চাঁদের দক্ষিণ মেরু স্পর্শ করেছে চন্দ্রযান-৩। বুধবার বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে এই নজির স্থাপন করেছে ভারত। রোভার বিক্রমের মধ্যে থাকা প্রজ্ঞান চাঁদের ভূপৃষ্ট থেকে সংগ্রহ করবে নানা বৈজ্ঞানিক উপাদান। সেই উপাদানগুলির সাহায্যে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালাবেন চাঁদের মাটিতে প্রাণের সন্ধান পাওয়ার। প্রজ্ঞান খোঁজ চালাবে জলের।
কিন্তু তার মধ্যেও উঠছে কয়েকটি প্রশ্ন। চন্দ্রযান-৩ চাঁদের মাটি স্পর্শ করার সঙ্গেসঙ্গে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। এই মুহূর্তে ব্রিকস্ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির সম্মেলনে যোগ দিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়েছেন তিনি। সেখান থেকেই ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে ইসরোর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন মোদী।
মোদী বলেছেন, ‘‘বিশ্বের কোনও দেশ এর আগে চাঁদের এই অঞ্চলে পা রাখতে পারেনি। এবার থেকে চাঁদ নিয়ে সমস্ত গল্প এবং রূপকথা বদলে যেতে চলেছে। সেইদিন খুব দূরে নয়, যখন শিশুরা চাঁদ মামা দূরে আছে না বলে, বলবে, চাইলেই চাঁদ মামার ট্যুর করে আসা যায়।’’
একইসঙ্গে আগামীদিনে সূর্য অভিযানে যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন মোদী।
রাজনৈতিক মহলের কানাঘুষো, ২০২৪’র লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে সরকারের সাফল্যের অন্যতম খতিয়ান হবে চন্দ্রযান-৩’র সাফল্য। আর সেই সাফল্যের কেন্দ্রীয় পুরুষ হিসেবে তুলে ধরা হবে নরেন্দ্র মোদীর কৃতিত্ব।
কিন্তু এই প্রকল্পের আসল কৃতিত্ব তো বিজ্ঞানীদের। বিজ্ঞানী তৈরি হয় দেশের উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে। সেই কেন্দ্রগুলির গবেষণাগারে, লাইব্রেরিতে। এই মুহূর্তে কেমন আছেন সেই হবু বিজ্ঞানীরা, যাঁদের হাত ধরে আগামী দিনে চন্দ্র, সূর্য হয়ে অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্রকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবে ভারতবর্ষ?
দেশের বিজ্ঞানচর্চার এগিয়ে থাকা কেন্দ্রগুলির অন্যতম হল আইআইএসইআর। মোহালি, পুনে, ভোপাল, কলকাতা সহ দেশের নানা প্রান্তে রয়েছে আইআইএসইআর ক্যাম্পাস। ২০১৮ সালে সেই আইআইএসইআর’র গবেষক পড়ুয়ারা বিক্ষোভ দেখান। কারণ, তাঁদের স্কলারশিপ কমানো হয়েছে, একইসঙ্গে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পড়াশোনা এবং হোস্টেলে থাকার খরচ। পড়ুয়াদের অভিযোগ ছিল, তাঁরা গবেষক। গবেষণার পরে চাকরি মিলবে এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই তাঁদের পক্ষে স্টুডেন্ট লোন নিয়ে পড়াশোনা করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাঁদের স্কলারশিপ কমিয়ে দিয়ে খরচ বাড়িয়ে দেওয়ার ফলে তাঁরা বাধ্য হবেন গবেষণা শেষ না করেই পড়ুয়া জীবনে ইতি টানতে।
এই সমস্যা কেবল আইআইএসইআর’র ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। দেশের সমস্ত উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রের বরাদ্দ কমিয়েছে কেন্দ্র। ২০১৪ সালের আগে থেকে এই ঘটনা ঘটলেও, এই ‘ফান্ড কাটের’ প্রক্রিয়া তীব্র গতি ধারণ করে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পরে।
চলতি বাজেটেও গবেষণা খাতে বরাদ্দ কমানোর কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে ৬.৮৭ শতাংশ। শিক্ষা মহলের বক্তব্য, বরাদ্দের গোটাটা হাতে এসে পৌঁছয় না। তাই সরকার খাতায় কলমে ৬.৮৭ শতাংশ বরাদ্দ কমালেও, বাস্তবে তার পরিমাণ অনেকটাই বেশি।
সাধারণত, চলতি অর্থবর্ষের বরাদ্দ সরকারের থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে পেয়ে থাকে শিক্ষাকেন্দ্রগুলি। গত বছরের ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট জমা দিলেও এই বছর সেটা ঘটেনি। তার ফলে আইআইএসইআর থেকে শুরু করে আইআইটি হয়ে আইআইএসসি- সমস্ত জায়গাতেই থমকে রয়েছে কাজ। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি কেনার কাজ আটকে রয়েছে। বহু ক্ষেত্রে কয়েক মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে গবেষণার কাজে যুক্ত কর্মচারীদের।
কেবল এই শিক্ষার উৎকর্ষ কেন্দ্রগুলি নয়। গবেষণার কাজ সমস্যা দেখা দেয় বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়েও।
কিন্তু তহবিল কেন পাঠানো হয়নি? কেন্দ্রের যুক্তি ভারি সুন্দর। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের দাবি, এই প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যাঙ্কে জিরো ব্যালেন্স অ্যাকাউন্ট খোলেনি। তাই টাকা পাঠানো হয়নি!
এই প্রসঙ্গে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির গবেষক এসসি লাখোটিয়া জানিয়েছিলেন, সরকারকে বুঝতে হবে রাস্তা কিংবা ব্রিজের বরাদ্দের সঙ্গে গবেষণা খাতের বরাদ্দকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। একদিন কাজ আটকে থাকা মানে বিশাল ক্ষতি হয়।
একই ছবির দেখা মিলবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে দেশের অন্যান্য প্রান্তেও। গবেষকদের অভিযোগ, বহুক্ষেত্রে নামমাত্র স্কলারশিপ মেলে। সেই টাকায় জীবনধারণ সম্ভব নয়। সেটাও অনিয়মিত এবং কমানো হচ্ছে প্রতি বছর। তাই ইচ্ছা থাকলেও গবেষণায় আসতে চাননা বহু কৃতি মেধাবী।
শিক্ষা মহলের উদ্বেগ, এই অনিশ্চয়তার কারণেই চলতি শিক্ষাবর্ষে রাজ্যের কলেজগুলিতে স্নাতকস্তরে বিজ্ঞান বিভাগে ৫০ শতাংশ আসনও ভর্তি হয়নি। বেশ কয়েক বছর ধরেই এই ধারা চলছে। দেশের অন্যত্রও একই ছবি। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে অনীহা।
শিক্ষা মহলের আশঙ্কা, এরফলে আগামী দিনে গবেষণা ক্ষেত্রে মেধার ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
গবেষক তৈরি না হলে আগামী দিনে নতুন চন্দ্রযান তৈরি করবেন কারা? মন্দিরে মন্দিরে আরাধ্য দেবতার মূর্তিতে দুধ ঢাললে কিন্তু রকেট বিজ্ঞানে জুড়ে থাকা নিষ্কৃতি বেগের অঙ্ক মেলে না। চন্দ্রযানের সাফল্যকে ঢাল করে তৈরি হওয়া নির্মাণে ভেসে যাওয়ার আগে এই বিষয় নিয়ে ভাবব না আমরা?
Comments :0