কাতার বিশ্বকাপে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে জাপান। গ্রুপ লীগে জার্মানি এবং স্পেনকে হারিয়ে, শেষ ষোলোতে পৌঁছে রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছে তারা। কিন্তু এই সাফল্য কি নিছকই ‘ফ্লুক’? নাকি এর পিছনে রয়েছে অন্য কোনও কাহিনী?
সালটা ২০০২। সেইবছর বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসেছিল জাপানে। আর সেইবছর থেকেই জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন নিজেদের গ্রাসরুট লেভেল ফুটবলের উন্নতিতে নজর দেওয়া শুরু করে। এই প্রোজেক্টের নাম দেওয়া হয় ‘মিশন ট্রিনিটি’।
প্রাথমিকভাবে মূলত ৬ থেকে ১০ বছরের ফুটবলারদের বাছাই করে নেওয়ার লক্ষ্যেই ছিল এই পদক্ষেপ। আর এই রোডম্যাপের সাহায্যে গোটা দেশে আরও বেশী করে ফুটবলপ্রসার ঘটেছিল। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতের জাতীয় দল তৈরির ক্ষেত্রেও এই পদক্ষেপ সাহায্য করেছিল । নতুন ফুটবলার তুলে আনার পাশাপাশি কোচেদের জন্য ট্রেনিং, উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে ফুটবলারদের অনুশীলন, ভিডিও অ্যানালিসিস, ফিটনেস, ডায়েট এবং আরও অনেক বিষয়কে সামনে রেখে এবং সেগুলির সঠিক পরিকল্পনা করে ভবিষ্যতের রুপরেখা তৈরি করাই ছিল জাপানের ফুটবল নিয়ামক সংস্থার প্রধান লক্ষ্য।
যতই সময় এগোতে থাকে, ১২ বছর এবং ১২ বছরের বেশী বয়সের ফুটবলাররাও আসতে শুরু করেন এই ছাতার তলায়। ২০০৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ২ লক্ষ, ৭৯ হাজার ১৩৪ জন ফুটবলার এই পদ্ধতির মাধ্যমে উঠে এসেছেন। যাদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে বেশ কয়েকটি স্ক্রিনিং পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে বাছাই হয়ে দেশের বিভিন্ন লীগে খেলেছেন। আমরা স্পেনের বিখ্যাত ক্লাব বার্সেলোনার লা-মাসিয়া অ্যাকাডেমীর কথা শুনেছি। জাপানের অনেক জায়গাতেও সেইরকম কিছু উদাহরণ তৈরি হয়। এই প্রকল্পের অঙ্গ হিসেবে গড়ে আবাসিক ফুটবল স্কুল এবং ক্যাম্প। নতুন সম্পদ তুলে আনার জন্য বিশেষ নজরদারি কমিটি গড়ে তোলে জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন।
শিশুদের স্কুলে যাওয়া, তাদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলে ফুটবলপ্রেমী শিশুদের উৎসাহ দেওয়া এবং বিভিন্ন ইভেন্টের মাধ্যমে তাদের মধ্যে সঠিক ফুটবলবোধ গড়ে তোলার কাজ চলে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে।
শুধু তাই নয়, দেশের রেফারিদের জন্য সঠিক ট্রেনিং স্কুল, স্পোর্টস সায়েন্স এবং ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে সঠিক মেধাকে তুলে আনা, এই সবকিছু আসলে এই রোডম্যাপকেই সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। দীর্ঘ বাছাইয়ের পর ৪৩,৪৫৯ জন ফুটবলারদের নিয়ে বিশেষ ক্যাম্প এবং ২০,৫৬৫ জন রেফারিদের নিয়ে স্পেশ্যাল ট্রেনিং-এর ব্যাবস্থা করে জাপান। প্রতিটি ফুটবলারের সামাজিক শিক্ষা, পড়াশোনা, আত্মবিশ্বাস, নিপুণ ফুটবলশৈলী, নতুন কিছু শেখার আগ্রহ, মানসিক স্থিতি সহ একাধিক বিষয়ের ওপরে কাজ করে জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন।
কিন্তু ক্লাব ফুটবল? আছে তো। জে-১, জে-২, জে-৩ ফুটবল লীগ ছাড়াও, জাপান ফুটবল লীগ, আঞ্চলিক লীগ, কোহোটু লীগ, কান্টো সকার লীগ, টোকাই লীগ এবং আরও বেশ কিছু টুর্নামেন্ট জাপান আয়োজন করে। ফলে ক্লাব ফুটবলের মাধ্যমে একদম বাছাই করা বিশেষ কিছু ফুটবলার উঠে আসেন, যাদের নিয়ে শক্তিশালী জাতীয় দল গড়ার কথা ভাবতে পেরেছিলেন কর্তারা। এই চলার পথে ফুটবলারদের বেতন এবং বাকি সমস্ত রকম সুযোগসুবিধা দেওয়া, সবটাই কিন্তু জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন সঠিকভাবে সামলাতে পেরেছে। তাই প্রত্যেক ফুটবলারের কর্মক্ষমতা বেড়েছে এবং নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন তাঁরা।
ফলাফল চোখের সামনেই রয়েছে। তাকেফুসা কুবো, কাওরু মিতোমা, তাকুমির মতো মিডফিল্ডার উঠে এসেছেন। কামাডা, ইওশিদা, হিরোকি, দাইচি, তাকেহিরো, তাকফুসা, কাওয়াশিমা, দানিয়েল এবং আরও অনেক তরুণ ফুটবলার ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের মঞ্চে জাপানের মুখ। ফরোয়ার্ড রিতসু দোয়ান, শক্তিশালী জার্মানি এবং স্পেনের বিরুদ্ধে গোল করে রীতিমতো সমর্থকদের কাছে নয়নের মণি হয়ে উঠেছেন। তাকুমা আসানো গোল করেছেন জার্মানির বিরুদ্ধে এবং আও তানাকা গোল করেছেন স্পেনের বিরুদ্ধে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে, তারুণ্যের মেলবন্ধনে বাজিমাৎ করা সম্ভব, যদি উপযুক্ত পরিকল্পনা থাকে।
কোচ মোরিইয়াসু হাজিমে, সহকারী সাইটো তোসিহিদে এবং পুরো কোচিং স্টাফদের টিমও জাপানের সেই “ট্রিনিটি” প্রোজেক্টের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছেন। অনেক ফুটবলার ইতিমধ্যেই দেশের বাইরের বিভিন্ন ক্লাবেও খেলে ফেলেছেন। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে, একটি দীর্ঘমেয়াদী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটেছে জাপান ফুটবলে। এবং সেই পরিকল্পনার সফল রূপই ফুটে উঠছে এবারের বিশ্বকাপে।
Comments :0