অগ্নিবেশ রায়
‘মসজিদ-মাজারের তলায় মন্দির ছিল’ — এই ধুয়ো তুলে ও আদালতকে ব্যবহার করে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে উসকে দেওয়ার হিন্দুত্ববাদী অভিযানে আপাতত রাশ টানলো সুপ্রিম কোর্ট। অবশ্য এই স্বস্তি আদৌ স্থায়ী হবে কিনা, তা বলার সময় এখনও আসেনি। সুপ্রিম কোর্টে বাবরি মসজিদ-রামজন্মভূমি বিতর্কের একরকম আইনি নিষ্পত্তি (যদিও, সে বিচার ন্যায়বিচার কিনা, তা তর্কসাপেক্ষ) হওয়ার পরে প্রত্যাশিত ছিল, আর কোনও ধর্মস্থানকে কেন্দ্র করে বিতর্ক ও তার পরিণামে দেশে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে না। এমনকি, বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি রায়েও তেমন প্রত্যাশার প্রতিফলন ছিল— “১৯৯১ সালে সংসদ কর্তৃক প্রণীত উপাসনাস্থল আইন, ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক মূল্যবোধকে রক্ষা ও সুনিশ্চিত করে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় চিন্তার, অভিব্যক্তির, বিশ্বাসের, ধর্মের ও উপাসনার স্বাধীনতা রক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনা সকল নাগরিকের আত্মসম্মান ও পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্বের কথা বলে। সামাজিক সৌভ্রাতৃত্বের মূল শর্তই হলো সকল ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সমান শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা। … ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি, এবং এই (উপাসনাস্থল) আইন প্রণয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্র, সেই ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে অক্ষুণ্ণ রাখার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছে। অতীতমুখী না-হওয়া একটি অন্যতম সাংবিধানিক মূল্যবোধ, আর ধর্মরিপেক্ষতা হলো সেই মূল্যবোধের মর্মবস্তু। যে ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ আমাদের অতীতমুখী হওয়া থেকে বিরত থাকতে বলে, তাকে রক্ষা করার লক্ষ্যে উপাসনাস্থল আইন হলো আইনসভার তরফে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।”
উদ্ধৃত অংশ থেকে স্পষ্ট হয় যে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ উপাসনাস্থল আইনকে সংবিধান-সম্মত বলে ঘোষণা করেছে। প্রশ্ন হলো, তাহলে উপাসনাস্থল আইনের সাংবিধানিক বৈধতা যাচাই করতে কেনই বা আবার তিন সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠিত হলো? কেনই বা ২০২১ সালে উপাসনাস্থল আইনের সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের হওয়া ‘জনস্বার্থ মামলা’টি শুনানির জন্য গৃহীত হলো?
উপানাস্থল (বিশেষ ব্যবস্থাদি) আইন, ১৯৯১
১৯৯১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রণীত হওয়া এই নাতিদীর্ঘ আইনে বলা হয়েছে, দেশের উপাসনাস্থগুলির চরিত্র পরিবর্তনের লক্ষ্যে দায়ের হওয়া কোনও দেওয়ানি মামলা আদালতে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। স্বাধীনতার মুহূর্তে অর্থাৎ ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭-এ কোনও উপাসনাস্থলের যে ধর্মীয় চরিত্র ছিল সেটিই বজায় থাকবে। এই আইনের উদ্দেশ্য দ্বিমুখী — প্রথমত, কোনও উপাসনাস্থলের ধর্মীয় চরিত্র বদল চিরতরে রোধ করা; দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার মুহূর্তের কোনও উপাসনাস্থলের যে ধর্মীয় চরিত্র ছিল সেটিকেই বজায় রাখা। লক্ষ্যণীয়ভাবে এই আইনের আওতা থেকে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি উপাসনাস্থলটিকে বাদ দেওয়া হয়। অর্থাৎ, এই আইন কার্যকরী হওয়ার পরেও বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিবাদের বিচারপ্রক্রিয়া চালু থাকার পথ খোলাই থাকে। দেশের অন্য উপাসনাস্থলগুলির ধর্মীয় চরিত্র বদল সংক্রান্ত আইনি বিবাদের পথ চিরতরে রূদ্ধ করতেই এই আইন প্রনয়ন করা হয়।
উপাসনাস্থল আইনের সাংবিধানিক বৈধতা- চ্যালেঞ্জগুলি কী?
