রুহুল আমিন গাজি
এরিক হবসন যথার্থই বলেছেন, মানবজাতির পক্ষে পারমাণবিক অস্ত্র যতটা বিপজ্জনক, ইতিহাসও ততটাই বিপজ্জনক হতে পারে। বস্তুত, সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রসার এবং এর ভিত্তিতে একটি দৃঢ় মতাদর্শ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইতিহাসের ভূমিকাই প্রধান। ইতিহাসবিদ বিপিন চন্দ্রের ভাষায়, "ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা বাদ দিলে সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের খুবই কম অবশিষ্ট থাকে"। এই বিকৃত ইতিহাস কেবল অতীতের ঘটনা বিকৃত করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং বর্তমানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেও বিষাক্ত করে তোলে। গান্ধীও বারবার সতর্ক করে বলেছিলেন, শিক্ষার প্রসার হচ্ছে না, সাম্প্রদায়িকতার প্রসার হচ্ছে। যতদিন স্কুল-কলেজে অতিমাত্রায় বিকৃত ইতিহাস পাঠ শেখানো হবে, ততদিন স্থায়ীভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
আরএসএস-এর বিকৃত বিদেশি তত্ত্ব
ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো 'বিদেশি তত্ত্ব' বা 'বহিরাগত'র ধারণা নির্মাণ করা। ২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এককভাবে সরকারে আসার পর আরএসএস-এর রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে 'হিন্দু রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু করে। এই কর্মসূচির মূল চাবিকাঠি হলো মুসলিম সম্প্রদায়কে 'বিদেশি' বা 'অনুপ্রবেশকারী' হিসেবে চিহ্নিত করা। সঙ্ঘের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে প্রচারিত এই ধারণাটিকে আরও শক্তিশালী করতে রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করা শুরু হয়।
বিজেপি-র উচ্চ নেতৃত্ব, যেমন অমিত শাহ সহ অনেকেই, মহম্মদ সেলিম, শাবানা আজমি, নাসির উদ্দিন শাহ, শাহরুখ খান থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, ক্রীড়াবিদ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সহ বহু মুসলিম ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে 'বিদেশি' বলে চিহ্নিত করে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার হুমকি দেন। ওদের বক্তব্যের সারমর্ম, বিদেশি হিসেবে দু’-দশ বছর ভারতে থাকা যেতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এদেশ থেকে চলে যেতে হবে।
এই বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারের মূল শিকড় নিহিত রয়েছে হিন্দুত্ববাদী দার্শনিক নেতা এমএস গোলওয়ালকরের তত্ত্বে। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘উই আর আওয়ার ন্যাশনহুড ডিফাইনড’-এ তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন, "হিন্দুস্তানে বিদেশি জাতিগুলিকে হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দি ভাষাকে গ্রহণ করতে হবে, হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম করতে হবে, হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতিকে গৌরবান্বিত করা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা পোষণ করা চলবে না।" তিনি চরম হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, "হয় তারা এসব করবে, অন্যথায় এদেশে থাকতে হবে হিন্দু জাতির কাছে পদানত হয়ে।" আরএসএস এই ভাবনা থেকেই বছরের পর বছর ধরে প্রচার করে আসছে যে মুসলিমরা অনুপ্রবেশকারী।
এই প্রচারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই বিজেপি সরকার লোকসভায় সংশোধিত নাগরিক আইন (CAA) পাশ করায়, যা কার্যকর করার মধ্য দিয়ে মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর রাজনৈতিক ও সামাজিক আক্রমণ সংঘটিত করতে চেয়েছে।
