দেবাশিস মিথিয়া
গত ৪ জানুয়ারি শনিবার সারা দেশের অর্থমন্ত্রীদের সঙ্গে প্রাক বাজেট বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান। সেই বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের তরফে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের কৃষি মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। মিটিংঙে তিনি ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা (পিএমএফবিওয়াই)’-র পরিবর্তে রাজ্যের নিজস্ব শস্য বিমার উপর জোর দিয়েছেন। দেশের কৃষি প্রকল্পগুলিতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি তুলেছেন। বৈঠকের পরে তিনি সাংবাকে বলেন, "আমাদের কোনও কৃষককে আত্মহত্যা করতে হয় না। কৃষকবন্ধু, মৃত্যুকালীন আর্থিক সুবিধা, কৃষি পেনশন, শস্য বিমা, সুলভে কৃষি যন্ত্রাংশ প্রদান ইত্যাদির মতন সুবিধা রাজ্য সরকার দিচ্ছে। রাজ্যের কৃষকদের আর্থিক পরিস্থিতি দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো।"
সত্যিই কি তাই? রাজ্যের প্রায় ৮৬ শতাংশ চাষি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। ফলে কৃষি ঋণের সমস্যা, ফসল নষ্ট, সরকারের অপ্রতুল সাহায্য কার্যত তাঁদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। প্রতিদিন বাঁচার জন্য সেই চাষিদের লড়াই করতে হচ্ছে। ঋণের দায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। অথচ সরকার বলছে রাজ্যে কোনও কৃষকের আত্মহত্যা নেই । তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে কৃষকদের কয়েকটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় নজর দিলে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।
হুগলী জেলার চুঁচুড়া এলাকায় ৫০ বছর বয়সি কৃষক প্রদীপ মণ্ডল, ফসল নষ্টের কারণে আর্থিক সঙ্কটে পড়েন। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ২০১৮ সালে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ২০১৯ সালে বীরভূম জেলার পানরুই গ্রামের ৪৫ বছর বয়সি চাষি শ্যামল সাঁতরা, মহাজনের কাছ থেকে চাষের জন্য ১.৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। তা পরিশোধ করতে না পেরে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ডিসেম্বর ২০২৩, সাইক্লোনের ফলে দু’দিনের অকাল বৃষ্টিতে হুগলী, বর্ধমান এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে সদ্য চাষ করা আলু ও বোরো ধানের সবটা জলের তলায় চলে যায়। সদ্য জন্মানো ফসলের ছোট ছোট চারাগুলির বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের পাঁচজন সেইসময় আত্মহত্যা করেন। সেই তালিকায় রয়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনার, লাহেরগুং মৌজার ৩২ বছর বয়সি বাপি ঘোষ। তিনি মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ১,৭৫,০০০ টাকা ঋণ নিয়ে আলু চাষ করেছিলেন। ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে না পেরে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। একইভাবে হুগলির আরামবাগের ৭১ বছর বয়সি চাষি জয়দেব সরকার, বাতানল সমবায় সমিতি থেকে আড়াই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আট বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলেন। তাঁর সমস্ত ফসল নষ্ট হওয়ায় বাড়ির সিলিং ফ্যানে গলায় ফাঁস দিয়ে জীবন শেষ করেন। এরকম ঘটনার শেষ নেই!
তবে মৃত্যুগুলি পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে – ‘পারিবারিক গণ্ডগোলে আত্মহত্যা’ এই মর্মে। রাজ্য সরকার কয়েক বছর ধরে কৃষকদের আত্মহত্যাগুলিকে এইভাবে দেখানোয় ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো, ২০২২-এর তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে কোনও কৃষকের আত্মহত্যা নেই৷ তবে, আরটিআই করে জানা গেছে ২০২১ সালে শুধুমাত্র পশ্চিম মেদিনীপুরেই ১২২ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। ২০১১ সালের পর থেকে রাজ্যের ‘রাইস বোল’বলে পরিচিত বর্ধমান জেলাতে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল অনেক। ঘটনাগুলি থেকে পরিষ্কার, কৃষিমন্ত্রী ‘রাজ্যের কৃষকদের আত্মহত্যা করতে হয় না’, বলে জাতীয় প্রেসকে যা জানালেন তা সঠিক নয়।
নাবার্ডের ‘অল ইন্ডিয়া রুরাল ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশান সার্ভে, ২০২১-২২’ অনুযায়ী ভারতে কৃষি পরিবারগুলির মাসিক আয়ের জাতীয় গড় ১৩,৬৬১ টাকা। ওই একই সময়ে পাঞ্জাবের একটি কৃষি পরিবারের গড় মাসিক আয় ছিল ৩১,৪৩৩ টাকা, হরিয়ানায় ২৫,৬৫৫ টাকা। নাবার্ডের তথ্য অনুসারে, ওই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের কৃষক পরিবারের গড় মাসিক আয় ছিল মাত্র ৭,৫৭৩ টাকা। তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের চাষিদের মাসিক গড় আয় পাঞ্জাব হরিয়ানার চাষিদের মাসিক গড় আয়ের তুলনায় অনেকটাই কম। এমনকি কৃষকদের মাসিক আয়ের যে জাতীয় গড় তার থেকেও কম। 'রাজ্যের কৃষকদের আর্থিক পরিস্থিতি দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো' - মন্ত্রীর এই দাবি কতটা অসত্য, তা প্রমাণিত হয় উপরের কয়েকটি তথ্য।
প্রাক্ বাজেট বৈঠকে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী রাজ্যগুলিকে ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা’কার্যকর করার (পশ্চিমবঙ্গ তা করেনি) প্রস্তাব দেন। রাজ্যের হয়ে কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় সভায় বলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার পরিবর্তে ‘বাংলা শস্য বিমা’, চালু করেছে। বিমার প্রিমিয়ামের পুরো টাকা দিচ্ছেন রাজ্য সরকার। তিনি আরও বলেন, বাংলা ফসল বিমার কার্যকারিতা কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার তুলনায় অনেক বেশি। তা ছাড়া স্যাটেলাইট ছবির মাধ্যমে যাচাই করে বিমার ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু বাংলা ফসল বিমা নিয়ে যে ঢক্কানিনাদ তার অনেকটাই অসত্য। সরকার সেই অসত্যকে ভাঙিয়ে দলীয় ভোট ব্যাঙ্ক নিশ্চিত করছে। আর রাজ্যের কৃষি মন্ত্রী সেই অসত্যটাই অন্যান্য রাজ্যের আমলা মন্ত্রীদের সামনে বলে এলেন। গত ৮ জানুয়ারি, মুখ্যমন্ত্রীর এক্স হ্যান্ডেলের পোস্ট সেটাকেই মান্যতা দিয়েছে। তিনি লিখেছেন, “অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, ‘বাংলা শস্য বিমা’ প্রকল্পের আওতায় আমরা বাংলার ৯ লক্ষ কৃষককে সরাসরি তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৩৫০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান শুরু করলাম। চলতি খরিফ মরশুমে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে যে সকল কৃষকের চাষের ক্ষতি হয়েছিল, তাঁদের এই সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ফসলের বিমার জন্য কৃষকদের কোনও টাকাও দিতে হচ্ছে না। কারণ, আলু, আখ সহ সব ফসলের প্রিমিয়ামের পুরো টাকাই রাজ্য সরকার দেয়”।
রাজ্য সরকারের প্রধান থেকে ছোট বড় সবাই প্রচার করছেন, বাংলা শস্য বিমাতে চাষিকে কোনও প্রিমিয়াম দিতে হয় না। এটা একেবারেই ঠিক নয়। রবি মরশুমে আলু ও আখ চাষের জন্য বিমা করতে হলে প্রিমিয়াম দিয়েই বিমা করতে হয়। সেই বিমার প্রিমিয়াম বেশ চড়া । যা প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার থেকেও বেশি। যেমন, ২০২৪-২৫ সালে রবি মরশুমে, পিএমএফবিওয়াই প্রকল্পে, উত্তর প্রদেশের ফারুখাবাদ জেলায় আলুর বিমায় বিমাকৃত রাশির পরিমাণ হেক্টর প্রতি ১,৮৫০০০ টাকা। অ্যাকচুরিয়াল (বিমার ঝুঁকির হিসাব) হার চাষির জন্য ২ শতাংশ, ফলে বিমার প্রিমিয়াম ৩৬১০ টাকা অথচ ‘বাংলা ফসল বিমা’তে বাঁকুড়া জেলায়, ওই একই পরিমাণ জমিতে বিমাকৃত রাশির পরিমাণ ১,৭৪,১৩৫ টাকা কিন্তু অ্যাকচুরিয়াল হার ৫ শতাংশ হওয়ায় প্রিমিয়াম প্রায় ৮৭০৭ টাকা।
মুখ্যমন্ত্রীর পোস্টে পরিষ্কার করে লেখা ফসল নষ্ট হ'লে কৃষকদের ‘আর্থিক সহায়তা’দেওয়ার কথা, এখানেই বাংলা শস্য বিমার সবচেয়ে বড় কারচুপি।
