নীলোৎপল বসু
একটি চাঞ্চল্যকর বক্তৃতায় দেশজুড়ে ক্ষোভের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্যসভার অধিবেশনে দেশের সংবিধান সম্পর্কে আলোচনায় অমিত শাহ্কে যেভাবে মেজাজ হারাতে দেখা গেছে, তা কয়েক বছর আগে পর্যন্ত কল্পনাও করা যেত না। অবশ্য ইতিমধ্যে রক্তের স্বাদ পেয়ে যাওয়ায় আরএসএস-বিজেপি মনে করছে ওদের হিন্দুত্ববাদী সব কাজ সেরে ফেলবার জন্য এটাই একেবারে উপযুক্ত সময়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের চূড়ান্ত ফলাফল হিসাবে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের সংবিধানে তারই প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ভারতকে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার জন্য সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী আরএসএস’র পরিকল্পনাকে প্রতিরোধ করতে দেশের সংবিধান কার্যত গ্রানাইট প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।
লোকসভা নির্বাচনে তৃতীয়বারের জন্য জোট সরকার গঠন, সাংবিধানিক দপ্তরগুলিকে নিজেদের কবজায় রাখা, এমনকি একাধিক রাজ্যে সরকার পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে থাকা সত্ত্বেও দেশের সংবিধানকে কবরে পাঠিয়ে হিন্দুত্বের রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করার সাধ বিজেপির থাকলেও সেই সাধ্য যে নেই, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতির জন্য আরেকটি ধারণাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভারতে জাতিসত্ত্বার ধারণাটি মূলত স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে থেকে জন্ম নিয়েছে, যা প্রথম থেকেই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধারণাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই ঐক্য কার্যত একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, যুক্তরাষ্ট্রীয় ও নানাবিধ সংস্কৃতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করেই গড়ে উঠেছে। গোলওয়ালকর যেভাবে অহিন্দু ভারতবাসীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তাতে বৈচিত্রপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিতে সমান নাগরিকত্বের ধারণাটাই নাকচ হয়ে যায়, যা ভারতের নাগরিকত্বের ধারণার সাথে একেবারেই খাপ খায় না।
স্বাধীনতা উত্তর ভারতে সংবিধান প্রণয়নের মূল ভাবনাটি আগাগোড়া ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। এই ব্যবস্থায় ঈশ্বর ও ধর্মীয় আস্থার প্রশ্নটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের পরিসরে রয়ে গেলেও রাষ্ট্র ও তার নানাবিধ প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সেসবের কোনও প্রভাব ছিল না। আজকের ভারতে সেই ধারণাই ভযয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।
ঐ লক্ষ্য চরিতার্থ করতে এতদিন বিজেপির কৌশল ছিল কিছুটা অন্যরকম। একদিকে তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করত, অন্যদিকে ২৬ জানুয়ারি দেশের সাধারণতন্ত্র দিবসের পরিবর্তে তারা ২৫ নভেম্বর দিনটিকে সংবিধান দিবস হিসাবে তুলে ধরতে চাইত। ১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বর ডঃ বি আর আম্বেদকর সংবিধান পরিষদের তরফে আইনসভায় সংবিধানের খসড়া পেশ করেছিলেন। আম্বেদকরের কৃতিত্বকে তুলে ধরার পিছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল সংবিধান প্রণয়ন ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জওহরলাল নেহরুকে ছোট করে দেখানো। আম্বেদকর সম্পর্কে তাদের সেই ভালোবাসা নিয়ে কোনরকম মোহ থাকা উচিত না। আসলে নেহরুর মর্যাদাহানি করা ছাড়া বিজেপি’র অন্য কোনও উদ্দেশ্যই নেই।
বিজেপি’র দ্বিচারি রাজনীতি সম্পর্কে যারা অবহিত তারা খুব ভালো করেই জানেন আম্বেদকর কিংবা সংবিধান প্রসঙ্গে বিজেপিকে ভরসা করলে শেষে প্রতারিতই হতে হবে।
শাহের মন্তব্যের তাৎপর্য কী?
