষ্ট দেশ, জনগোষ্ঠী, ঘটনা, ঘটনাপঞ্জীকে কেন্দ্র করে জাতিবিদ্বেষ, ধর্মীয় আবেগ, সাম্প্রদায়িকতা কিংবা যুদ্ধোন্মাদী প্রচারের শিকার কিংবা তার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে না। বিশেষত গোটা এশিয়া মহাদেশ, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলিতে নতুন করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পা রাখার জায়গা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে এবং তার জন্য মৌলবাদী, সন্ত্রাসবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে তারা সবরকম মদত দিচ্ছে। এমনকি তাদের জো-হুজুরি করতে রাজি থাকা রাষ্ট্র তৈরি করার কৌশলও তারা নিয়েছে। পশ্চিম এশিয়ার, বিশেষত সিরিয়ার ঘটনা আমাদের সে বিষয়ে সতর্ক করে। 
ঘরের পাশে বাংলাদেশের ঘটনা আমরা দেখছি। সেখানে যা ঘটছে তাতে আমরা কেউই খুশি নই। সংখ্যালঘুদের উপরে যেখানেই আক্রমণ হোক, তার বিরোধিতা করা কমিউনিস্ট তো বটেই সমস্ত প্রগতিশীলদের দায়িত্ব। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মেশালে সেটা ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তান আফগানিস্তান যেখানেই হোক, তা বিপদের। ‘ধর্মের মোহ যারে এসে ধরে/ অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে’। যে যেখানে সংখ্যায় বেশি আছে, তারা যদি অন্যদের উপরে অত্যাচার করে তবে তাকে সংখ্যাধিক্যবাদ বলে। পাকিস্তানে ‘ইসলাম খতরে মে হ্যায়’ বলে সেখানে হিন্দু, শিখদের উপরে আক্রমণ হয়। বাংলাদেশেও এখন তাই হচ্ছে। আবার এদেশেও যারা ‘হিন্দুরা বিপদে’বলে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা শেষ করতে চাইছে, তারাই সম্ভলের হিংসা ঘটিয়েছে। আমরা চাই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেখানে আছে, সেখানে শান্তি ও সম্প্রীতি থাকুক। ভারত ও বাংলাদেশের রাজনীতিকরা যেভাবে পরস্পরের দেশবাসীর উদ্দেশ্যে রণংদেহী হুঙ্কার দিচ্ছে তা দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণই শুধু নয়, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর মারাত্মক রাজনীতি। তারা ভারতীয় উপমহাদেশকে বিপজ্জনক দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ব্যবহার করে, বিভিন্ন এজেন্সি সেই দেশের সংখ্যালঘু মানুষ, তাঁদের জীবন-জীবিকা এবং ধর্মস্থান, ধর্ম বিশ্বাসের উপর আঘাত হানছে। সরকারি যন্ত্রের অপদার্থতায় এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারছে। তাদের এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি যেমন জানাতে হবে, তেমনই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সাধারণতান্ত্রিক কাঠামো ও শক্তি দুর্বল হলে এবং ধর্মাশ্রিত রাজনীতির ভিত্তিতে বিভাজনকারীদের শক্তি কিভাবে ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে, তা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। প্রতিবেশী দেশের ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে এখানে যেমন বিদ্বেষ, ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, ওদেশের ভারতবিদ্বেষী শক্তির সঙ্গে ‘প্রতিযোগিতামূলক’ভাবে এখানেও যারা বিদ্বেষমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন, তাদের সম্পর্কেও আমাদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে। 
সম্মেলনে আমরা মিলিত হই সমষ্টিগত অভিজ্ঞতার নির্যাস যে জ্ঞান, তা গড়ে তোলার জন্য। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করার যে অভিজ্ঞতা তাকে এক জায়গায় সুসংহত করার লক্ষ্যেই সম্মেলন। বিশ্বায়নের যুগে মানুষকে আরও বেশি করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হিসাবে গড়ে তোলা হচ্ছে, ব্যক্তি সমস্যায় জর্জরিত মানুষকে সামাজিক ভাবনা, সামগ্রিকতা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এককথায় মানুষকে আলাদা আলাদা দ্বীপে, দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দেওয়ার সুবন্দোবস্ত করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টির মুখ্য কাজ হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সাঁকো বাঁধা, সমাজের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনবন্ধন আরও দৃঢ় করা। সর্বোপরি শ্রমজীবীব শ্রেণির মানুষকে লাল ঝান্ডার নিচে জড়ো করার প্রয়াস