পার্থপ্রতিম বিশ্বাস
রাজ্যে প্রাক পূজার একরাতের অতিবৃষ্টিতে দক্ষিণবঙ্গে প্রাণ হারিয়েছিল বারোজন মানুষ, কলকাতা শহরের জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। আর পুজো শেষে এক রাতের বৃষ্টিতে জলের তোড়ে ভেসে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে উত্তরবঙ্গের একত্রিশ জন মানুষ। উৎসবমুখর এই বাংলায় রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী পুজো কার্নিভালে ঢাকের বাদ্যিতে তাল দিয়েছেন এই বিপর্যয়ের আবহেও । ‘ রেড এলার্টে’ জলের তোড়ে উত্তরবঙ্গের পাহাড় থেকে ডুয়ার্স যখন মানুষ কাঁদছে তখন উৎসবের অট্টহাস্যে মশগুল ছিল কলকাতার রেড রোড জুড়ে রাজ্যের প্রশাসন! ইউনেস্কোর বিশেষ সম্মান প্রাপ্তিকে ঢাল বানিয়ে এখন শহরের পুজোয় বিসর্জনের শোভাযাত্রা কার্নিভালে পরিণত হয়েছে। কিন্তু উৎসবের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উদ্যাপনে রাজ্যে মানুষের নিরাপদ পরিকাঠামোর প্রয়োজন যে সবার আগে সেই বোধটাই হারিয়ে ফেলেছে রাজ্য প্রশাসন। পুজোর আগে কিংবা পুজোশেয়ে মৃত্যুর যে কার্নিভাল দেখল রাজ্যবাসী তাতে রাজ্যের পরিকাঠামোর বেহাল অবস্থা আর বিপর্যয় মোকাবিলার সরকারি প্রস্তুতির ভয়াবহ খামতি উঠে এসেছে কলকাতা থেকে মিরিক কিংবা সুখিয়াপোখরি থেকে নাগরাকাটা সর্বত্রই ।
বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিপর্যয়চলাকালীন বিপন্ন মানুষকে উদ্ধারের প্রশাসনিক পরিকল্পনা যতটা জরুরি তার চেয়েও বেশি জরুরি বিপর্যয়ের আগে বিপর্যয়ের অভিঘাত কমানোর পূর্ব পরিকল্পনা এবং প্রশাসনিক প্রস্তুতি। সন্দেহ নেই অতিবৃষ্টির নিরিখে এবার উত্তরবঙ্গ এই শতাব্দীতে নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে। ফলে সেই ভয়াবহ বৃষ্টির ধাক্কায় সড়ক-সেতু থেকে শুরু করে হোটেল-হোম স্টের নির্মাণ কাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো দুঃসাধ্য ছিল। কিন্তু বিপর্যয় মোকাবিলার পূর্ব প্রস্তুতি থাকলে উত্তরবঙ্গ জুড়ে মানুষের এই মৃত্যুমিছিল দেখতে হতো না। প্রাক পূজার বৃষ্টিতে জলমগ্ন কলকাতা শহরের ভয়াবহ চেহারা দেখে রাজ্য সরকার গোটা রাজ্যে পুজোর ছুটি দু’দিন এগিয়ে এনেছিলেন যখন উত্তরবঙ্গ ছিল স্বাভাবিক । কিন্তু উত্তরবঙ্গে যখন ভয়াবহ বন্যায় অস্বাভাবিক অবস্থা তখন সরকারের প্রশাসনিক সক্রিয়তা দু’দিন পিছিয়ে শুরু হয়েছিল কার্নিভালের ব্যস্ততায়। প্রশাসনের চোখে মৃত্যুর কার্নিভালের শোকের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল উৎসবের কার্নিভাল উদ্যাপন। কার্যত এমন উযাপন সরকারের ন্যূনতম সংবেদনশীলতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে জনমানসে।
এই বেনজির প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথে নজিরবিহীন প্রশাসনিক গাফিলতি এবারের বিপর্যয়কে কার্যত ‘ম্যানমেড ডিজাস্টার’ করে তুলেছে। পুজোর আগে কলকাতা ভেসে যাওয়ায় প্রেক্ষিতে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মন্তব্য করেছিলেন যে ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশের জলে কলকাতা ভেসেছে। এবার উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ প্লাবনের পরও সেই অভিনব আঙ্গিকে পড়শি রাজ্য সিকিম কিংবা পড়শি দেশ ভুটানের ছাড়া জলকেই তিনি দায়ী করেছেন। ফলে এত বড় বিপর্যয়ের পর আত্মসমীক্ষার পরিবর্তে সেই চেনা ছকের দায় চাপানোর রাজনীতির পথ ধরেছে রাজ্যের শাসক। আর সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে বিপদের গভীরতা।
রাজ্যের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কিংবা নাগরিক সুরক্ষার বেহাল পরিকাঠামোর দিক থেকে নজর ঘোরাতে উদ্যত এখন রাজ্যের শাসক। মানুষের মৃত্যুর কার্যকারণ সম্পর্ক খোঁজার চেয়ে রাজ্যের প্রশাসন এখন অনেক বেশি সক্রিয় মৃতদেহ পিছু ক্ষতিপূরণের অঙ্ক কিংবা চাকরির প্রতিশ্রুতি নিয়ে। অর্থাৎ আর্থিক ক্ষতিপূরণের মোড়কে এখন নিজের ভাবমূর্তির ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করছে শাসক। ফলে এবারও অধরা থেকে যাচ্ছে বিপর্যয় মোকাবিলার পরিকল্পনার প্রশাসনিক খামতি এবং প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর ঘাটটির তথ্য পরিসংখ্যান আর তার বিশ্লেষণ। সন্দেহ নেই এ রাজ্যের পরিকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গ অনেকটাই পিছিয়ে। রাজ্যে বাম সরকারের বিদায়ের পর গত পনেরো বছরে উত্তরবঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকাঠামো হিসাবে নদীবাঁধ, ব্যারেজ, নিকাশি নালা কিংবা খালের সংস্কার কিংবা নতুন সেতু নির্মাণ হয়নি। অথচ এই পনেরো বছরে বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতির দৌলতে আবহাওয়ার আগাম পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, নিম্নচাপ থেকে অতিবৃষ্টি কিংবা খরা থেকে বন্যা সবেতেই। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলায় প্রশাসনিক প্রস্তুতির আগাম সময় এখন অনেক বেশি পাওয়া যায় অতীতের তুলনায়। কিন্তু এরপরেও রাজ্য প্রশাসনের সক্রিয়তার অভাব বিপর্যয় মোকাবিলার নিরিখে সরকারি ব্যবস্থার দক্ষতা ও সক্ষমতা নিয়েই বড় প্রশ্ন তুলে দিল। পুজোর আগে অতিবৃষ্টিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কলকাতায় মারা গিয়েছিল বারো জন মানুষ অথচ বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা সিইএসসি কিংবা শহরের বাতিস্তম্ভের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কলকাতা পৌরসভা প্রত্যেকেই নাগরিক সুরক্ষায় নিজ নিজ দায় এড়িয়ে গেছে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মানুষের মৃত্যু শহরে প্রথম নয়। কার্যত গত পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন ঝড়-বৃষ্টিতে মানুষের সিংহভাগের মৃত্যু ঘটেছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েই। কিন্তু এবারের বিনা ঝড়ে এক রাতের বৃষ্টিতেই মানুষ যেভাবে মরেছে জলমগ্ন শহরের বিভিন্ন প্রান্তে তাতে শহরের বিদ্যুৎ পরিকাঠামো কতটা অরক্ষিত সেটা আরও একবার প্রমাণ হলো ।
সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় ঘন ঘন হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যে পরিমাণ বিপর্যয় নেমে আসছে সেই বিপদের প্রেক্ষিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্ট পাহাড়ি জনপদের অস্তিত্বের সঙ্কট নিয়েই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গ্রাম থেকে শহরের পরিবর্তন এখন সমতল ছাপিয়ে পাহাড়ের গণ্ডিকেও গ্রাস করছে। ফলে পাহাড় ঘেরা নগরায়নের বাজার অর্থনীতির শাখা-প্রশাখা হিসাবে হোটেল-হোম ষ্টে থেকে শুরু করে সড়ক-সেতুর নির্মাণ যজ্ঞ চলছে। পর্যটন কেন্দ্রিক বাজার অর্থনীতির দাপটে পাহাড় ঘেরা রাজ্যের বাস্তুতন্ত্রের নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। আর তার সাথে নেতিবাচক জলবায়ুর পরিবর্তনের ধাক্কায় ঘটছে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি, হড়পা বান, ভূমিধস কিংবা হিমবাহ উপচে পড়া জলের তোড়ে বিপর্যয়। এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তৈরি হওয়া বিপর্যয়ের হাত থেকে চটজলদি সমাধানের পথ নেই। কিন্তু যখন পরিবেশের উপরে জলবায়ুর এই বিধ্বংসী প্রভাবের আঁচ অনুমান করা যাচ্ছে, কার্য-কারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে প্রযুক্তি নির্ভর উপায়ে, তখনও সতর্ক হতে পারছে না দেশ কিংবা রাজ্যের প্রশাসন! যার ফলে এদেশের মতো বিপুল জনঘনত্বের দেশে অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় শরণার্থী মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে। বেড়ে চলবে এমন জলবায়ুর বিপর্যয়ের ধাক্কায় পাহাড় জীবনে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি লাফিয়ে লাফিয়ে! কার্যত এবারের উত্তরবঙ্গের দার্জিলিঙ, কালিম্পঙ, জলপাইগুড়ি কোচবিহার যেভাবে ভূমিধস এবং বানের ধাক্কায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেটাও এক অশনিসংকেত। যদিও এমন অশনিসংকেত সাম্প্রতিক অতীতে বারংবার মিলেছে প্রকৃতির থেকেই। কিন্তু সেই সংকেতের তাৎপর্য এখনও বুঝতে প্রশাসন ব্যর্থ বলেই আশঙ্কা এমন আরও ব্যাপক ধ্বংসলীলা অপেক্ষা করছে অদূর ভবিষ্যতে!
অতি বৃষ্টির সময় পাহাড়ের অগভীর নদীখাতগুলি হয়ে ওঠে বিপদের ভরকেন্দ্র। পাহাড়ি নদী সংলগ্ন উপত্যকার পাহাড়ি ঢাল যত খাড়া হয় কিংবা যত নেড়া হয় ততো দ্রুত সেই নদীখাতে বন্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফলে সেই তীব্র বানের সময় নদীখাত ছাপিয়ে জল নদীর পাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে প্লাবিত করে। আর নদীখাতের ধার ঘেঁষে তৈরি হওয়া জনপদে হোটেল-হোম স্টে থেকে দোকান বাজার সবই বন্যার জলে খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। এবারের অতি বৃষ্টির দাপটে উত্তরবঙ্গের পাহাড় এবং ডুয়ার্স জুড়ে এমনটাই ঘটেছে। বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অল্প সময়ের মধ্যে যখন অতিবৃষ্টির ঘটনা ঘটছে পশ্চিম থেকে পূর্ব হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তখন বিপর্যয়ের নিরিখে এমন অঞ্চলগুলিতে ঝুঁকির মূল্যায়ন ভীষণ জরুরি। জরুরি, ঝুঁকির ভিত্তিতে পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রেণিবিন্যাস। অথচ সেই কাজটাই উপেক্ষিত হয়ে চলেছে এদেশে কিংবা এ রাজ্যেও। মনে রাখতে হবে গ্রীষ্মকালে হড়পা বানের বিপদের চেয়ে ভরা বর্ষায় কিংবা শেষ বর্ষার অতিবৃষ্টিতে প্লাবনের বিপদ অনেক বেশি। ফলে বিপর্যয় মোকাবিলার স্বার্থেই পাহাড়ে বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির সময় নদী সংলগ্ন অঞ্চলগুলির বাসিন্দাদের সবার আগে স্থানান্তরিত করা উচিত নিকটস্থ কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে। উপকূলের জেলাগুলির ক্ষেত্রে যেমন ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ‘সাইক্লোন শেল্টার’ তৈরি করা হয় ঠিক তেমনি ‘ ফ্লাডশেল্টার’ তৈরি করা উচিত পাহাড়ের এমন ঝুঁকিবহুল অঞ্চলে। এছাড়াও নদীর জলের প্রবল স্রোতে নদীখাতের পাশের পাহাড়ি ঢালের স্থায়িত্ব বিপন্ন হয় বলেই ঝুঁকির পরিমাণ পাহাড়ি নদীর সন্নিহিত অঞ্চলে অত্যন্ত বেশি। এবারের অতিবৃষ্টিতে নদী সংলগ্ন অঞ্চলগুলির বাসিন্দাদের আগেভাগে নিরাপদ আশ্রয়ে স্থানান্তরিত করতে পারলে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমানো যেতো।
যেখানে বাঘের ভয়!সম্প্রতি দেশের পাহাড় সংবলিত ১৭টি রাজ্যের ১৪৭ টি জেলার উপগ্রহ চিত্র নির্ভর সমীক্ষা অনুযায়ী ভুমিধসের ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী দেশের প্রথম ৩৫টি জেলার মধ্যে রয়েছে দার্জিলিঙ। এমন বিপজ্জনক জেলাগুলিতে আবার জনঘনত্ব এবং বাড়ির ঘনত্ব তুলনায় মত্রাছাড়া বেশি। ফলে ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধে হয় ‘ এমন প্রবাদ সত্যি হয়ে উঠছে উত্তরবঙ্গের ভূমিধসের ভয়াবহ বিপদ নিয়ে টিকে থাকা জেলাগুলিতে। যেখানে ধারাবাহিকভাবে পর্যটন কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে স্থায়ী এবং অস্থায়ী জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে চলেছে। লাগামছাড়া নগরায়নের দাপটে শহরে যেমন জলাজমি বুজিয়ে বাড়ি তৈরি হচ্ছে তেমনি পাহাড়ি উপত্যকা অঞ্চলে নদীখাতের জমি দখল করে হোটেল, হোম স্টে বানানোর হিড়িক পড়েছে। এরাজ্যে কার্যত শাসক দলের এবং স্থানীয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে চলছে নদীর বুকে, নদীর পাশে জমির লুট ‘রিয়েল এস্টেট’ গড়ার লক্ষ্যে। আর সেই লুটের মাশুল হিসাবে প্রতিদিন বিপর্যস্ত হচ্ছে উত্তরবঙ্গের বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশ। দার্জিলিঙ জেলার ভৌগোলিক এলাকার মাত্র ৫৩ শতাংশ এখন সবুজ ঢাকা বাকিটা নগরায়নের গ্রাসে পড়েছে। মিরিক এলাকায় ২০২০ থেকে ২০২৪ এই চার বছরে সবুজ ধ্বংসের পরিমাণ ৭৩ হেক্টর জমি। ফলে খাড়া ঢালের পাহাড়ে এমন বৃক্ষ নিধন চলতে থাকলে প্রবল বৃষ্টিতে ভুমিধস যে কেবল সময়ের অপেক্ষা ছিল , সেটা আবার প্রমাণ হলো মিরিকের ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর। এবারের বন্যায় নিহত মানুষজনের অর্ধেকই হলো মিরিক অঞ্চলের বাসিন্দা। ফলে পাহাড় জুড়ে সরকারি এবং পৌর প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণেই বিপজ্জনক অঞ্চলে বাস করেছে মানুষ। আর যার অন্তিম পরিণতি হলো এই ভয়াবহ বন্যায় তাঁদের মৃত্যু আর নদীগর্ভে বাস্তুহারা হয়ে।