উপাসনাস্থল আইনের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ (?) মামলাটি করেছেন ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায়। সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ-রামজন্মভূমি মামলায় চূড়ান্ত রায় ঘোষণার কয়েকমাস পরেই ২০২০ সালের অক্টোবরে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হয়। প্রায় চার বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও অবধি কেন্দ্রীয় সরকার তাদের বক্তব্য জানায়নি। সহজেই অনুমেয়, বিষয়টি তাদের কাছে বিড়ম্বনার। ১৯৯১ সালে সংসদে এই আইনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল ভারতীয় জনতা পার্টি। এখন, তাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া বেশ অস্বস্তিকর। সম্ভবত, এই বিড়ম্বনাই বিলম্বের কারণ। অশ্বিনী উপাধ্যায় যে মূল যুক্তিগুলি সুপ্রিম কোর্টের সামনে তুলে ধরেছেন, সেগুলি জানাবোঝা জরুরি।
এক, উপাসনাস্থল আইনে উপাসনাস্থলের চরিত্র বদলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে যা নাকি হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ধর্মের অনুসারীদের উপাসনা ও ধর্মপালনের মৌলিক অধিকারকে হরণ করেছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, মামলাকারী দাবি করেছেন আইনটি নাকি সংবিধানে বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শেরও পরিপন্থী, অতএব পরিত্যায্য।
দুই, মামলাকারীর মতে, আইনে যে নির্ধারক তারিখ (‘কাট-অফ ডেট’) অর্থাৎ, ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ তারিখকে উপাসনাস্থলের যে ধর্মীয় চরিত্র ছিল, সেটিই বজায় থাকবে— এই তারিখটি অযৌক্তিক। তাঁর দাবি, এমন তারিখ স্থির করতে হলে, সেটি করতে হবে ১১৯২ সালকে, যে বছর মহম্মদ ঘোরি ‘ভারত দখল করে ইসলামিক শাসন’প্রতিষ্ঠা করেন।
তিন, উপাসনাস্থল আইন, নাগরিকের আইনি প্রতিকার পাওয়ার যে মৌলিক অধিকার সেটিকে হরণ করেছে। যে উপাসনাস্থলগুলির ধর্মীয় চরিত্র ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭-এর পূর্বে বদল করা করা হয়েছে, সেগুলি পুনরুদ্ধারের উদ্দেশে মামলা করার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে, যা মামলাকারীর মতে অসাংবিধানিক।
চার, ঈশ্বর যেহেতু আইনি সত্তা (‘জুরিস্টিক পার্সন’), তাই সুদূর অতীতে মন্দির ভেঙে অন্য ধর্মের উপাসনাস্থল বানানো হলেও, ‘ভেঙে ফেলা’ মন্দিরের জমিতে ‘ঈশ্বরের মালিকানা’কখনই বাতিল হয়ে যায় না, সেটি রাজত্ব-নির্বিশেষে বহাল থাকে। সুতরাং, ‘অতীতে দখল হয়ে যাওয়া’ ঈশ্বরের জমির মালিকানা ও দখল পুনরুদ্ধারের উদ্দেশে হিন্দুদের বর্তমানে মামলা করে আইনি প্রতিকার পাওয়ার অধিকার আছে। উপাসনাস্থল আইন, ‘হিন্দুদের’সেই অধিকারকে খর্ব করছে।
যুক্তিগুলি কি আদৌ গ্রহণযোগ্য?