আরও জোরকদমে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যেখানে রবীন্দ্রনাথ শিখিয়েছেন, ‘যেথা গৃহের প্রাচীর/ আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী/ বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি...’, সেখানে পরিচিতি সত্তাকে ব্যবহার করে, আমাদের নানাভাবে ‘খণ্ড ক্ষুদ্র’করে রাখার প্রয়াস অবিরত চলছে। আমাদের অবিরাম এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষ, শ্রমিক, কৃষকদের পাশে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে জড়ো করা, শ্রেণির ঐক্য গড়ে তোলা ছাড়া এই বিভাজনের শক্তিকে রোখার আর কোনও উপায় নেই। 
আমরা ধারাবাহিক আন্দোলনে আছি। মিছিল করছি, সভা করছি, ব্রিগেডে আমাদের সভায় সাড়া দিয়ে অংশ নিচ্ছেন অনেক মানুষ। এই সব ইতিবাচক উপাদানের সাক্ষী আমরা। এই ভাবনাও আসছে অনেকের যে, এই সংগ্রামের ফল নির্বাচনী ফলাফলে প্রতিফলিত হচ্ছে না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আমাদের এই সময়কালের অবস্থাকে বিবেচনায় রেখে, তা বিশ্লেষণ করে দায়িত্ব, কর্তব্য নির্ধারিত করতে হবে। করোনার সময় কয়েকটি দেশে ধনীদের জন্য বিশেষ সুবিধা দানের বাব্ল, অর্থাৎ বুদবুদ বানিয়ে দিতে দেখেছিলাম। আসলে আজ ব্যক্তি মানুষকে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে এভাবে বুদবুদ বানিয়ে রাখা হচ্ছে। সেই বুদবুদের প্রভাবে তাঁদের কানে যাচ্ছে না সঙ্কটের কথাগুলি। যদি বা কানে যায়, হৃদয় ছুঁতে পারছে না। সঙ্কটের ছবি দেখলেও তা মনে দাগ কাটছে না। আর যদি দাগ কাটেও তা ভোট দিতে যাওয়ার পথে সেই মানুষ কিংবা জনগোষ্ঠীর প্রধান বিবেচ্য প্রসঙ্গ থাকছে না। শাসক শ্রেণির তৈরি ওই বিশেষ বিচ্ছিন্নতার বাব্লে আবদ্ধ বিচ্ছিন্ন মানুষটির কাছে আমাদের বক্তব্য সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না। তার জন্য প্রয়োজনীয় ভেদশক্তি আমাদের অর্জন করতে হবে। অনেক টাকা খরচ করে এই বুদবুদ তৈরি করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই সুযোগে দেখা যাচ্ছে যারা এই সঙ্কটের জন্য দায়ী, তাদেরই পরিত্রাতা হিসাবে হাজির করা হচ্ছে। যেমন আমরা দেখলাম আমেরিকায়, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকার রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে নীতিগত ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভেদ নেই। কিন্তু আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের জিতে আসা অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতার ইঙ্গিতবাহী। আগে ছিল ‘একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে’ ‘এ যুগে তারা জন্ম নিয়েছে আজই।’এখন একই যুগে সেই বিপজ্জনক শক্তি ফিরে আসছে, উঠে আসছে। সমান্তরালভাবে প্রচার মাধ্যমকে, সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে, রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে, এজেন্সিগুলিকে ব্যবহার করে, রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরের কিছু এজেন্সিকে ব্যবহার করে এমন ইমেজ তৈরি করা হচ্ছে, যাতে যারা সঙ্কটের জন্য দায়ী তারাই ত্রাতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে। লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে, পেশাদার পিআর সংস্থার মাধ্যমে কোনও একজন নেতা, নেত্রীকে সর্বরোগ সারিয়ে তোলার ক্ষমতাসম্পন্ন হিসাবে উপস্থিত করা হচ্ছে শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে। সেখানে সব শোষক আলাদা আলাদা নাটক মঞ্চস্থ করলেও, বা একই নাটকে আলাদা আলাদা ভূমিকা পালন করলেও আসলে সাধারণ মানুষকে তাদের এই ছদ্মরূপে প্রভাবিত করছে। সমস্ত ধরনের প্রচার মাধ্যমকে সুকৌশলে, একইসঙ্গে ব্যবহার করে মানুষের জাতি, ধর্ম, ভাষা, প্রাদেশিক পরিচয়কে অস্মিতার উপাদান হিসাবে তুলে ধরে মূল সমস্যা থেকে তাঁর দৃষ্টি আড়ালে রাখার চেষ্টা চলছে (বাংলা অস্মিতা, গুজরাটি অস্মিতা, তেলেগু বিড্ডা, মারাঠা অস্মিতা, অসমীয়া পরিচিতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে)। এতে সাময়িকভাবে হলেও জীবন-জীবিকা, রুটি রুজি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের প্রশ্নগুলির উপরে একটি আড়াল নিয়ে আসে, ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য একটি আস্তরণ ফেলে দেয়। আমাদেরও বিগত দিনগুলির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে, আমাদের সামনে উপস্থিত নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন বিষয়কে মোকাবিলা করে অগ্রগতি ঘটানোর জন্য, এই পরিস্থিতির মধ্যে যে নতুন নতুন উপাদান আছে তার থেকে উপযুক্ত উপকরণ, কৃৎকৌশল আয়ত্ত করতে হবে। আমাদের পরীক্ষিত যে হাতিয়ারগুলি আছে, সেগুলিকে আরও শাণিত, সময়োপযোগী করতে হবে। 