মিরিকের সাথে সমতলের সংযোগ রক্ষাকারী অন্যতম ইস্পাতের সেতু দুধনীর কাছে বালাসোন নদীর উপর জলের ধাক্কায় ভেঙে পড়েছে। ভাঙা পড়া সেতুস্তম্ভের চেহারা এবং ইতিহাস প্রমাণ করে যে দুর্গম এলাকার সেতুস্বাস্থ্য সম্পর্কে কতোটা উদাসীন ছিল স্থানীয় প্রশাসন! বিশেষত সেই অঞ্চলের নদীগর্ভ থেকে যেভাবে বালি কিংবা পাথর মাফিয়ারা নির্মাণের কাঁচামাল হিসাবে পাথর-বালি তুলে নেয় অবৈজ্ঞানিক উপায়ে তাতে নদী খাতের জলপ্রবাহের পরিবর্তন ঘটে যায়। আর নদীখাতের সেই বিপজ্জনক পরিবর্তন এমন প্রবল বন্যার সময় ভাসিয়ে দেয় নদীর দুপাশের বিস্তীর্ণ জনপদকে। এমনকি বহু এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি মাটির নদী বাঁধগুলিও ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে ভারী মালবাহী ট্রাকের চাপে। কারণ সেই মালবাহী ট্রাকে পাচার হয় চোরাপথে নদীর বুক থেকে তোলা লুটের পাথর বালি। ফলে এভাবেও বন্যার থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম লাইফ লাইন নদীবাঁধগুলি ধ্বংস হচ্ছে লুটেরাদের হাতে। এর ফলে একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে আর উল্টোদিকে শাসক আশ্রিত নদী মাফিয়ারা নদীর পাথর বালি লুট করার মধ্যে দিয়ে বাস্তুতন্ত্রের স্থায়ী ক্ষতি সাধন করে চলেছে।
১৯৭০ থেকে ২০১০ এই চার দশকে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল জুড়ে তিরিশটি ‘মেঘ ভাঙা বৃষ্টির’ নথিভুক্ত ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের দাপটে সেই ‘মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টির’ সংখ্যা গত দশকে ঘটেছে আশিটা। ফলে বোঝাই যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে (২০১০-২০২০) ভয়াবহ গতিতে ‘মেঘ ভাঙা বৃষ্টির’ সংখ্যা অতীতের তুলনায় আট গুণ বেড়েছে। ফলে অতীতের তুলনায় এমন বিপর্যয়ের ঘটনা বহু গুণে বেড়ে চলবে বলেই আশঙ্কা। এই অবস্থায় অতীতের পরিকাঠামো কিংবা পরিকল্পনা নিয়ে বসে থাকলে ভবিষ্যৎ মোকাবিলার পথ অধরা থেকে যাবে। ফলে দেশজুড়ে এই জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখেই প্রয়োজন পরিবর্তনশীল বাস্তুতন্ত্রের সাথে মানানসই নির্মাণ ভাবনা, নির্মাণ সামগ্রী এবং নির্মাণ পদ্ধতির প্রয়োগ, বিশেষত পাহাড়ি এলাকায়। প্রয়োজন নির্মাণের স্থান কাল পাত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ। অন্যথায় উত্তরবঙ্গ থেকে উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয়ে প্রাণ হারাবে আরও মানুষ এই একুশ শতকে।
Highlights
সবুজ ধ্বংস তো চলছেই, সেইসঙ্গে নদী মাফিয়ারা নির্মাণের কাঁচামাল পাথর-বালি যেভাবে লুট করছে,তাতে নদী খাতের জলপ্রবাহের পরিবর্তন ঘটছে। নদীখাতের সেই বিপজ্জনক পরিবর্তন বন্যায় ভাসাচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদকে। বন্যার থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম লাইফ লাইন নদীবাঁধগুলিও ধ্বংস হচ্ছে লুটেরাদের হাতে। শাসক আশ্রিত মাফিয়াদের লুট বাস্তুতন্ত্রের স্থায়ী ক্ষতি সাধন করে চলেছে।
Comments :0