অমিত শাহ নিজের ভাষণে বলেছেন, আজকাল আম্বেদকরের নাম জপ করা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। তার ইঙ্গিত ছিল রীতিমত আক্রমণাত্মক এবং ব্যাঙ্গাত্মক। আম্বেদকরকে তুলে ধরার বিষয়টিকে তিনি আসলে উপহাস করেছেন। সেই উপহাসের মেজাজেই তার দ্বিতীয় মন্তব্য, এমন ভাবে যদি ঈশ্বরের জপ করায় তারা নিবিষ্ট হতো তবে জপকারী সপ্তম স্বর্গে পৌঁছানোর সুযোগ পেত। এই মন্তব্য আম্বেদকরের সমস্ত কীর্তিকেই বিকৃত এবং অপমানিত করে, বিশেষত যেখানে সংবিধান রচনায় বা পরিকল্পনায় ঈশ্বরের কোনও ভূমিকা ছিল না। সবশেষে স্বর্গে যাওয়া সম্পর্কিত যাবতীয় ভাষ্যই আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবাদর্শকেই তুলে ধরার চেষ্টা, যে ব্যবস্থাটাই আসলে সামাজিক বৈষম্যের জন্য দায়ী ।
শাহ্ যা বলেছেন তাকে আকস্মিক কোনও ঘটনা ভাবলে ভুল হবে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজব্যবস্থা ও মনুস্মৃতির আইনকে বৈধতা দিতে তাদের এই প্রচেষ্টা দীর্ঘদিনের। তিনি আম্বেদকর ও ভারতের সংবিধানের প্রতি আরএসএস’র সুপরিচিত ঘৃণারই বহিঃপ্রকাশ করেছেন। তাঁর এই মন্তব্য আমাদের সংবিধানের মূল নীতিগুলির বিরুদ্ধে তাদের মূল ধারণাকেই স্পষ্ট করে। সামাজিক ও লিঙ্গ সাম্যের ধারণাকে উল্টে দেওয়াই এই আক্রমণের লক্ষ্য, যে সমতার ধারণা আমাদের সংবিধানের মূল ভিত্তি।
হিন্দুত্ব - অসাম্য, বৈচিত্রবিরোধী এবং পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি
আম্বেদকর প্রণীত সাংবিধানিক কাঠামোর উপরে ভিত্তি করেই আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অমিত শাহ আম্বেদকর প্রসঙ্গে যা বলেছেন তাতে স্পষ্ট যে তিনি আম্বেদকরের কৃতিত্বকে খাটো করতে চেয়েছেন। ঈশ্বরের প্রতি আস্থা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রসঙ্গ হলেও মনে রাখতে হবে সংবিধান স্বীকৃত শাসনপ্রণালী কিন্তু যেকোনও ব্যক্তিগত মতামতের উপরেই স্থান পায়। তাই আম্বেদকরকে উপহাস করার অর্থ তার কৃতিত্বকেই অস্বীকার করা।
ভারতে দীর্ঘকাল ধরে জাতিভেদ প্রথার ভিত্তিতে সামাজিক বৈষম্যের ধারণা কার্যকারী আছে। ভারতীয় সমাজে এই বৈষম্যের শিকড় রয়েছে অনেক গভীরে। সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে চলা সমাজ প্রতিষ্ঠা করার কাজে আম্বেদকর নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেই কৃতিত্বকে নিছক ফ্যাশন বলে উপহাস করা আসলে ঐ ন্যায়ের সমাজ গঠনের তাৎপর্যকেই খাটো করা। আরএসএস উপলব্ধি করেছে আম্বেদকরের চিন্তাধারা তাদের নির্বাচনী লড়াইতে সুবিধা দেবে না, বরং তাদের বিচ্ছিন্ন করবে। তাই এর বিরোধিতায় হিন্দুত্বের ধারণায় যে ধরণের বৈষম্য রয়েছে এবং বৈচিত্রবিরোধী নীতিসমূহ লালিত হয় সেগুলি তারা আর লুকিয়ে রাখতে পারছে না।
হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি ঐতিহাসিকভাবেই সাংবিধানিক নীতিগুলির বিরোধিতা করে এসেছে। ঐ সকল নীতি প্রণয়নে আম্বেদকরই ছিলেন প্রধান অগ্রণী ব্যক্তি। ঐ সকল নীতি প্রসঙ্গে সাভারকারের বক্তব্য থেকে আরএসএস’র আদর্শগত বোঝাপড়া উপলব্ধি করা যায়। সংবিধানকে ‘অ-ভারতীয়’বলে অভিহিত করার পাশাপাশি সাভারকার সমাজ পরিচালনায় প্রাচীন ভারতের নিয়মের অজুহাত তুলে মনুস্মৃতির প্রশংসা করেছিলেন। ১৯৪৯ সালের ৩০ নভেম্বর আরএসএস নিজেদের সাংগঠনিক মুখপত্র, অর্গানাইজার-এ দ্ব্যর্থহীনভাবে তার সেই মতামতকেই প্রকাশ করেছিল। নতুন সংবিধানে ‘ভারতীয়’উপাদানের অভাব রয়েছে এবং ভারতীয় জনগণের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নীতির জন্য এই সংবিধান আসলে ‘বিজাতীয়’বলেও তারা দাবী করে। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় তারা মনুস্মৃতিকে সংবিধানের উপরে স্থাপন করতে চায়।
আম্বেদকরের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আরএসএস’র মনুস্মৃতিকে সংবিধানের চেয়ে প্রাধান্য দেওয়া, এটাই হলো দুই দৃষ্টভঙ্গির মধ্যে মূল আদর্শগত পার্থক্য। আম্বেদকরের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি এবং হিন্দুত্ব বাহিনীর প্রাচীন পিতৃতান্ত্রিক হিন্দু আইনকে ভিত্তি করে ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা, এটাও এই দুই আদর্শগত পছন্দের গভীর বিভেদকে চিহ্নিত করে। মনুস্মৃতির জন্য এমন অনুরাগ, মনুস্মৃতিতে উল্লিখিত জাতি-ভিত্তিক বৈষম্য এবং নারীর অধীনতা সম্পর্কিত ধারণাসমূহ, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সম্পর্কে আম্বেদকরের ধারণা এবং ভারতের সংবিধানের অন্তর্ভুক্তিমূলক ও লিঙ্গ সমতার নীতিসমূহের সরাসরি বিরোধী। ভারতীয় সমাজের ইতিহাস বর্ণবিভাজনের দ্বারা আগাগোড়া প্রভাবিত। এই ইতিহাসকে গর্বের অতীত হিসাবে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত গণতন্ত্রের ধারণার ধাত্রী বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে দাবি করেছেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আরএসএস আজও ঐরকম বৈষম্যের ব্যবস্থাকেই গণতান্ত্রিক মনে করে।
আম্বেদকরের সংগ্রাম
নিজের জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে সামাজিক বৈষম্যের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই আম্বেদকরের চিন্তাধারা বিকশিত হয়েছিল। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সময়ও সেই বিকাশের পর্ব চলেছিল। ঐ সময়েই তিনি সারা বিশ্বের বিশেষ করে আধুনিক, বিকশিত ও কার্যকরী সাংবিধানিক গণতন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত অধ্যয়ন করেন। বৈষম্য ও আধুনিকতা সম্পর্কে নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং দৃঢ় চেতনার সেই অনন্য সমন্বয়ই আম্বেদকরকে আধুনিক, গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ জাতিগোষ্ঠী হিসাবে সদ্য স্বাধীন ভারতের সামনে উপস্থিত বিশাল চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করার জন্য উপযুক্ত করে তোলে।
কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা সভ্যতাকে আত্মস্থ করে আধুনিক সমাজের কাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে সদ্য স্বাধীন ভারতের নতুন নেতৃত্বের সামনে যে চ্যালেঞ্জ উপস্থিত করেছিল, তার বিশালত্ত্বকে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীদের অন্যতম অ্যান্থনি ইডেন’ও স্বীকার করেছিলেন। বিপুল জনসংখ্যা, বৈচিত্র সমৃদ্ধ ভাষা, সংস্কৃতি, জাতীয়তাবোধ ও ধর্মীয় আস্থাসমুহের সুবিস্তৃতি সেই কাজকে আরও কঠিন করে তোলে। ইডেন অত্যন্ত সঠিকভাবেই এই কর্তব্যকে এক ‘অবিশ্বাস্য প্রয়াস’বলে বর্ণনা করেছেন।
