তপারতি গঙ্গোপাধ্যায়
১৭২৪ সালে মহারাজা জয় সিংয়ের আমলে দিল্লির যন্তরমন্তর তৈরি হয়েছিল মূলত জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে। ২৬৯ বছর পরে, ১৯৯৩ সাল থেকে স্বাধীন ভারতের অন্যতম প্রতিবাদ মঞ্চ হিসাবে পরিচিত হয় যন্তরমন্তর। সেই থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য আন্দোলন, জমায়েত, স্লোগানের সাক্ষী থেকেছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সূর্যঘড়ি, সম্রাট যন্ত্র। সেই কারণেই যখন গত ১৮ জানুয়ারি ভিনেশ ফোগাট, দীপক পুনিয়া, রবি ধাইয়া, বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিক, এই পাঁচ আন্তর্জাতিক কুস্তিগির, ভারতের কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি বৃজভূষণ শরণ সিং এর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন, ভীতি প্রদর্শন এবং আর্থিক বেনিয়মের অভিযোগ আনেন এবং সেখানে ধরনায় বসেন, আমরা খুব একটা গুরুত্ব দিইনি।
উত্তর প্রদেশের গোন্ডা বিধানসভার ছয়বারের সাংসদ, এবং ভারতের কুস্তি ফেডারেশনের তিনবারের প্রেসিডেন্ট বৃজভূষণ শরণ সিংয়ের নামে ৩৮টি জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা চলছে, যার মধ্যে গ্যাংস্টার আইন, হত্যা এবং হত্যার চেষ্টা, চোরাচালান, রামমন্দির এবং বাবরি সংক্রান্ত মামলা, এবং দাউদ ইব্রাহিমকে সাহায্য করার জন্য টাডা কেসও আছে। বৃজভূষণের বিরুদ্ধে সাতজন মহিলা কুস্তিগির দিল্লির কনৌট প্লেস থানায় অভিযোগ করেন, ঘটনাগুলির সময়কাল ২০১২ থেকে ২০২২। তিনমাসের লাগাতার লড়াইয়ের পরে অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২৮ এপ্রিল দিল্লি পুলিশ দুটি এফআই আরদায়ের করেছে বৃজভূষণ সিংয়ের বিরুদ্ধে। প্রথমটি Protection of Children from Sexual Offences Act, 2012 এবং দ্বিতীয়টি দণ্ডবিধি ৩৫৪ ধারায়। কিন্তু তাকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি।
কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে তৈরি The Protection of Women from Sexual Harassment at Workplace (POSH) Act বিচারব্যবস্থার একটি ল্যান্ডমার্ক সিদ্ধান্ত।
গত দশ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়ায় ৪৫টি যৌন নির্যাতনের অভিযোগে এসেছে যার মধ্যে ২৯টি অভিযোগ প্রশিক্ষকের বিরুদ্ধে। তবু ক্ষমতার চর্চা অব্যাহত। শুধু কুস্তি ফেডারেশন না, ভারতের প্রত্যেক স্পোর্টস ফেডারেশনের মাথায় একজন রাজনৈতিক নেতা বসে আছে। স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের মাথায় যারা বসবেন তাদের সেই খেলার বিষয়ে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা না থাকলে তারা সাংগঠনিক কাঠামো কিভাবে উন্নত করবেন? আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের একের পর এক সম্মানহানি ঘটছে, নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছে, কিন্তু তার পরেও এই সিস্টেম একইভাবে চলছে। একক বা দলগত খেলার ক্ষেত্রে কোনও পরিকাঠামোই খেলোয়াড়দের পক্ষে না। তাঁরা সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিজেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করছেন, গর্বিত করছেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই বিষয়ে এখনো মুখ খোলেননি, খুলবেন বলে মনেও হয় না। অথচ অলিম্পিক, কমনওয়েলথ, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে পদক জেতার পরে এই কুস্তিগিরদের চায়ের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। ক্যামেরার সামনে তাঁদের সাথে অনেক গল্প করেছেন, তাঁদের সাহসকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, এমনকি ভিনেশকে তিনি নিজের পরিবারের মেয়ে বলেও সম্বোধন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও ক্যাম্পেইন এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর সাক্ষী মালিক।
মোদীর সাধের উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট, স্বপ্নের খেলো ইন্ডিয়া আজ ফুটপাতে ঘুমোচ্ছে, নিজেদের প্র্যাকটিস, প্রতিযোগিতা, পরিবার সবকিছু থেকে দূরে রাস্তায় পড়ে আছে। এদিকে মন কি বাত এর শততম সম্প্রচার উপলক্ষে গত তিরিশ এপ্রিল দেশের রাজভবনগুলি জুড়ে উৎসব হলো। দেশজুড়ে একানব্বইটি নতুন এফএম ট্রান্সমিটার বসানো হয়েছে, প্রত্যেক মানুষের কাছে প্রধানমন্ত্রীর মন কি বাত পৌঁছে যাবে, এটাই স্বপ্ন। কিন্তু দেশের মানুষের মন কি বাত কে শুনবে? প্রায় পঞ্চাশজন কুস্তিগির আজ তিনমাস ধরে বিচারের অপেক্ষা করছেন। দু’দিন আগেই যন্তরমন্তরে বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে, জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। রাতে মদ্যপ পুলিশ মহিলা খেলোয়াড়দের শ্লীলতাহানি করে, হাতাহাতিও হয়।