হিন্দুরাই ধর্মান্তরিত মুসলিম
আরএসএস-বিজেপি যে 'বিদেশি তত্ত্ব' প্রচার করে, তা প্রমাণ্য ঐতিহাসিক সত্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। প্রামাণ্য ঐতিহাসিক সত্য হলো, আর্য ভাষা গোষ্ঠী এবং মুসলিমরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়েই ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের আগে ভারতের আদি মুসলিম সমাজের পূর্বপুরুষরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন, বহু দেব-দেবীর পূজা করতেন এবং পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে এই ধর্মান্তরকরণের মূল কারণ ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের গোঁড়ামি, কুসংস্কার, যাগযজ্ঞের আতিশয্য এবং একই সঙ্গে উচ্চশ্রেণির অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিকভাবে বর্ণবৈষম্যের শিকার হওয়া নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। তথাকথিত 'স্বর্ণযুগে' উচ্চবর্ণের লোকেরা নিম্নবর্ণের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার করতো। শূদ্রের ছায়া মাড়ালে পাপ মনে করা হতো, শূদ্রের বেদ শোনার অধিকার ছিল না, শুনলে সীসা গরম করে কানে ঢেলে দেওয়া বা বেদ পড়লে জিভ কেটে নেওয়ার মতো কঠোর বিধান প্রচলিত ছিল।
ঠিক সেই সময়েই ভারতে মধ্য এশিয়া, পারস্য থেকে এসেছিলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশতী, নিজামুদ্দিন আউলিয়া সহ বহু পীর, দরবেশ, ফকির ও সুফিরা। তাঁদের প্রচারিত উদার, সাম্যবাদী ও গণতান্ত্রিক ইসলাম ধর্মমত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের আকৃষ্ট করে, যার ফলে ধর্মান্তরকরণের কাজটা সহজ হয়। এঁরাই ভারতবর্ষের আদি মুসলমান সমাজ। 'লস্কর', 'মণ্ডল', 'সরকার', 'হালদার', 'সরদার' ইত্যাদি হাজার হাজার পদবি দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় যে এই মুসলিম সম্প্রদায়গুলো মূলত ধর্মান্তরিত হিন্দু। এই জনগোষ্ঠী দাস, খিলজী, তুঘলক বা মোঘলদের বংশোদ্ভূত ছিল নাকি?
জমি ভিত্তি থেকে স্থায়ী বাসিন্দা
মধ্যযুগের সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার প্রধান ভিত্তি ছিল জমি, যা স্থানান্তর করা যায় না। মোঘল শাসকরা মূলত সামন্ত প্রভু হিসাবে জমি থেকে খাজনা সংগ্রহ করতেন এবং এদেশে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেলেন। এদেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার সঙ্গে তাঁরা মিশে এক হয়ে গিয়েছিলেন। মোঘল সম্রাট বাবর থেকে শুরু করে শেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুরশাহ পর্যন্ত কেউই ধন-দৌলত নিয়ে বিদেশে যাননি; তাঁরা ভারতেই খেয়ে-পরে বাস করেছেন এবং এখানেই সমাধিস্থ হয়েছেন।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, মঙ্গল পান্ডে, তাঁতিয়া তোপি ও নানা সাহেবরা মূলত ব্রাহ্মণ সিপাহী নিয়ে 'দিল্লি চলো' আওয়াজ তুলে দ্বিতীয় বাহাদুরশাহকে ভারতের সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনায় মোঘল শাসককে বিদেশি বা বহিরাগত হিসেবে দেখা হয়নি। স্বয়ং দ্বিতীয় বাহাদুরশাহের মর্ম বেদনা ছিল - "আমার দুর্ভাগ্য সমাধির জন্য ভারতের মাটিতে দু’গজ জমি পেলাম না।" ঐতিহাসিক সত্যের এই স্বীকৃতির ভিত্তিতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন - "আর্য, অনার্য, হিন্দু, মুসলমান, শিখ, জৈন, খ্রিস্টান,
এক দেহে হলো লীন,/ দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে, /এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।"
এতসব বাস্তবসম্মত যুক্তি থাকা সত্ত্বেও আরএসএস-বিজেপি মুসলিমদের সাধারণ শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য প্রচার করে যে তাদের জন্ম ও কর্মভূমি এদেশে হলেও পুণ্যভূমি হলো বিদেশে। তাদের মূল লক্ষ্য মুসলিম বলেই খ্রিস্টান বা বৌদ্ধদের পুণ্যভূমি বিদেশে হওয়া সত্ত্বেও তাদের ওপর সরাসরি আক্রমণ এত তীব্র নয়। হিন্দু রাষ্ট্রের কর্মসূচি — ৩৭০ ধারা বিলোপ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গো-হত্যা বন্ধ, লাভ-জিহাদ, ঘর-ওয়াপসি, নাগরিক বিল, বুলডোজার আক্রমণ এবং মসজিদের নিচে মন্দির খোঁজা — সব কিছুই মুসলিমদের লক্ষ্য করে সংঘটিত হচ্ছে।
আরএসএস-এর বিদেশিকরণ
আরএসএস-বিজেপি একদিকে মুসলিমদের বিদেশি বলে চিহ্নিত করে, অন্যদিকে তাদের নিজস্ব আদর্শ, নীতি ও কর্মসূচিগুলিও 'বিদেশি' উপাদান দ্বারা প্রভাবিত। তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতিতেও 'বিদেশিকরণের' স্পষ্ট ছাপ রয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদের নিকৃষ্টতম রূপ বিশ্বায়নের দুটি প্রধান নীতি হলো উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণ, যা একটি বিদেশি অর্থনৈতিক ভাবনা। এই নীতিই বর্তমানে বিজেপি সরকারের মূল কার্যকরী আর্থিক নীতি। তাদের উগ্র জাতীয়তাবাদের বীভৎস রূপ হলো ফ্যাসিবাদ, যা আরএসএস-বিজেপি’র মূল আদর্শ। গোলওয়ালকর নিজেই হিটলারের ফ্যাসিবাদী মতাদর্শকে তাঁর অনুপ্রেরণা বলে উল্লেখ করেছেন। হিটলারের কাছে ইহুদি যা ছিল, সেই শিক্ষা ভাবনা অনুযায়ী আরএসএস-এর কাছে মুসলিমও তাই। এমনকি, যে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভোট ব্যবস্থার মাধ্যমে মোদী-অমিত শাহরা নির্বাচিত, সেই সংসদীয় ব্যবস্থাটিও আসলে একটি বিদেশি ধারণা।
সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও একই স্ববিরোধিতা দেখা যায়। সংস্কৃত ভাষাকে হিন্দু সংস্কৃতি বলা হলেও, এই ভাষা আজ মৃত এবং দৈনন্দিন জীবনে কেউ কথা বলে না। ইংরেজি বিদেশি ভাষা হওয়া সত্ত্বেও এটিকে বাদ দিয়ে দেশ বা পৃথিবী চলবে না। বিজেপি নেতাদের ঘরবাড়ি ইউরোপীয় স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত। হিন্দু-মুসলিমের মিলিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, কাশীর মন্দিরে সানাই-নহবত বাজে — এসবের কি হবে? খেলাধুলার ক্ষেত্রে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল ও টেনিস সবই তো বিদেশি খেলা। শুধুমাত্র মুসলিমরাই কি বিদেশি? এই বিকৃত তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিমদের সাধারণ শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে সারা দেশজুড়ে হিংসাশ্রয়ী আক্রমণ সংঘটিত হচ্ছে। এই বিকৃত ইতিহাসের ফলই হলো মুম্বাই দাঙ্গা, মোজাফ্ফর নগরের দাঙ্গা ও গুজরাটের গণহত্যা।
এমনকি, দেশজুড়ে সংশোধিত নাগরিক আইন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ঠেকাতে না পেরে সেই মুসলিমদের লক্ষ্য করেই দিল্লিতে ভয়াবহ দাঙ্গা সংঘটিত করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস আক্রমণের সময় আরএসএস-এর দেশি হিন্দুত্ব দাওয়াই, যেমন গোমূত্র ও গোবর জল, কোনও কাজে আসেনি। করোনা মোকাবিলায় কৌশল ও পদ্ধতি সবই বিদেশি অনুকরণে নিতে হয়েছে এবং ওষুধ ভ্যাকসিনের জন্য বিদেশের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়েছিল। ইতিহাসকে বিকৃত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের এক মজাদার ঘটনা হলো, বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা ভারতে আসলে তারা শরণার্থী, আর মুসলিমরা আসলে অনুপ্রবেশকারী তথা বিদেশি। একজন মুসলিম বিদেশি কারণ সে মুসলিম, কিন্তু পাঞ্জাবি বা বাঙালি যে মুহূর্তে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে, তৎক্ষণাৎ তারা বিদেশি। অন্যদিকে, একজন মুসলিম হিন্দু হলে তখনই সে স্বদেশি।