সংবিধানকে ‘অ-ভারতীয়’বলে আরএসএস যতই অভিযোগ করুক না কেন, আম্বেদকরের কর্মকাণ্ডের বাস্তব ভিত্তিই ছিল বর্ণ-চালিত সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস এবং লিঙ্গ বৈষম্যের গভীর উপলব্ধি। গণতান্ত্রিক, সামাজিক ন্যায় এবং ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আম্বেদকরের প্রচেষ্টাকে আদর্শগতভাবে প্রতিহত করতে না পেরে আরএসএস তাঁর বিরুদ্ধে একজোট হয়। ১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বর সংবিধানের খসড়া পেশ করার সময়, আম্বেদকর বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন - ‘আমরা নিজেদের সেই সংবিধান দিয়েছি যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির একটি ভোটের অধিকার স্বীকৃত৷ কিন্তু এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে রয়েছি, যেখানে প্রত্যেকেই মানুষ হিসাবে সমান মর্যাদা পাবে’।
সমাজের রক্ষণশীল অংশের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও সংবিধানের খসড়া নির্মাণের কাজ পরিচালনার মতো বিশাল দায়িত্ব নিয়েছিলেন আম্বেদকর, মনে রাখতে হবে তখন তিনি নেহরু সরকারের আইন মন্ত্রী ছিলেন। সেই দায়িত্ব সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করার সাথে নির্দিষ্ট আইন-বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে সাংবিধানিক ভিত্তি স্বরূপ বিভিন্ন নীতিসমূহকে একত্রিত করাই ছিল তার পরবর্তী অগ্রাধিকার। সে কাজের ফলাফল হিসাবেই হিন্দু কোড বিলের খসড়া নির্মিত হয়েছিল। সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকারের প্রশ্নে লিঙ্গ সাম্যের ধারণাকে প্রতিষ্ঠার জন্যই তাঁর প্রস্তাবে হিন্দু সামাজিক আইনবিধি সংস্কারের উল্লেখ ছিল।
তাঁর প্রস্তাবিত সংস্কারের প্রয়াসে আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদীদের নেতৃত্বে সমাজের রক্ষণশীলরা ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করে। তারা একযোগে আম্বেদকরের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন সংগঠিত করেছিল। দিল্লির রামলীলা ময়দানে আম্বেদকর ও নেহরুর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। আম্বেদকরের প্রস্তাবিত বিল যেভাবে সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে মহিলাদের সমান মর্যাদা দেওয়ার উল্লেখ ছিল, তার বিরোধিতাই ছিল বিক্ষোভের মূল কারণ। প্রচণ্ড চাপের মুখে অবশেষে নেহরু বিলের মূল বয়ানে বিরোধীদের সাথে আপস করলে আম্বেদকর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
এই সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি বিজেপি’র দ্বিচারি অবস্থানকেই তুলে ধরে। আম্বেদকরের প্রাথমিক আদর্শগত সংগ্রাম ছিল আরএসএস’র দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেই। নেহরু এবং কংগ্রেসের প্রতি তাঁর ক্ষোভের কারণ সীমাবদ্ধ ছিল, হিন্দু কোড বিলের সাম্যবাদী নীতিগুলি সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে নেহরু সরকারের ব্যর্থতা নিয়েই। মূল কারনের নিরিখে বিবেচনা করলেই বোঝা যায় আম্বেদকরের মতাদর্শগত