Party Statement

কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবনাবসানে রাজ্য কমিটির শোক-বিবৃতি

রাজ্য

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ( মার্কসবাদী)-র পলিট ব্যুরোর প্রাক্তন সদস্য, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবনাবসান হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে কলকাতায় তাঁর বাসভবনেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০। দীর্ঘ সময় অসুস্থ থাকার পরে আজীবন কমিউনিস্ট, জনপ্রিয়, মননে ও কাজে দৃপ্ত এই নেতার জীবনাবসানে সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি গভীর শোক প্রকাশ করছে। 
কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টচার্যের জন্ম ১৯৪৪ সালে, পিতা নেপাল ভট্টাচার্য, মা লীলা ভট্টাচার্য। তাঁদের পরিবার ছিল রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে আবৃত। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁর কাকা। তাঁর শৈশব কেটেছে উত্তর কলকাতায়। শৈলেন্দ্র সরকার ইনস্টিটিউশনে স্কুলের পাঠ শেষ করেন। তারপর পশ্চিমবঙ্গের সমকালীন বাম রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হন বাংলায়। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখনই প্রথমে ছাত্ররাজনীতি এবং তারপরে যুব আন্দোলনে তিনি অংশ নেন এবং নেতৃত্বে উঠে আসেন। এরাজ্যে ডিওয়াইএফ’এর প্রথম রাজ্য সম্পাদক ছিলেন তিনি। গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে রাজ্যে উত্তাল গণসংগ্রামের দিনে যুব, ছাত্র এবং গণ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। পরবর্তী কালে বিভিন্ন জেলায় পার্টি সংগঠনকে বিকশিত করার কাজে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছেন। 
কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সিপিআই(এম)’র সদস্য পদ লাভ করেন ১৯৬৬ সালে। পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ার আগে দমদম আদর্শ বিদ্যামন্দিরে বছর দুয়েক শিক্ষকতা করেছিলেন। সেই সময়ে বাংলায় খাদ্য আন্দোলন, ভিয়েতনামের প্রতি সংহতি আন্দোলনসহ বহু গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের সম্পাদক নির্বাচিত হন। সিপিআই(এম)’র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৭১ সালে। রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য হয়েছেন ১৯৮১ সালে এবং ১৯৮৫ সালে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে তিনি পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্যও হন। স্বাস্থ্যের কারণে তিনি ২০১৫ সালে সিপিআই(এম)’র পার্টি কংগ্রেসে পলিট ব্যুরোর সদস্যপদ থেকে অব্যহতি নেন। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি সাম্মানিক সদস্য ছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি পার্টির রাজ্য সম্পাদকমন্ডলী থেকেও অব্যাহতি নিয়ে রাজ্য কমিটিতে সাম্মানিক সদস্য হয়েছিলেন।