বিকৃত দ্বিজাতি তত্ত্ব
স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে মুসলিম লীগ, হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস-এর মতো সংগঠনগুলোর সামাজিক ভিত্তি ছিল মূলত ভূস্বামী, জমিদার, অভিজাত সম্প্রদায়, রাজন্যবর্গ, আমলা ও ব্যবসায়ী শ্রেণী। তাদের শ্রেণীস্বার্থের কারণে এরা সাম্রাজ্যবাদের ঘনিষ্ঠ সমর্থক ছিল এবং তাদের চরম প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ ছিল সাম্প্রদায়িকতা। তাদের কাছে গণতন্ত্রের ভিত্তি সংসদীয় গণতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল না। তারা গণতন্ত্র বলতে বুঝত সংখ্যালঘিষ্ঠের উপর হিন্দু বা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িক আধিপত্য।
সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের অন্যতম প্রবর্তক মহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৩৯ সালে বলেন যে, গণতন্ত্রের অর্থ হতে পারে গোটা ভারত জুড়ে হিন্দুরাজ ও সংখ্যালঘিষ্ঠের বিচ্ছিন্নতাবাদ। এই ভাবনা থেকেই বিকৃত দ্বিজাতি তত্ত্বের উৎপত্তি। ১৯৪০ সালের পর যখন ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং ব্রিটিশ শাসনের অবসান অনিবার্য হয়ে ওঠে, তখন সংখ্যালঘুদের স্বার্থবাহী দাবি রূপান্তরিত হলো দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠনের দাবিতে। জিন্নাহ বলেন, ভারতে হিন্দু-মুসলমান দুটি জাতি আছে, যাদের মধ্যে কোনো একতা নেই; সেখানে গণতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব নয়। একমাত্র পথ হলো দেশভাগ ও পাকিস্তান গঠন।
একইভাবে হিন্দু মহাসভা মনে করত, আইনসভায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানে মুসলিম আধিপত্য, যা হবে হিন্দুদের চিরন্তন দাসত্ব। হিন্দু মহাসভা ১৯৩৭ সালের আহমেদাবাদ অধিবেশনে ভিডি সাভারকরের নেতৃত্বে হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের পৃথকীকরণের ধারণাকেই সমর্থন করে, যা আসলে দেশভাগের ধারণার। হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকার জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, "আমরা হিন্দুরা স্বয়ং জাতি, জিন্নাহ সাহেবের দ্বিজাতি তত্ত্বের সঙ্গে আমার কোনো ঝগড়া নেই।"
এই ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গড়ে উঠতে পারে না, তার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো বাংলাদেশ গঠন। ধর্মের ভিত্তিতে গড়া পাকিস্তানের মধ্য থেকে পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপীড়ক জাতিগুলির বিরুদ্ধে ভাষাকে ভিত্তি করে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে সংগ্রাম করে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তুলেছিল। এটি বিকৃত দ্বিজাতি তত্ত্বের অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণ করে দেয়।
অন্যদিকে ভারতে বহু ধর্ম ভাষাভাষীর মানুষ একটি ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে বহুজাতিক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। যার ভিত্তি হলো গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা। বাংলা, বিহার, ওডিশা আলাদা জাতি, আলাদা ভাষা। আবার প্রত্যেক জাতির মধ্যে একাধিক ধর্মের বর্ণের মানুষ বাস করে। আবার সৌদি আরব, ইরাক, ইরান একই ধর্ম কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন জাতি। জাতি নিয়ে স্টালিনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো - জাতি হলো ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত এমন একটি স্থায়ী সম্প্রদায় যাদের ভাষা এক, বাসভূমি এক, অর্থনৈতিক জীবন এক, মানসিক গড়ন এক এবং এই মানসিক গঠনও একটি সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয়। সুতরাং ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিজাতি তত্ত্ব একটি বিকৃত মিথ্যা ধারণা।