সমালোচনাগুলি আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল, নেহরু বা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নয়। ইতিহাসের এই পর্ব অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদীর মতো বিজেপি নেতাদের ভণ্ডামিকেই তুলে ধরে। আম্বেদকরের উত্তরাধিকারী হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার সময় তারা সেই সকল নীতিকেই দুর্বল করতে চাইছেন যেগুলিকে আম্বেদকর সমর্থন করতেন৷ আম্বেদকরের দৃষ্টিভঙ্গি ও সংবিধান প্রণয়ণের প্রক্রিয়ায় নির্দেশিত সাম্যবাদী আদর্শ এবং আরএসএস-বিজেপি’র রাজনৈতিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি ধারণা।
আম্বেদকর— সংবিধান রক্ষায় আজকের সংগ্রামের মুখ
আজকের ভারতে সংবিধান, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় আম্বেদকর সাধারণ মানুষ এবং বিরোধীদের কাছে প্রধান হাতিয়ার। কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে প্রস্তাবিত নয়া তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের ব্যাপক বিক্ষোভের সময়ও উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁর ছবি সামনে এসেছিল। ভারতীয় সমাজের অন্যান্য প্রান্তিক ও গণতান্ত্রিক অংশের সংগ্রামেও আম্বেদকর প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সাধারণতন্ত্র হিসাবে ভারতের বিবর্তনে আম্বেদকরের যে গভীর অবদান রয়েছে আজকের পরিস্থিতিতে সেটাই পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে।
হিন্দুত্ববাদী শক্তি এই বিতর্কের আদর্শগত ভিত্তিকে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছে না। অতীতে আরএসএস নিজেদের কৌশল হিসাবে বেশ সূক্ষ্মপন্থা অবলম্বন করেছিল। রাজনৈতিক সুবিধাবাদী কৌশলের মাধ্যমে তারা সমাজের সেই সকল অংশগুলির সমর্থন আদায় করতে পেরেছিল, যারা ব্রাহ্মণ্যবাদী শ্রেণিবিন্যাসের অধীনে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিপীড়িত, বঞ্চিত হয়েছিল। তৃতীয়বারের জন্য উল্লেখযোগ্য নির্বাচনী জয়ের পরে, অমিত শাহের মতো হিন্দুত্ববাদী নেতারা এখন আম্বেদকরের চিন্তাধারার উপর সরাসরি আক্রমণ শুরু কিঅনুযায়ী ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে এটা হলো তাদের পরিকল্পিত রাজনৈতিক পদক্ষেপ। নরেন্দ্র মোদীও ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, আম্বেদকরের দাবি এবং ‘মনুস্মৃতি দহন’র যে ইতিহাস ও তার পিছনে থাকা আসল কারণটিকেই তিনি গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
এই পরিস্থিতিতে আরএসএস-বিজেপি’র আদর্শগত মুখোশ খুলে দেওয়াই দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির কর্তব্য। আম্বেদকরের চিন্তাধারা, সংবিধান, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য, সামাজিক ও লিঙ্গ বৈষম্যের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই ধর্ম, বর্ণ কিংবা গোষ্ঠী নির্বিশেষে সমস্ত ভারতীয়দের ঐক্য রক্ষার জন্য এক বৃহত্তর সংগ্রামেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই লক্ষ্যে নিজেদের ভূমিকা পালনের জন্য বাম দলগুলি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
Comments :0