World football

লাতিন আমেরিকা-ইউরোপ ছাড়িয়েই বৃত্ত বাড়ছে ফুটবলের

খেলা ফিচার পাতা

শুভাশিস ভৌমিক

ফুটবল বিশ্বকাপ মানেই ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার দাপট। এই দুই মহাদেশের বাইরে বিশ্বকাপ ট্রফি যায়নি আজ পর্যন্ত। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার বাইরে আফ্রিকার কোনও দেশ বিশ্বকাপ জিততে পারে! সেই সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ । খেতাব জেতা তো দূরে থাক, ধারাবাহিকভাবে দাপট দেখাতে পারবে এশিয়ার দেশগুলো। নৈব চ নৈব চ! 
বড় বড় ফুটবল বিশেষজ্ঞরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। তাদের অনেকরই ধারণা এশিয়া দেশগুলোর দ্বারা ফুটবল হয় না। তারা কখনই ইউরোপ-লাতিন আমেরিকান দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারবে না।  যদিও বা পাল্লা দিয়ে ওঠে, সেটা ‘ফ্লুক’ হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। বড় দলগুলোর সেটা ‘অফিসের বাজেতম দিন।’ তাই বড় দলগুলোকে হারিয়েও সঠিক স্বীকৃতি পায় না তথাকথিত ছোট দলগুলি। তার কারণই হচ্ছে, ধারা বজায় রাখতে না পারা। কোন বড় দলকে হারিয়েই দেখা গেল, পরের দু’ ম্যাচে হেরে গ্রুপ থেকেই বিদায় নেয় ওই দল। যেমন সৌদি আরব। অনেক দলের আবার শেষ ষোলোতেই অভিযান শেষ হয়ে যায়। এমনকি পরের সংস্করণে যোগ্যতা অর্জন করতে পারল না সেই দেশ। কথায় আছে, ‘পাবলিক মেমোরি ইজ টু শর্ট!’ মানুষ ভুলে যায় এশিয়ার দল গুলোর সাফল্যর কথা।


তবে, বিশ্বকাপে এশিয়ার দল গুলির সাফল্য খুব কম নেই। যেমন, ১৯৬৬ বিশ্বকাপে পর্তুগালের বিরুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার জান কবুল লড়াই। উত্তর কোরিয়া প্রায় হারিয়ে দিয়েছিল ইউসেবিওর পর্তুগালকে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে সৌদি আরবের সইদ আল ওয়াইরানের বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত গোল। ২০০২ কোরিয়ার ইতালি, স্পেনকে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠা। 
২০২২ কাতার বিশ্বকাপে বিশ্ববাসী কি দেখল? জাপানের ‘সূর্যোদয়’। গ্রুপ পর্বের দু’ম্যাচে জার্মানি ও স্পেনের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের বিরুদ্ধে পিছিয়ে থেকেও ম্যাচ বের করেছে, সীমার মধ্যে থেকে সীমাকে অতিক্রম করে জাপান। জাপান ফুটবলারদের গতির ঝড় সামলাতে হিমশিম খেয়েছে, বিপক্ষ। প্রশংসা পাচ্ছে, জাপানের অদম্য-দুর্দমনীয় মানসিকতা।’ যে আমরা হারার আগে হারি না!’  নাকাতা, হোন্ডা, শিনজি কাগোয়ারা যা পারেননি, সেটাই করে দেখালেন হাজিমে মরিয়াসুর তরুণ দল। বিশ্বকাপের ইতিহাসে টানা দ্বিতীয় বার গ্রুপ পর্ব টপকে। গতবার শেষ ষোলোয়, বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে ২-০ এগিয়ে থেকেও হেরে গিয়েছিল জাপান। সেই ধাক্কাই তাঁদের অভিজ্ঞ করেছে। ইতিহাসে প্রথমবার বিশ্বকাপের শেষ আটে ওঠার লড়াইয়ে নামবে জাপান। প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়ার। চার বছর আগের ভুল করতে নারাজ নীল সামুরাই ব্রিগেড। 