তার পাশাপাশি নতুন নতুন হাতিয়ার গড়ে তুলতে হবে। মানব সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী আছে প্রত্যেক যুগে নতুন নতুন ধরনের সঙ্কট, বৈষম্য হাজির হয়। নতুন প্রজন্মের উন্নত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃৎকৌশল আবিষ্কার করে সেই সঙ্কটের মোকাবিলা করে উত্তরণ ঘটানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন হয় পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ, শতাব্দী সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, উন্নততর দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং তার প্রয়োগ। প্রথমত, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হিসাবে আমাদের পাথেয় উন্নততর মতাদর্শ। তাতে নিজেদের আরও শাণিত করতে হবে। মতাদর্শর চর্চাই শেষ কথা নয়, শ্রেণি আন্দোলন-সংগ্রাম, সংগঠনের মধ্য দিয়ে সেই মতাদর্শকে প্রয়োগ করতে হয়। তা থেকে লব্ধ শিক্ষাকে আয়ত্ত করে, মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের সংগঠনকে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলা, পরিচালনার জন্য আরও যত্নশীল, পারদর্শী হয়ে উঠতে হবে। সংগঠন গড়ে তোলা এবং পরিচালনায় আরও নিষ্ঠা, সততা ও ত্যাগের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নীতিনিষ্ঠভাবে সাংগঠনিক কায়দা কানুন প্রয়োগ করতে হবে। এই সম্মেলন আজকের বাংলায় দক্ষিণপন্থার সব রকমের চক্রান্তের বেড়াজাল ভেঙে, দক্ষিণপন্থী প্রভাব মুক্ত হয়ে, বাম পরিমণ্ডল গড়ে তোলার প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করুক। পার্টিকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি, বাম আন্দোলনকে আরও সংহত, ঐক্যবদ্ধ এবং রাজনৈতিক-সামাজিক উত্তরণের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে আন্দোলন, সংগ্রামমুখীনতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দৈনন্দিন সাংগঠনিক কাজকর্ম নিয়মনিষ্ঠভাবে পরিচালনার পাশাপাশি নতুনতর পরিবেশে নতুনতর পদ্ধতি খুঁজে বের করার প্রয়াস এবং তার পাশাপাশি নিত্য নতুন বিষয়ে হস্তক্ষেপের সক্ষমতা, যোগ্যতা অর্জন করার লক্ষ্যে আমদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। আমাদের আন্দোলন, সংগ্রাম, সংগঠন পরিচালনার প্রয়াস, পদ্ধতি আমাদের সমর্থক, দরদি মানুষের কাছে যাওয়া, তাঁদের থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা এবং আরও ব্যাপকতর অংশের মানুষকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করানোর উপযুক্ত বাতাবরণ তৈরি করার মধ্যেই আছে ভবিষ্যতে অগ্রগতির চাবিকাঠি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, গুরুবাদ, আত্মপ্রচারের মতো নেতিবাচক বিষয় সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
সাধারণ মানুষের ভরসা পাওয়ার উপযুক্ত হিসাবে আমাদের নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে কর্মী, তাঁর আচার ব্যবহার, তাঁর জীবনচর্চা, জীবনচর্যা, সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁর অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা, সাংগঠনিক কাজে তাঁর দক্ষতা ক্রমাগত বিকশিত করার অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র যে সুমহান ঐতিহ্য আমাদের পূর্বসূরিরা গড়ে তুলেছেন, তার যথার্থ উত্তরসূরি হিসাবে জনমনে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তবেই পার্টির সমর্থনের ভিত্তিকে আমরা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবো। বামপন্থার পুনর্জাগরণ এই বাংলায় আবার করা সম্ভব। তার জন্য সিপিআই(এম)’র পুনরুত্থান অতীব জরুরি। 
সিপিআই(এম)’র পশ্চিমবঙ্গ ২৭তম সম্মেলনকে ভিত্তি করে এই ভাবনাকে জনমানসে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আমাদের এগতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment