RSS - Mamata

মমতার ‘শহীদ’ তালিকায় আরএসএস’র কর্মী!

রাজ্য

তৃণমূলের ‘শহীদ’ আসলে স্বয়ংসেবক! ২৪ বছর পর প্রকাশ্যে স্বীকার করে বসলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। 
আর একবার স্পষ্ট হলো তৃণমূলের সৃষ্টির পর থেকেই জনযুদ্ধ, এমসিসি’র মতো আরএসএস-ও মমতা ব্যানার্জির হয়ে কাজ করেছে পশ্চিমবঙ্গে।
চলতি বছরে হিন্দুত্ববাদী আরএসএস তার শতবর্ষ পালন করছে। সেই উপলক্ষে দেশে বিভিন্ন সময়ে তারা কী কৌশলে এগিয়েছে তা বর্ণনা করে নানা প্রবন্ধ তারা প্রকাশ করছে। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৩৯-এ তাদের শাখা শুরু উত্তর কলকাতায়। কিন্তু ২০১১-এর আগে পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা পালন করা এই রাজ্যে সঙ্ঘ বিশেষ এগতে পারেনি। কারণ দেশভাগ, দাঙ্গার ক্ষত সামলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বরাবর দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঘাঁটি হিসাবে নিজেদের রাজ্যকে গড়ে তুলেছেন। সেই কাজে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসাবে কাজ করেছেন বামপন্থীরা, বামপন্থী ছাত্র, মহিলা, কৃষক, শ্রমিক এবং যুবরা।
দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণাতন্ত্রিক আন্দোলনের এই অগ্রবর্তী ঘাঁটিকে সঙ্ঘ তথা বিজেপি’র হাতে তুলে দেওয়ার রাস্তা বানানোর জন্য ১৯৯৮-এ তৃণমূলের সৃষ্টি। যা ইতিমধ্যেই বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য স্বীকার করে বলেছেন যে, তৃণমূলের জন্মের সময় লেবার রুমে দাঁড়িয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদবানি। তৃণমূল তৈরিই হয়েছিল আরএসএস, বিজেপি’র সাহায্যে। ১৯৯৮-এ তৃণমূল তৈরি করেই মমতা ব্যানার্জি বামফ্রন্ট সরকারকে হটাতে ‘বাংলা বাঁচাও ফ্রন্ট’ করেন। সেই ফ্রন্টে তাঁর শরিক ছিল বিজেপি। পরবর্তীকালে তিনি বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন বারবার। গুজরাটের নৃশংস মুসলমান-নিধনের পরে নরেন্দ্র মোদী ফের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন বিধানসভা নির্বাচনে। মমতা ব্যানার্জি তখন তাঁকে গোলাপ ফুলের তোড়া পাঠিয়েছিলেন। 
সেই সময়েই অর্থাৎ ১৯৯৮ থেকে ২০০১— এই সময়ে পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলী, বাঁকুড়ার সীমান্তে তৃণমূল-বিজেপি-জনযুদ্ধ মিলে একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে। যারা ওই এলাকার প্রায় ৩২টি বিধানসভা এলাকা দখল করার চক্রান্ত করে। তারা ওই বিস্তীর্ণ এলাকার একের পর এক গ্রাম দখল করে অস্ত্রের জোরে। মমতা ব্যানার্জিদের ভাষায় তা ছিল ‘কেশপুর লাইন।’ বিভিন্ন সভায় আজকের মুখ্যমন্ত্রী তখন বলতেন,‘কেশপুর হবে সিপিএম-এর শেষপুর’,‘চমকাইতলায় চমকে দেবো’ ইত্যাদি। মানুষের সাহায্যে সিপিআই(এম)’র কর্মীরা সেই আক্রমণ প্রতিহত করেন। মানুষ তৃণমূল-বিজেপি-জনযুদ্ধ-র মিলিত বাহিনীর অত্যাচারে বিধ্বস্ত হয়ে প্রথমে কিছুদিন মুখ বুজে থেকে ছিলেন। পরে নিজেরাই রুখে দাঁড়ান এবং সেই জোটের বাহিনীকে গ্রামছাড়া করেন। 
সেই দ্বন্দ্বে বেশ কয়েকজন তৃণমূল-বিজেপি-জনযুদ্ধর কর্মীকে জনরোষে নিহত হয়। আবার অনেকে মানুষের কাছে আত্মসমর্পণ করে। যে দুর্বৃত্ত, গ্রামদখলকারীরা সেদিন জনরোষে নিহত হয়েছিলেন তাদের অনেকের নাম তৃণমূলের ‘শহীদ তালিকা’য় আছে। ২০০৪-এ মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা ব্যানার্জি একটি ‘শহীদ তালিকা’ তাঁকে দিয়ে সিপিআই(এম) কত অত্যাচারী তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই তালিকায় গড়বেতার জনযুদ্ধ নেতা অসিত সরকারের নামও ছিল। আবার বারুইপুরে তখন বেঁচে থাকা তৃণমূল নেতা অরূপ ভদ্রর নামও ছিল। এমন আরও অনেক উলটো পালটা নাম সেই তালিকায় রেখে তালিকাকে লম্বা করতে চেয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। বিরোধীরা অনেকেই বলেন যে, এত মিথ্যাচারের জন্যই তাঁকে সিপিআই(এম) নেতা গৌতম দেব ‘প্যাথলজিকাল লায়ার’ বলেছিলেন। 
তৃণমূলের সেই শহীদ তালিকায় হুগলীর ৩৪ জনের নাম আছে। অর্থাৎ ওই জেলায় বামপন্থীদের আক্রমণে তৃণমূলের ৩৪ জন খুন হয়েছিলেন বলে মমতা ব্যানার্জিদের দাবি। সেই তালিকার ১৯ এবং ২৬নং-এ  নাম আছে দয়াল সিংহ রায়ের। একই ব্যক্তির দু’জায়গায় নাম কেন, এর ব্যাখ্যা তৃণমূলের নেতাদের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। 
সেই দয়াল সিংহ রায়কে আরএসএস স্ববংসেবক বলে দাবি করেছে ২৪ বছর পর!
শতবর্ষে ‘কত কাঁটা বিছানো’ পথ বেয়ে পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস-কে এগতে হয়েছে, তার অনেকগুলি বিবরণ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে সঙ্ঘের বিভিন্ন পুস্তিকায়। সঙ্ঘের বাংলায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক মুখপত্রর সংখ্যায় এমন তিনটি প্রবন্ধ আছে। প্রতিটি প্রবন্ধেই সঙ্ঘ দাবি করেছে যে, বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে সিপিআই(এম) এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীতে আরএসপি, সিপিআই(এম) মিলে সঙ্ঘের উপর মারাত্মক হামলা চালিয়েছে। বামফ্রন্টের সময়ে রাজ্যে হিন্দুত্ববাদ মাথাচাড়া দিতে না পারার ক্ষেত্রে ‘সিপিএম-এর অত্যাচার’কেই দায়ী করেছে তারা। সঙ্ঘের প্রবন্ধগুলির মোদ্দা কথা— সিপিআই(এম)’র সাংগঠনিক শক্তি এবং রাজ্যের তৎকালীন সরকারের ভূমিকার সামনে রামমন্দির-আন্দোলন, গুজরাট দাঙ্গার সময়েও তারা মাথা তুলতে পারেনি। 
যা গত ১৫ বছরে মমতা ব্যানার্জির শাসনে তারা পেরেছে। তারা রাজ্যে ছড়াতে পেরেছে। কিন্তু ১৯৯৮ থেকেই মমতা ব্যানার্জির পাশে থেকে তাদের স্বয়ংসেবকরা সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীদের বিরোধিতা করেছে, এমনকি ‘কেশপুর-লাইন’-এর সময় সেই হামলার দিনগুলিতেও তারা তৃণমূলের বাহিনী হিসাবেই কাজ করেছে, তা সঙ্ঘের মুখপত্রের একটি প্রবন্ধে স্পষ্ট। ‘বঙ্গের সঙ্ঘকাজে স্বয়ংসেবকদের বলিদান ও আত্মত্যাগের ইতিহাস’ শীর্ষক ওই প্রবন্ধে সঙ্ঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে হুগলীর জগন্নাথপুরে ২০০১-এর ১৩ এপ্রিল খুন হন দয়াল সিংহরায়। তিনি স্বয়ংসেবক ছিলেন। তাঁর বাড়ির লোকও নাকি সঙ্ঘের সমর্থক, এমন দাবি সঙ্ঘ করেছে। সঙ্ঘ জানিয়েছে যে, দয়াল তাদের ‘তৃতীয় বর্ষ শিক্ষিত’ স্বয়ংসেবক ছিলেন।
প্রশ্ন উঠেছে একটিই—সঙ্ঘ এতদিন এটি গোপন রেখেছিল কেন? পাশাপাশি একটি বিষয় আরও স্পষ্ট হয়েছে যে, স্বয়ংসেবকরা তৃণমূলের কর্মী হয়েছিলেন, তাদের বাহিনীর সক্রিয় কর্মী হতে শুরু করেছিলেন অনেক আগে থেকেই।

Comments :0

Login to leave a comment