প্রথমত, সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে দেশের সকল নাগরিককে স্বাধীনভাবে স্ব-স্ব ধর্মপালনের অধিকার প্রদান করা হয়েছে। উপাসনাস্থল আইন ধর্মীয় স্থানের চরিত্র বদলের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা কোনও একটি নির্দিষ্ট ধর্মের উপাসনাস্থলের জন্য নয়, বরং সব ধর্মের উপাসনাস্থল— মন্দির, মসজিদ, গির্জা, মঠ, গুরুদ্বার ইত্যাদি সকল উপাসনাস্থলের চরিত্র বদলের ওপরেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৯৭৪ সালে আচার্য মহারাজশ্রী নরেন্দ্রপ্রসাদজী আনন্দপ্রসাদজী মহারাজ বনাম গুজরাট রাজ্য মামলার রায়ে যে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণটি প্রকাশ করে সেটি হলো, “একটি সংগঠিত সমাজে কোনও অধিকারই সীমাহীন হতে পারে না। একজন ব্যক্তির অধিকার, অন্য ব্যক্তির অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া আবশ্যক। যখন বিভিন্ন পরস্পর-প্রতিদ্বন্দ্বী সামাজিক শক্তির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, এই পরস্পর-প্রতিদ্বন্দ্বী সামাজিক শক্তিগুলির মধ্যে ভারসাম্য বিধানের লক্ষ্যে পদক্ষেপ করা। সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশাত্মক নীতিসমূহ স্পষ্টই সে বিষয়ে দিশা দেখায়— যা রাষ্ট্রকে তার নাগরিকদের জীবনাচরণ নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের পরামর্শ দেয়।”
ধর্মনিরপেক্ষতার যে সাংবিধানিক আদর্শ- তার অন্যতম স্তম্ভ হলো এই প্রত্যয় যে, আমরা পশ্চাদমুখী হব না, আমরা অতীতচারী হব না। উপাসনাস্থল আইন সংবিধানের সে আদর্শেরই বাস্তবায়নের একটি আইনি পন্থা। সুদূর অতীতে সংঘটিত ‘অন্যায়ের’প্রতিবিধান বর্তমানে করতে গেলে, সেটি ইতিহাসের ‘প্যান্ডোরার বাক্স’তো খুলে দেবেই, প্রকৃতপক্ষে তেমন উদ্যোগ বাস্তবসম্মতও নয়।
দ্বিতীয়ত, কাট-অফ ডেট কেন ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ করা হয়েছে, মামলাকারীর সে-সম্পর্কিত যুক্তিটিও অসার। তারিখটি খামখেয়ালিভাবে স্থির করা হয়েছে, এমন ছেলেমানুষি দাবির কোনও সারবত্তা নেই। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট আমরা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়েছি এবং ভারত একটি স্বাধীন, আধুনিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে তার যাত্রা শুরু করেছে। উপাসনাস্থল আইনের নির্ধারক তারিখ সেই ঐতিহাসিক যাত্রার সূচনা বিন্দুরই স্বীকৃতি, যেদিন আমরা সাংবিধানিক গণতন্ত্ররূপে আত্মপ্রকাশের শপথ নিয়েছি। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতালাভ — দেশে সকল ধর্মকে সমদৃষ্টিতে দেখার সাংবিধানিক ভিত্তি প্রদান করেছে ও সুদূর অতীতে হয়ে যাওয়া ‘অন্যায়ের’পুনরাবৃত্তি আর হবে না, সেই বিশ্বাস নাগরিককে দিয়েছে। ভারতের সংবিধান ধর্মের স্বাধীনতার কথা বলে, বলে সাম্য-মুক্তি-সৌভ্রাতৃত্বের কথাও। যদি উপাসনাস্থল আইন প্রণয়ণ না-ও হতো, তাহলেও কোনও ধর্মস্থানের চরিত্র বদলের উদ্যোগ হলে, সেটিও সংবিধানের মৌলিক আদর্শের বিরুদ্ধাচারণই হতো। সংবিধানে যা নিহিত ছিলই, তাকেই আরও স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ভাষায় মূর্ত রূপ দিয়েছে উপাসনাস্থল আইন, ১৯৯১। সুতরাং, এই আইন সংবিধান বিরোধী ও স্বাধীনতার মুহূর্তটিকে নির্ণায়ক ক্ষণ হিসেবে নির্বাচন অন্যায্য, এমন দাবি ভিত্তিহীন।
তৃতীয়ত, মামলাকারীর দাবি, উপাসনাস্থল আইন নাগরিকের বিচার পাবার মৌলিক অধিকারকে খর্ব করেছে। তাঁর আরও দাবি, কোনও উপাসনাস্থলে অবৈধ দখলদারির বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার পথও এই আইন রুদ্ধ করেছে। দু’টি দাবিরই কোনও তথ্যগত ভিত্তি নেই। এই আইনে নাগরিকের কোনও মৌলিক অধিকার আক্রান্ত হলে, আদালতের দ্বারস্থ হয়ে তাঁর ন্যায়বিচার পাবার অধিকারকে বাতিল করেনি। কিন্তু সর্বাগ্রে নিরূপণ করতে হবে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৌলিক অধিকার খর্ব হয়েছে কিনা এবং সে ‘অধিকার’পেতে গেলে অন্য কারুর মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে কিনা। আবেদনে মামলাকারী দাবি, অন্য ধর্মের (পড়ুন, মুসলমান ধর্মের) নাগরিকের ধর্মাচরণের মৌলিক অধিকার হরণ করে তাঁর ‘অধিকার’প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এমন দাবি অযৌক্তিকই না, অসাংবিধানিকও বটে। দ্বিতীয়ত, কোনও উপাসনাস্থল বে-আইনিভাবে দখল হয়ে গেলে, তার বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া যাবে না, এমন কথা উপাসনাস্থল আইনে বলা নেই। যেটি বলা হয়েছে, সেটি হলো— উপাসনাস্থলের চরিত্র বদল করা যাবে না, সেটি ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ যেমন ছিল, তেমনই থাকবে।
চতুর্থত, মামলাকারীর দাবি, আইনি সত্তা (‘জুডিশিয়াল পার্সন’) হিসেবে ঈশ্বর ও ঈশ্বরের মালিকানাধীন ভূমি কখনই অন্যের হয়ে যেতে পারে না। ঈশ্বরের আইনি সত্তার প্রবহমানতার তত্ত্ব, বিদ্যায়তনিক ভাষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, সীমিত পরিসরে এর কিছু ব্যবহারিক মূল্যও থাকতে পারে, কিন্তু উপাসনাস্থল আইনকে অসাংবিধানিক প্রমাণ করতে এই তত্ত্বের উপযোগিতা নগন্য। উপাসনাস্থল আইনের মূল লক্ষ্যই হলো— অতীত বিচার করে সমাজে ধর্মস্থানের মালিকানা নিয়ে অশান্তিতে ইতি টানা। আধুনিক সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে হলে, এমন অতীত বিচার যে পরিত্যায্য এবং উপাসনাস্থলগুলি ও সেগুলির ধর্মীয় চরিত্র অপরিবর্তির রাখা যে রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য, সেই উপলব্ধিরই বাস্তবায়নের মাধ্যম এই আইন। আধুনিক সংবিধান তথা আধুনিক রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতার যে অপরিহার্যতা, তাকেই আরও শক্তিশালী করেছে এই আইন।
‘বদলে’বাধা, ‘নিরূপণে’ছা?
সুপ্রিম কোর্টে জ্ঞানবাপী মামলার শুনানি চলাকালীন বিচারপতি চন্দ্রচূড় মন্তব্য করেছিলেন, উপাসনাস্থল আইন উপাসনাস্থলের চরিত্র বদলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও সম্ভবত উপাসনাস্থলের ধর্মীয় চরিত্র নিরূপণে আইনি বাধা নেই। এক কথায়, এই মন্তব্য বিপজ্জনক, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতির কাছ থেকে এমন প্রগলভতা অপ্রত্যাশিত। আমরা দেখেছি, এই মন্তব্যকে হাতিয়ার করে কিভাবে দেশের নানা প্রান্তের আদালতে একের পর এক মসজিদ-মাজারের ‘প্রকৃত ধর্মীয় চরিত্র নিরূপণ’ করার দাবি নিয়ে সমীক্ষা করার আবেদন দায়ের হয়ে চলেছে। নিম্ন আদালতগুলি অতি-সক্রিয় হয়ে সেই দাবির ভিত্তিতে সমীক্ষা করার আদেশও জারি করে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই, তার প্রতিক্রিয়ায় সমাজে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে। উপাসনাস্থল আইন— ধর্মীয় চরিত্র বদলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মাত্র, ধর্মস্থানের চরিত্র নিরূপণে কোনও বাধা নেই— এমন আখ্যান অতিসরলীকৃত। বস্তুত, তেমন ব্যাখ্যা আইনসভার উদ্দেশ্যের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যে কোনও আইনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে, আইন প্রণয়ণের নেপথ্যে আইনসভার কী উদ্দেশ্য ছিল, সেটিকে বিবেচনায় নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। আইনসভার উদ্দেশ্যকে অগ্রাহ্য করে, আইনের আক্ষরিক অর্থটুকু কেবল গ্রহণ করলে, আইনের প্রকৃত লক্ষ্যই অধরা থেকে যায়। উপসনাস্থল আইন প্রণয়ণের লক্ষ্যই ছিল, দেশে ধর্মস্থানের মালিকানাকে কেন্দ্র করে নিত্য নতুন বিবাদকে চিরতরে সমাপ্ত করা, ধর্মস্থানের মালিকানাকে কেন্দ্র করে আইনি লড়াই ও তার প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নেওয়া সামাজিক অস্থিরতাকে রোধ করা। উপাসনাস্থল আইন সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে রোধ করার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে। ‘সমীক্ষায় বাধা নেই, সুতরাং সমীক্ষার দাবি নিয়ে মামলা করা যেতেই পারে’— একথা মানতে হলে আইনটির যে সঙ্কীর্ণ ব্যাখ্যায় আমরা উপনীত হবো, সেটি শেষ পর্যন্ত আইনটির মূল লক্ষ্যকেই পরাভূত করবে।
সিপিআই(এম)’র ভূমিকা
উপাসনাস্থল আইন প্রণয়নের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র। ১৯৯১ সালে লোকসভায় তৎকালীন সিপিআই(এম) সাংসদ জয়নাল আবেদিন ধর্মস্থানের বিদ্যমান চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। সিপিআই(এম) সহ সকল ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির সম্মিলিত চাপে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার কার্যত বাধ্য হয়, উপাসনাস্থল বিল সংসদে পেশ ও অনুমোদন করাতে। উপাসনাস্থল বিল সংক্রান্ত সংসদীয় বিতর্কে অংশ নিয়ে সিপিআই(এম)’র তৎকালীন সাংসদ মালিনী ভট্টাচার্য আইনটির সমর্থনে যে বক্তৃতা করেন, সেটির গুরুত্ব ঐতিহাসিক। সুপ্রিম কোর্টের বাবরি মসজিদ-রামজন্মভূমি রায়ের ‘উপাসনাস্থল আইন’শীর্ষক অধ্যায়েও মালিনী ভট্টাচার্য্য’র বক্তৃতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ উদ্ধৃত হয়েছে। আজ যখন উপাসনাস্থল আইনের সাংবিধানিক ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে, তখনও সিপিআই(এম) এই মামলার পক্ষভূক্ত হতে চেয়ে ইতিমধ্যেই আবেদন দায়ের করেছে। নাতিদীর্ঘ সে আবেদনে সিপিআই(এম) যে বক্তব্য রেখেছে তার নির্যাস হলো— উপাসনাস্থল আইন সম্পূর্ণরূপে দেশের সংবিধানের মর্মবস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সাংঘর্ষিক নয়। উপাসনাস্থলের বিদ্যমান চরিত্র বজায় রাখা সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম পূর্বশর্ত। উপাসনাস্থল আইন দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানের চরিত্র বজায় রাখার ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দিনটিকে নির্ণায়ক হিসেবে নির্ধারণ করা যুক্তিযুক্ত এবং ধর্মস্থানের চরিত্র বদলের লক্ষ্যে মামলা করার অনুমতি দিলে সেটি যে দেশে শুধু সাম্প্রদায়িক বিভেদই বৃদ্ধি করবে, আবেদনে সেকথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে সিপিআই(এম)।
সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও একবার সুযোগ দিয়েছে, উপাসনাস্থল আইন সম্পর্কে তাদের মতামত জানানোর। ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত কী ভূমিকা নেয়, সে বিষয়ে আমাদের নজর থাকবেই। দেশে যারা ধর্মনিরপক্ষতার পক্ষে, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিপক্ষে তাঁদের অনেকেই পৃথক পৃথকভাবে এ মামলায় পক্ষভূক্ত হতে চেয়ে আবেদন করেছেন। ফলত, কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত যে অবস্থানই নিক না কেন, এই আইন রক্ষার পক্ষে যাঁরা, তাঁদের কন্ঠও শীর্ষ আদালতের অঙ্গনে অনুচ্চারিত থাকবে না। আমরা আশা করতেই পারি, দেশের শীর্ষ আদালত, উপাসনাস্থল আইনের সাংবিধানিক বৈধতায় ‘সুপ্রিম’সীলমোহর দেবে।
Comments :0