শ্রুতিনাথ প্রহরাজ
এদেশে বুনিয়াদি শিক্ষার সঙ্কটের মূল কারণ হলো আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য, ব্যাপক সংখ্যায় ড্রপ আউট বা স্কুলছুট ছাত্র-ছাত্রী, পরিকাঠামোগত অভাব, অবৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন পদ্ধতি, গ্রেড -স্তরের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা, শিক্ষকের ঘাটতি, এবং সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের মতো পদ্ধতিগত সমস্যাগুলি। শিক্ষায় সরকারি ব্যয়-সঙ্কোচনের প্রত্যক্ষ প্রভাব, পুরানো শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সংহতির অভাব এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এই কারণে সকল শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে এবং দেশের ভবিষ্যৎ মানব মূলধন সুরক্ষিত করতে জরুরি ভিত্তিতে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। বুনিয়াদি স্তরে কেবলমাত্র সরকারি ব্যয়ে পরিচালিত বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা এই সঙ্কটের ত্রাতা হতে পারে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলি এই নীতি কার্যকর করে লাভবান হয়েছে।
ভারতে সরকারিভাবে নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা প্রায় কুড়ি শতাংশের কাছাকাছি। শিক্ষা— বিশেষত বুনিয়াদি শিক্ষা কার্যক্রমের ক্রমাবনতির কারণেই এখনো আমরা ১০০ শতাংশ সাক্ষরতা অর্জন করতে পারিনি। এর বড় কারণ হলো সরকারি পরিকল্পনার অভাব এবং শিক্ষাকে সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকার অন্তর্ভুক্ত না করা। একটু খতিয়ে দেখলে সরকারি সদিচ্ছার অভাব পরিষ্কার বোঝা যায়। ২০০২ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৮৬ তম সংশোধনীর মাধ্যমে ২১ (ক) ধারায় এদেশের ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি সকল শিশুর বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক শিক্ষালাভের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যথাযথ সরকারি পরিকল্পনা ছাড়া যা কার্যকর করা কার্যত অসম্ভব। ২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইনে ২১ (ক) ধারার উল্লেখ করে পুনরায় এই মৌলিক অধিকার কার্যকর করার কথা বলা হয়েছিল— যেখানে লেখা আছে স্কুলগুলি শিশুদের বাসস্থানের আশপাশে হওয়া নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার (ইনক্লুসিভ এডুকেশন) এটাই প্রধান শর্ত। স্কুলগুলিতে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ আসন আর্থিক ও সামাজিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের পরিবারের শিশুদের জন্য সংরক্ষিত করা থেকে শুরু করে বেশ কিছু সদর্থক কথা সেখানে বলা আছে। কোঠারি কমিশন তো সেই কবে সুপারিশ করেছিল, শিক্ষায় জিডিপি’র ন্যূনতম ছয় শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে। কিন্তু এ ধরনের বক্তব্য ও সুপারিশ সবটাই ঠান্ডা ঘরে রাখা আছে। শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ আজও জিডিপি’র চার শতাংশে পৌঁছতে পারেনি। অথচ চাহিদা আছে বিস্তর। আমাদের মতো দেশে সরকারি ব্যয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার কোনও বিকল্প নেই।
নয়া উদার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর, প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্ব পেরিয়ে গবেষণাস্তর পর্যন্ত, সর্বত্রই এই সঙ্কট উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ ধারাবাহিকভাবে কমছে, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে। ফলে সর্বস্তরে শিক্ষা পরিচালনার ব্যয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে; যে কারণে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার পরিবারগুলির বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা শিক্ষার আঙিনা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। একটা বড় অংশের সম্ভাবনাময় মেধা অকালে হারিয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনা মাফিক সরকারি ব্যয়ে পরিচালনাধীন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি করে, কর্পোরেট পুঁজির যথেচ্ছ মুনাফা লাভের জায়গা হিসাবে অনেকটা কারখানার ধাঁচে গড়ে উঠছে এডুকেশন শপিং মল। খোলা বাজার ব্যবস্থার হাত ধরে শিক্ষায় দুর্নীতি ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছে। তদুপরি, গত এক দশকে রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাওয়ায়, দেশ জুড়ে শিক্ষায় হিন্দুত্বের কর্মসূচি কার্যকর করার মরিয়া প্রয়াস চলছে সরকারি উদ্যোগে। উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, ইতিহাসের বিকৃতি, বিজ্ঞানকে সরিয়ে কুসংস্কার ও অপবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা, এসবই এখন প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়— সর্বস্তরের পাঠ্যসূচির অন্যতম অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে নতুন এক বিপদের মুখোমুখি দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থা।
নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি স্কুল শিক্ষায় নতুন সঙ্কটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি স্কুল ও মুনাফার লক্ষ্যে গড়ে তোলা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে এক পাল্লায় ফেলবার চেষ্টা হয়েছে। সর্বোপরি শিক্ষায় মানবহিতৈষী (ফিলানথ্রপিক) সংগঠনগুলির সাহায্য নেওয়ার ছুতোয় আরএসএস পরিচালিত সরস্বতী শিশু মন্দির, বিদ্যাভারতী, একলব্য বিদ্যালয় ফাউন্ডেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলিকে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। বলাবাহুল্য, উপরোক্ত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি দেশ জুড়ে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষায় হিন্দুত্বের কর্মসূচিকে কার্যকর করার প্রয়াসে নিজেদের যুক্ত রেখেছে। শিক্ষায় বেসরকারিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণের লক্ষ্যেই নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ তৈরি হয়েছে।
গত এক দশকে, ভারতে সরকার পরিচালনাধীন স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে অর্থাৎ নানা অজুহাতে বন্ধ হয়ে গেছে বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যেখানে বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে ১৪.৯ শতাংশ। দুই বিজেপি শাসিত রাজ্য মধ্য প্রদেশ এবং উত্তর প্রদেশে সরকারি স্কুল সবচেয়ে বেশি বন্ধ হয়েছে। আর এক ডাবল ইঞ্জিনের সরকার বিহারে, বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধিতে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। এবছর ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদ অধিবেশনে এক লিখিত প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষা মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী একথা জানিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে, সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১,০৭,১০১ থেকে ৮৯,৪৪১টি কমে ১০,১৭,৬৬০ হয়েছে, যেখানে একই সময়ে বেসরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২,৮৮,১৬৪ থেকে ৪২,৯৪৪টি বেড়ে ৩,৩১,১০৮ হয়েছে। স্কুল শিক্ষায় বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ কোন মাত্রায় বেড়ে চলছে, তা উপরের তথ্য থেকে অনুমান করা যেতে পারে।
এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ওপর। শুধু মধ্য প্রদেশ এবং উত্তর প্রদেশে যথাক্রমে ২৯,৪১০ এবং ২৫,১২৬ টি সরকারি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যা এই সময়ে মোট বন্ধ হওয়া সরকারি স্কুলের ৬০.৯ শতাংশ। প্রায় একই সময়ে শুধু উত্তর প্রদেশেই ১৯,৩০৫টি বেসরকারি স্কুল গড়ে উঠেছে। এই সময়ে অন্যান্য বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির মধ্যে ওডিশায় ১০,০২৬টি, জম্মু-কাশ্মীরে ৫,১১৮টি, উত্তরাখণ্ডে ১,৬৫২টি, ঝাড়খণ্ডে ৫,৫২৭টি, এমনকি অরুণাচল মিজোরামের মতো ছোট রাজ্যগুলিতেও বহু সংখ্যায় সরকারি স্কুল বন্ধ হয়েছে। এই সুযোগে চারদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো ঝাঁ-চকচকে প্রাইভেট স্কুল গড়ে উঠেছে। এমনকি অজ গ্রামে মাঠের মধ্যেও ইদানীং এইসব স্কুল দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে পড়ার খরচ সরকারি স্কুলের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।
আলোচ্য সময়ে বেসরকারি স্কুল বৃদ্ধির জাতীয় গড় হার ১৪.৯ শতাংশ। বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, ওডিশা, পশ্চিমবঙ্গ সহ দশটি রাজ্য আছে যেখানে বেসরকারি স্কুল বৃদ্ধির হার জাতীয় হারের তুলনায় বেশি। এই সময়ে বিহারে বেসরকারি স্কুল বেড়েছে ৫৮৮৩টি ( বৃদ্ধির হার ১৭৯.১৪ শতাংশ), ওডিশায় এই সংখ্যা ২৬৯২টি (বৃদ্ধির হার ৮০.৩৬ শতাংশ), উত্তর প্রদেশে ১৯৩০৫টি (বৃদ্ধির হার ২৪.৯৬ শতাংশ)। এইভাবে একের পর এক রাজ্যগুলিতে সরকারি স্কুল বন্ধ ও বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধির হার পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, দেশজুড়ে শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা কি পরিমাণে বেড়েছে। উপরের এই তথ্যগুলি কোনোটাই মনগড়া নয়, কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জয়ন্ত চৌধুরির সংসদে পেশ করা রিপোর্ট।
এর পাশাপাশি, ২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ৭,০০০-এরও বেশি সরকার পরিচালিত প্রাথমিক স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ৩১ মার্চ, ২০২২ সালের মধ্যে মোট ৭,০০০ স্কুল কমেছে। ৩১ মার্চ ২০১২ সালে স্কুলের সংখ্যা ছিল ৭৪,৭১৭টি। ২০২২ সালে হয়েছে ৬৭,৭১৭টি । ২০২৩ সালের শেষের দিকে, রাজ্য সরকার ৩০ জনেরও কম ছাত্র-ছাত্রী আছে এই অজুহাতে ৮,২০৭টি প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও, সরকারিভাবে এই তথ্য গোপন করার চেষ্টা হয়েছে, তবে গত ১০ বছরে এ রাজ্যে কোন অঞ্চলে কতগুলি স্কুল একতরফা সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বন্ধ করে, কিভাবে লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রীর সরকারি ব্যয়ে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্তির অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে তা সবাই জানেন। কেন্দ্র বা রাজ্য কোনও সরকারই এই স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার যথাযথ কারণ দেখায়নি। কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষায় যে উভয় সরকারই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সারা দেশ জুড়ে স্কুলছুট ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা এই সময়ে ব্যাপক হারে বেড়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ সালের স্কুল শিক্ষার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে ভারতবর্ষের স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ - ২০২৪ সালের মধ্যে দেশের স্কুলগুলিতে প্রায় ২ কোটি ছাত্র কমেছে। ২০২০-২১ সালে সারা দেশের স্কুলগুলিতে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র ভর্তি সংখ্যা ছিল ২৫.৩৮ কোটিরও বেশি। ২০২৩-২৪ সালে ১৪.৭২ লক্ষ স্কুলে ভর্তির সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে ২৩.৫ কোটিতে। ২০২২-২৩ সালে সারা দেশে ১.৪১ কোটি শিক্ষার্থী কমেছে। প্রসঙ্গত, ২০১৫-১৬ সালে স্কুলে এই ছাত্র ভর্তির সংখ্যা ছিল ২৬.১ কোটি। কমতে কমতে এখন এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিক স্তরের স্কুলগুলিতে মোট ভর্তির অনুপাত (জিইআর) ২০২০-২১ সালে ৯৯.১ শতাংশ থেকে কমে ২০২৩-২৪ সালে ৯১.৭ শতাংশ হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে এই অনুপাত ৭৯.৮শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৭৭.৪ শতাংশ। সর্বস্তরে এই স্কুলছুট শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে স্কুলছুটের সংখ্যা বেশি। যথারীতি সরকারি প্রতিবেদনে এই বিশাল পরিমাণ স্কুলছুটের কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ড্রপ আউটের সংখ্যা বিপজ্জনক হারে বেড়েছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্নাতক স্তরে ভর্তির ক্ষেত্রে। বহু সম্ভাবনাময় মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী এখন পরিস্থিতির শিকার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পাস থেকে।
শিক্ষক পদে বড় সংখ্যায় ঘাটতি শিক্ষায় সঙ্কটের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। সারা দেশে ১ লক্ষ ১০ হাজারেরও বেশি স্কুলে সকল গ্রেডের শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একজন শিক্ষক আছেন। তাছাড়া শিক্ষকদের একটা বড় অংশের যথাযথ প্রশিক্ষণের কোনও সরকারি সুযোগই নেই। পঠন-পাঠনের বিষয়ে সর্বাধিক অবহেলার এটাই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পশ্চিমবঙ্গে শূন্য বা একজন শিক্ষক আছেন ২২১৫ টি প্রাথমিক স্কুলে। শিক্ষায়, বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগে ও কেন্দ্রীয় মূল্যায়ন পদ্ধতিতে দুর্নীতি এখন সর্বজনবিদিত। নিট সহ একাধিক পরীক্ষা বাতিল হয়েছে দুর্নীতির কারণে। এ রাজ্যের স্কুল শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতি তো দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির শিরোপা পেয়েছে। এখনো সর্বোচ্চ আদালতের বিবেচনায় অপেক্ষা করছে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্তরের ৩২ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ। হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে এই নিয়োগ দুর্নীতির আড়ালে। স্বাধীনতা উত্তরকালে শিক্ষায় এহেন বিপর্যয় এরাজ্যে আগে কখনো ঘটেনি। তবুও সরকার ও শাসক দল নির্বিকার চিত্তে নিজেদের অপরাধ ঢাকতে, দাগি শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের হয়ে সওয়াল করে যাচ্ছে। সবচাইতে বেশি বিড়ম্বনার শিকার এই সময়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। অস্তিত্বের বিপন্নতায় ভুগছেন বড় অংশের শিক্ষক।
স্কুলগুলিতে আর একটি সমস্যা হলো, অধিকাংশ স্কুলে পর্যাপ্ত জায়গার অভাব। প্রয়োজন অনুযায়ী ক্লাস রুম নেই, চেয়ার টেবিল বেঞ্চ ইত্যাদি আনুষঙ্গিক উপাদানেরও বড়ই অভাব। অল্প হলেও প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় বেশ কিছু স্কুল আছে যাদের নিজস্ব বাড়ি নেই, অনেক সময় গাছ তলাই ভরসা। তাছাড়া বহু স্কুলের সঙ্গে এখনো যোগাযোগের রাস্তা যথাযথভাবে গড়ে ওঠেনি। যে কারণে বর্ষায় এবং অন্যান্য দুর্যোগে বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছাতে যথেষ্ট অসুবিধা হয়। এখনো এমন বহু স্কুল আছে যেখানে ছেলে-মেয়ের আলাদা শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। যে শৌচাগার আছে তাও অপরিচ্ছন্ন এবং চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার ন্যূনতম বন্দোবস্তও নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। ১০.১৭ লক্ষ সরকারি স্কুলের মধ্যে মাত্র ৩.৩৭ লক্ষ (৩৩.২ শতাংশ) স্কুলে প্রতিবন্ধী-বান্ধব শৌচাগার রয়েছে এবং এর মধ্যে মাত্র ৩০.৬ শতাংশ স্কুল কার্যকর। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইউনিফায়েড ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন (ইউডিআইএসই) একটি দেশব্যাপী ব্যবস্থাপনা তথ্য এবং ডাটাবেস যা শিক্ষা বিষয়ক পরিকল্পনা, নীতি নির্ধারণ এবং সম্পদ বরাদ্দে সহায়তা করার জন্য স্কুল, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করে। এদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ সালে ভারতের ১৪.৭১ লক্ষেরও বেশি স্কুলের মধ্যে (যার মধ্যে ১০.১৭ লক্ষ সরকারি স্কুল) প্রায় ১.৫২ লক্ষ স্কুলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে ৯.১২ লক্ষ স্কুলে বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যকর। সরকার পরিচালিত স্কুল ছাড়াও, ৪.৫৪ লক্ষ সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত, বেসরকারি, অনুদানবিহীন এবং অন্যান্য স্কুল রয়েছে, যার মধ্যে ৪.০৭ লক্ষ স্কুলে বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যকর। ওই ১৪.৭১ লক্ষ স্কুলের মধ্যে মাত্র ৭.৪৮ লক্ষ (৫০ শতাংশ) স্কুলে শিক্ষাদান এবং শেখার জন্য কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। ৭.৯২ লক্ষ স্কুলে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এটি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ডিজিটাল নলেজ বৈষম্যের এটি অন্যতম কারণ।
দেশের মানুষের মধ্যে আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেছে। আয় ও সম্পদ বণ্টনের চূড়ান্ত অসমতার প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী বর্তমান প্রজন্মের এইসব শিক্ষার্থীরা। ভারতের জিডিপি দেখে দেশবাসীর প্রকৃত জীবনমান অনুমান করা সম্ভব নয়। এর বড় কারণ হল এদেশের আয় ও সম্পদ বণ্টনের গুরুতর বৈষম্য। দেশের সার্বিক বিকাশ অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রগতি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর অন্তর্ভুক্তির সুযোগ খুবই সীমিত। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রকাশিত এই ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স বা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে দেখা যাচ্ছে, উন্নয়নশীল ৭৪ টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ৬২ তম। শুধু চীন নয়, প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা, নেপালও এক্ষেত্রে ভারতের থেকে এগিয়ে। এদেশে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে, সর্বপ্রথম আয় ও সম্পদ উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করে কর-কাঠামোর পুনর্গঠন জরুরি, যাতে সরকারি কোষাগার পুষ্ট হয় এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি ও অন্যান্য মৌলিক পরিষেবায় সরকারি বিনিয়োগ অনেকটা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ শুধু আয় নয়, সম্পদের উপরও কর আরোপ করতে হবে। বর্তমানের এই বৈষম্য কমাতে মুষ্টিমেয় কিছু গোষ্ঠী ও পরিবারের কাছে বিশাল আকারে কেন্দ্রীভূত সম্পদকেও করের আওতায় আনা জরুরি। আয় ও সম্পদ করের পাশাপাশি সম্পদ হস্তান্তরের মাধ্যমে মালিকানা বজায় রাখার কৌশল বন্ধ করার জন্য উত্তরাধিকার কর আরোপ করা দরকার। এইভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থের যোগান বাড়িয়ে শিক্ষায়, বিশেষত বুনিয়াদি শিক্ষা কার্যক্রমে সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব। তবেই শিক্ষা বাঁচবে, দেশ বাঁচবে।
Comments :0