উন্নতি ও উত্থান একদিনে না হলেও একদিন ঠিকই হয়। সবচেয়ে বড় উদাহরণ জাপান। তার জন্য থাকতে হয় ‘রোডম্যাপ’। কোন পথে এগলে দেশের ফুটবলে বিকাশ ঘটবে ? কি করলে আগামীতে শক্তিশালী দেশগুলোর বিরুদ্ধে চোখ চোখ রেখে লড়তে পারবে। জাপান ফুটবল ফেডারেশন বুঝতে পেরেছিল নয়ের দশকে। সেই অনুযায়ী, পরিকল্পনা সাজিয়েছিল। ১০০ বছরের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল জাপান। কি সেটা? ‘২০৯২ বিশ্বকাপ জেতা’। এই লাইনটা পাঠক যখন পড়বেন, তাঁদের নিশ্চিত অবাক করবে। জাপান ফুটবল ফেডারেশন কিন্তু সঠিক পথেই এগচ্ছে। অনেক বছর আগেই দেশে দুই স্তরের লিগ চালু করেছে। ঘরোয়া লিগে দলের সংখ্যা বাড়িয়েছে এবং স্থানীয় তরুণদেরকে উঁচু স্তরের প্রতিযোগিতায় স্থান পাইয়ে দেওয়ার জন্য তৃণমূল স্তরের আকাদেমিকে সাহায্য করা। জাপান ফুটবলে উন্নতির পেছনে ব্রাজিলের জিকো দুঙ্গাদের ভূমিকা অসীম। মন্দার বাজারের সময় জাপান ফেডারেশন পয়সা বিনিযোগ করতে কার্পণ্য করেনি। ফলও পেয়েছে হাতেনাতে। কুবোর মতো প্রতিভাবান ফুটবলার তৈরি করেছে। জাপানের বহু ফুটবলার ইউরোপে দাপিয়ে খেলছে। ওই ফুটবলারদের ইউরোপের খেলার অভিজ্ঞতা বিশ্ব মঞ্চে কাজে লাগিয়েছে জাপান। খেলার স্টাইলে বদল এসেছে। জাপান জোর দিয়েছে পাসিং ফুটবলে। প্রতি আক্রমণেও সমান শক্তিশালী। মোদ্দা কথা, উন্নতির জন্য চাই সঠিক পরিকল্পনা। তাকে বাস্তবায়ন করা। যেটা সৌদি আরব, জাপানের মতো দলগুলো পেরেছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল খেলিয়ে দলগুলো সঠিক ভিশন, পরিকল্পনার অভাবেই পিছিয়ে পড়ছে। ভারত, বাংলাদেশের মতো দেশগুলির কাছে জাপান, সৌদির সাফল্য বড় শিক্ষা।


এশিয়ার আরেক দেশ সৌদি আরব। তাঁদের সামনেও সুযোগ ছিল, পরের রাউন্ডে যোগ্যতা অর্জন করার। এবার ব্যর্থ হলেও। শিখেছে। যা কাজে লাগবে আগামী দিনে। তবুও কাতার বিশ্বকাপে সৌদি আরবের উত্থান! ফুটবল পণ্ডিতদের নজর কেড়েছে। প্রশংসা কুড়িয়েছে। 


৯৪ বিশ্বকাপে শেষ ষোলো ওঠার থেকেও আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে সৌদির ফুটবলের ইতিহাসে বড় সাফল্য (যে জন্য দেশের সরকার পরের দিন জাতীয় ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছিল। ফুটবল ফেডারেশন দামি গাড়ি উপহার দিয়েছে স্কোয়াডের প্রত্যেক ফুটবলারকে)। কারণ, ৯৪'র পর সৌদি আর কখনই সমীহ জাগানো ফুটবল খেলতে পারিনি। ০২ বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে ৮-০ হার। ১৮ বিশ্বকাপে রাশিয়ার কাছে ৫-০, ওই বিশ্বকাপে মিশরকে হারিয়েছিল যদিও। ঠিক চার বছর পর, এতটা উন্নতি ভাবনার বাইরে। মাঠের কোচের পরিকল্পনা নিখুঁতভাবে কার্যকর করতে পারা। আর্জেন্টিনার ফুটবলারদের অফ সাইডের ফাঁদে ফেলা। রক্ষণে জমি না দেওয়া, এইগুলো তো বুঝিয়ে দেয়, সৌদি আরব ফুটবলে উন্নতি করছে ধীরে ধীরে। শুধুমাত্র একটা জয়ই এশিয়া অন্য দলগুলোকেই অনুপ্রেরণার রসদ জুগিয়েছে। এর নেপথ্যে অবশ্য সৌদির ফুটবল ফেডারেশন। ‘মিশন ২০৩০’ কে সামনে রেখে এগিয়েছে। ফুটবল উন্নতির জন্য ২.৩ বিলিয়ন পয়সা ঢেলেছে। বিশ্বকাপের আগে ফুটবলারদের তরতাজা রাখতে গোটা এক বছর ঘরোয়া লিগ বন্ধ রাখা। ২০১৯ লিগের নিয়ম বদলে ফেলা, সবকটিই কার্যকরী সিদ্ধান্ত। সর্বোপরি, রেনার্ড মতো একজন লোককে জাতীয় দলের কোচ করে আনা, ফরাসি কোচই উন্নতির পথ মসৃন করেন। 


এবারের বিশ্বকাপে শুধু জাপান, সৌদি আরব নয়, আফ্রিকার মরোক্কো, তিউনেশিয়ার মতো দলগুলো দাপট দেখিয়েছে। বিশ্বের দু’নম্বর তারকাখচিত বেলজিয়ামকে পরাজিত করে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের পর্বে গিয়েছে মরোক্কো। বিদায় নেওয়ার আগে ছাপ রেখে গিয়েছে তিউনিশিয়া। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে। এই কারণেই অনেকে বলছেন, অঘটনের বিশ্বকাপ, চমকের বিশ্বকাপ। তা কিন্তু একদম নয়। আসলে এই সব বলে, দলগুলোর সফলতাকে খাটো করে দেখানো। ফুটবলের উন্নতি সাধনের জন্যই আজ তাঁরা সফল। এই জন্যই তো ফুটবল এত সুন্দর! খাতায় কলমে ফেভারিট তকমা পাওয়া দলকে হারিয়ে দিচ্ছে আন্ডারডগ তকমা পাওয়া দলগুলো। ফুটবল উন্নত হচ্ছে। এখন কেউ কারোর থেকে কোনও অংশে পিছিয়ে নেই।
 

Comments :0

Login to leave a comment