যুগের বিকৃতি
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিভাজনের রাজনীতিকে সামনে রেখে ইংরেজ ঐতিহাসিক জেমস মিল ভারতের ইতিহাসের যুগের পর্বে গুরুতর বিভ্রান্তি এনেছিলেন। তিনি ভারতের ইতিহাসকে তিন পর্বে ভাগ করেন - হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ এবং ব্রিটিশ যুগ। জেমস মিল সচেতনভাবে তাঁর যুগের ব্যাখ্যায় সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে কাজে লাগিয়েছিলেন, হিন্দু যুগ হলো স্বর্ণযুগ, আর মুসলিম যুগ হলো অন্ধকারের যুগ। এই ভ্রান্ত ও একপেশে ব্যাখ্যা দুঃখের বিষয় হলেও কোনো কোনো ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকও অভ্রান্ত বলে মনে করতেন।
আসলে, কোনো রাজার ধর্ম দিয়ে গোটা যুগের নামকরণ করা যায় না। প্রাচীন যুগেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিরোধের বহু ঘটনা ছিল। রাম-রাবণ ও কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ হয়েছিল, যেখানে হিংসা, ষড়যন্ত্র ও হত্যা সবই ছিল। সম্রাট অশোকের অহিংসাকে হিন্দু ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ অবদান বলে মনে করা হয়। কিন্তু হিংসা-অসহিষ্ণুতা ছিল বলেই তো পরিবর্তিত সম্রাট অশোককে অহিংসা ও সহিষ্ণুতার কথা প্রচার করতে হয়েছিল।
মধ্যযুগ ছিল সামন্ত যুগ, যাকে সাম্প্রদায়িকতাবাদী ঐতিহাসিকরা মুসলিম যুগ বলে অভিহিত করেছিল। হিন্দু যুগকে গৌরবান্বিত করতে গেলে মধ্যযুগকে অন্ধকারের যুগ বলতে হবে, যার অবনতির জন্য ইসলাম দায়ী — এই ভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক সত্য হলো, মুসলিম শাসকরা মূলত খাজনা দেওয়ার শর্তে হিন্দু রাজা-রানা ও ভূস্বামীদের সঙ্গে আপস করে চলত এবং তলায় হিন্দু সামন্তপ্রভুরাই সর্বেসর্বা থাকত। জোরপূর্বক ধর্মান্তর যদি ধর্ম প্রসারের লক্ষ্য হতো, তবে ভারতবর্ষে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতো। বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছেন, "শত শত বছরের মুসলিম শাসনের প্রাণকেন্দ্র হলো দিল্লি, সেই দিল্লির চারদিকের রাজ্যগুলিতে মুসলিম সংখ্যা খুবই অল্প। শাসন যত দূরে গেছে মুসলিমের সংখ্যা তত বেড়ে গেছে।" স্বামী বিবেকানন্দও জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের কথা অস্বীকার করেছেন।
আরএসএস-বিজেপি যে সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ প্রচার করে, তার মূল ভিত্তি হলো ইতিহাসের সুপরিকল্পিত বিকৃতি। মুসলিমদের 'বিদেশি' হিসেবে চিহ্নিত করা, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাদের ঐতিহাসিক অবদানকে অস্বীকার করা, এবং রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মকে জাতির সমার্থক হিসেবে তুলে ধরা — এসবই বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতির কৌশল। বিকৃত ইতিহাসের সর্বনাশা ফল হলো দাঙ্গা ও গণহত্যা। ভারতের বহুত্ববাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি রক্ষায়, রবীন্দ্রনাথে বর্ণিত 'মহা মানবের সাগর তীরে' ভারতের প্রকৃত ছবিটিকে তুলে ধরতে হলে, এই বিকৃত ইতিহাসকে প্রত্যাখ্যান করে প্রকৃত ঐতিহাসিক সত্যকে সাধারণের সামনে তুলে ধরতে হবে। তবেই দেশে স্থায়ীভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
Comments :0