পশ্চিমবঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনও কারণে ফসল নষ্ট হলে বিমাকারী চাষিকে তার বিমার প্রাপ্য টাকা ফেরত দেওয়ার পরিবর্তে সরকার কৃষকদের অনুদান দিতে বেশি উৎসাহী। এর পিছনে অন্য কারণ লুকিয়ে আছে। এগ্রিকালচারাল ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলি ক্ষতিপূরণের দাবি মেটানোর পর উদ্বৃত্ত প্রিমিয়ামের ২০ শতাংশ নিজেদের কাছে রেখে অতিরিক্ত অর্থ সরকারকে ফেরত দেয়। ফলে বিমা কোম্পানিগুলি ক্ষতিপূরণ যত কম দেবে উদ্বৃত্ত প্রিমিয়াম তত বাড়বে। ঘুর পথে সেই টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরত যায়। গত ২০২১-২২ সালে বাংলা ফসল বিমার প্রিমিয়ামের উদ্বৃত্ত ৪৩৪ কোটি টাকার প্রায় ৩৪৮ কোটি টাকা রাজ্য সরকারের কোষাগারে গিয়েছে। তাই বিমা কোম্পানিগুলি ফসলের নষ্টের পর বিমাকৃত রাশি চাষিকে না দিলেও সরকার খুব একটা কড়া পদক্ষেপ নেয় না। উলটে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্য নষ্ট হলে সরকার দ্রুত ( নির্দিষ্ট এলাকার জন্য) একর প্রতি একটা অনুদান ঘোষণা করে দেয়। মুখ্যমন্ত্রীর পোস্ট থেকেও পরিষ্কার, ফসল নষ্টের জন্য রাজ্য সরকার চাষিদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। মনে রাখা দরকার, সহায়তা হচ্ছে দয়া কিন্তু ফেরত যোগ্য বিমাকৃত রাশি চাষির হকের পাওনা। সহায়তার বিপদ হচ্ছে, সবটাই মরজি মাফিক। সরকার চাইলে দিতেও পারেন আবার নাও দিতে পারেন। সেরকমই একটি ঘটনা - বুলবুল সাইক্লোনের কারণে ধান রোয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই বাঁকুড়া কোতলপুরের সনাতন কোলের, সমস্ত ফসল বৃষ্টির জলে ভেসে যায়। বিমা থাকা সত্ত্বেও, তিনি কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি। সেই সময় সরকার ৬টি জেলায় প্রতি হেক্টরে ১৩,৩৪৩.৭০ টাকা (৫৪ টাকা প্রতি শতক) অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। হুগলী জেলা অনুদানের তালিকায় থাকলেও লাগোয়া জেলা বাঁকুড়া সেই তালিকা থেকে বাদ পড়ে। সনাতন বাবু, বাঁকুড়ার মানুষ হওয়ায় সরকারের অনুদান থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন।
মজার বিষয় হলো, বাংলা ফসল বিমার ফর্মে কোথাও এই বিমার প্রিমিয়াম ও বিমাকৃত রাশির উল্লেখ নেই। ফলে, 'বাংলা ফসল বিমায়’বিমাকারী চাষি জানেনও না তার নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির পুরো ফসল নষ্ট হলে তিনি বিমা কোম্পানির কাছ থেকে কত টাকা ফেরত পাবেন। অর্থনীতিতে এটাই বিমার ‘হিডেন ইনফরমেশন'। বাংলা ফসল বিমার এটা একটা অন্যতম ফাঁকি। বাকি ফসলের কথা বাদ দিলাম, আলু ও আখের ক্ষেত্রে নিজের টাকা দিয়ে বিমা করার পরও ফসল নষ্ট হলে চাষিকে সরকারের অনুদানের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এর চেয়ে যন্ত্রণার আর কী হতে পারে!
বাংলা ফসল বিমার প্রয়োগগত ত্রুটি যেমন আছে তেমন রয়েছে প্রশাসনিক মারপ্যাঁচ, যা চাষিদের ক্ষতি করছে। ফসল বিমা করতে গেলে, ব্লকের কৃষি আধিকারিকদের ফসল বোনার শংসাপত্র দিতে হয়। তাতে জানাতে হয়, চাষি যে ফসলের বিমা করছেন প্রকৃতই তিনিই চাষ করেছেন বা চাষ করতে ইচ্ছুক। ব্লকের কর্মীর অভাবে জমিতে গিয়ে সরেজমিনে খতিয়ে দেখার উপায় নেই। তাই কৃষি আধিকারিকরা শংসাপত্রে বলে দিচ্ছেন চাষ করতে ইচ্ছুক। এতে বিপত্তি অন্যরকম। রবি মরশুমে আলু বা আখের জন্য কৃষি ঋণ পাওয়া সহজ। তাই অভাবী চাষি আলু বা আখ চাষের নামে ঋণ নিয়ে সেই টাকা মেয়ের বিয়ে বা ছেলের শিক্ষায় ব্যয় করছেন। এতে বিপত্তি হলো, ঋণ মঞ্জুর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্ক জমির পরিমাণ অনুযায়ী ফসল বিমার প্রিমিয়াম কেটে নিচ্ছে, যা চাষির কোনও কাজে লাগছে না। এটা আটকানো যেত, যদি বিমার অফিসিয়াল কাগজপত্রের কাজটা ঠিক মতন হতো।
নিখরচায় বাংলা শস্য বিমা— এই বলে যতই প্রচার হোক, বাস্তবে চিত্রটা অন্য। প্রয়োগের খামতিতে ক্ষতিগ্রস্ত চাষি সঠিক ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত। এছাড়া, বাংলা শস্য বিমা সম্পর্কে চাষির অজ্ঞদের রেখে তাঁদেরকে ঠকানো হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ফলে চাষি যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়েছেন। শস্য বিমা কেন্দ্র বা রাজ্য, যে স্তরেই গৃহীত হোক না কেন, তা কি আদৌ কৃষক বান্ধব? সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
Comments :0