১৯৭৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তিনি কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে সিপিআই(এম)’র হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিধায়ক নির্বাচিত হন। সেই বছরই মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের মন্ত্রী হন। তাঁর নেতৃত্বে রাজ্যে প্রগতিমুখী, জনগণ-সম্পৃক্ত সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের লক্ষণীয় বিকাশ সম্ভব হয়েছিল।  ১৯৮৭ সালে তৃতীয় বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভায় তিনি এর সঙ্গে পৌর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরেরও দায়িত্ব পান। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে তিনি যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে চতুর্থ ও পঞ্চম বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে তিনি রাজ্যের স্বরাষ্ট্র (পুলিশ) দপ্তরের দায়িত্বও পান। স্বাস্থ্যের কারণে জ্যোতি বসু যখন মন্ত্রিসভায় নিজের ভার লাঘব করতে চাইছিলেন তখন ২০০০ সালের জুলাই মাসে উপমুখ্যমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এরপর ওই বছরের শেষের দিকেই জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সরকারের নেতৃত্ব তুলে দেন। ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এরপর ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন। ২০০৬ সালেও এই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হন। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের পরাজয় হওয়া পর্যন্ত তিনিই মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সাড়ে দশ বছর এই দায়িত্ব তিনি শুধু দক্ষতার সঙ্গেই পালন করেননি, পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে ও রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বামফ্রন্টের নীতি ও কর্মসূচিগুলি আন্তরিকভাবে রূপায়ণের চেষ্টা চালিয়েছেন। 
কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পিছিয়ে পড়া সব অংশের মানুষের অগ্রগতির জন্য সরকারী উদ্যোগ, রাজ্যের ভিতরেই স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা, রঙ্গনাথন কমিশনের সুপারিশ প্রকাশের পরে ভারতের মধ্যে সর্বপ্রথম ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, স্কুলশিক্ষায় মেয়েদের ঘাটতি দূর করে তাদের ব্যাপক সংখ্যায় টেনে আনা, পরিবেশ রক্ষা করে গরিবের উন্নয়নের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি পরিকাঠামো উন্নয়নে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি আগামী প্রজন্মের জন্য বাংলাকে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কর্মসংস্থানের জন্য ছোট, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। রাজ্যে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে তাঁর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা সফলও হয়েছিল। ইস্পাত শিল্প, রাসায়নিক শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প এবং অটোমোবাইল শিল্প গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সিঙ্গুরে অটোমোবাইল শিল্পে ৮০ শতাংশ কারখানা তৈরিও করিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধীদের হিংসাত্মক আন্দোলনে তা ধ্বংস হয়ে যায়। 
কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গণতান্ত্রিক রাজনীতির উদাহরণ ছিলেন। কুৎসিত আক্রমণের মুখেও তিনি জনগণের রাজনৈতিক বোধের ওপরে নির্ভর করেই পদক্ষেপ নিতেন। নন্দীগ্রামে হিংসাত্মক আন্দোলনের মুখে সেখানে গিয়েই তিনি ঘোষণা করে এসেছিলেন, মানুষ না চাইলে জমি নেওয়া হবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় তিনি ছিলেন দৃঢ়। এই প্রশ্নে বাংলার ঐতিহ্য রক্ষায় কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। 
সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অন্তরের যোগ ছিল। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। নিজে অনুবাদ করেছেন মায়াকোভস্কির কবিতা, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, কাফকার রচনা। জীবনানন্দ দাশ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর তাঁর লেখা বই বিশেষজ্ঞদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত। নিজে কবিতা লিখেছেন, নাটক রচনা করেছেন। আবার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, বামপন্থী রাজনৈতিক বিষয়ে বহু প্রবন্ধ এবং পুস্তিকা লিখেছেন। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালের অভিজ্ঞতা নিয়েও বই রয়েছে। চলচ্চিত্র সম্পর্কে শুধু ওয়াকিবহাল ছিলেনই না, মাধ্যম হিসাবে সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশে তার ব্যবহারে তিনি উৎসুক ছিলেন। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবকে আন্তর্জাতিক মানের করে তুলেছিলেন তিনি। জেলায় জেলায় রবীন্দ্রভবন গড়ে তোলা ও কলকাতায় আন্তর্জাতিক মানের প্রেক্ষাগৃহ নন্দন গড়ে তোলায় তাঁর বিশেষ অবদান ছিল। 
কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিভিন্ন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ফ্রান্স সফর করেছেন। 
কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত জীবন ছিল অনাড়ম্বর, কমিউনিস্ট গুণাবলীতে পূর্ণ। রাজনৈতিক ভাবে ভিন্নমতের মানুষও তাঁকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। মার্কসবাদ- লেনিনবাদের চিন্তায় সমৃদ্ধ, কর্মদক্ষতায় অগ্রণী এমন এক নেতাকে হারিয়ে পার্টি ও গণ আন্দোলনের ধারা গভীর ভাবে ব্যথিত। 
কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য, তাঁদের সন্তান সুচেতন ভট্টাচার্যের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছে সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটি। 

Comments :0

Login to leave a comment