এক খেলোয়াড়ের মাথা ফেটে যায়। এই সময় অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতের অন্ধকারে সিভিল পোশাকে পুলিশি আক্রমণ, জেএনইউ-তে ঐশীর উপর আক্রমণ, শাহীনবাগ, কৃষক আন্দোলন।
ভারতের প্রাচীনতম খেলাগুলির একটি কুস্তি। মুঘল আমল থেকে তুরস্ক, ইরানের ফ্রিস্টাইল রেসলিং-এর প্রভাবে ভারতের মল্লযুদ্ধ আধুনিক হয়। কুস্তি শেখায় ধৈর্য, মনঃসংযোগ, প্রতিরোধ, বিপক্ষের সম্মান। ১৯২১ সালে সানফ্রান্সিসকোতে ‘‘দ্য জেন্টল জায়ান্ট’’ যতীন্দ্রচরণ গুহ ওরফে গোবর গোহ কুস্তিতে এশিয়ার প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ভীম ভবানী থেকে বিবেকানন্দ, বাঘাযতীন, সত্যেন বোস, এমনকি ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা পর্যন্ত জড়িয়ে আছেন আখড়ার ঐতিহ্যে। বাঙালির সেই দিন গেছে। তবে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রের ছেলেমেয়েরা এখনও সেই ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলছেন। তার সাথে জুড়ে যাচ্ছে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো, সেই মন্বন্তরের আওয়াজ।
কৃষক মিছিলে যেমন বারবার গ্রামের প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে, তেমনই ধীরে ধীরে শহুরে যন্তরমন্তর ভরে উঠছে গ্রামের মানুষের ভিড়ে। হরিয়ানার গ্রাম থেকে আসা প্রৌঢ় পিতা বলছেন, ‘‘আমারই তো সন্তান। এদের সঙ্গে এমন হলে আর কোন মেয়েটা গ্রাম থেকে খেলতে আসবে বলুন? এই অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না।’’
কিন্তু শহর চুপ করে আছে। শহরের মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধাগণ মুখে কুলুপ এঁটেছেন। খারিজ করছেন সমস্ত রূঢ় সামাজিক বাস্তব। তাঁরা হয়তো মন কি বাত শুনতে বেশি আগ্রহী। আসলে খেলা এক অবশ্যম্ভাবী বাণিজ্যিক বিনোদনে পরিণত হয়েছে। আমাদের ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি, যাপনের প্রতিফলন হিসাবে খেলার আর মূল্য নেই। তাই কুস্তি, কবাডি ফুটবলের মতো খেলা ক্রিকেটের মতো স্পনসরশিপ আনতে পারে না। সেই কারণেই প্রিন্ট, মিডিয়া, রাজনৈতিক মঞ্চ, আদালত কোথাও এই অবিশ্বাস্যরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে কোনোরকম ঢেউ উঠছে না। এইভাবেই নির্ভয়া, হাথরাস, বিলকিস, উন্নাও, কামদুনি, কালিয়াগঞ্জ ঘটে চলেছে নির্বিবাদে। আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের অভাবে। প্রেস ফ্রিডম এ ভারতের স্থান নিয়ে অবাক হবার কোনও কারণ দেখি না।
এই ক্ষত সভ্যতার। এই প্রতিবাদ হাজার হাজার বছরের পুঞ্জীভূত অসাম্যের প্রতিক্রিয়া। বর্ণবৈষম্য, জাতিভেদের নির্মমতার সাথে মেয়েদের স্বাধীনতার কথা বলার যতটা প্রয়োজন ছিল, ততটা আজও বলা হয়ে ওঠেনি।
"In choosing the object of her love, woman, like man, is free and unhampered. She woos or is wooed, and enters into a union from no considerations other than her own inclinations."
– August Bebel, Women in the future (1879)
আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে আমাদের সময়ের কথা লিখেছিলেন বেবেল। আমরা পৌঁছাতে পারিনি। ইমানুয়েল কান্ট বা শ্যোপেনহাওয়ারের মতো পুরুষ ও নারীর বৌদ্ধিক সমতার কথা, দুইয়ের যৌনতাকে একে অপরের পরিপূরক হিসাবে দেখার চেষ্টা, আসলে সমাজতন্ত্রের বার্তা। ব্যক্তিগত মালিকানার বিরুদ্ধে মেয়েদের সামগ্রিক মুক্তি। কিন্তু মনুস্মৃতির ধারক ও বাহকদের কাছে মেয়েরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তারা পুরুষের অনুগত সেবিকা, সন্তানধারণের মাধ্যম। মৌলবাদের চর্চায় মেয়েদের যৌনতাকে লজ্জা এবং অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধের অস্ত্র, দাঙ্গার অস্ত্র, পুঁজিবাদী ক্ষমতার অস্ত্র।
"Patriarchal force also relies on a form of violence particularly sexual in character and realised most completely in the act of rape. The figures of rapes reported represent only a fraction of those which occur, as the shame of the event is sufficient to deter women from the notion of civil prosecution under the public circumstances of a trial."
– Kate Millett, Theory of Sexual Politics (1969)
কারণ, আমাদের সভ্যতা ঐতিহাসিকভাবে পুরুষতান্ত্রিক। সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, আইন, প্রশাসন সহ ক্ষমতার সমস্ত পথ পুরুষের দখলে। মূল্যবোধের সংস্কৃতিও তাই ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। ঠিক এই কারণেই যেকোনও সামাজিক প্রতিরোধে মেয়েদের অংশগ্রহণ সময়ের প্রয়োজনীয় দাবি। মেয়েদের শিক্ষার হার যত বাড়বে, ততই তাঁরা সার্বিক ক্ষেত্রে এই ভারসাম্যের অভাব বুঝতে পারবেন। মেয়েদের কথা তো মেয়েদেরই বলতে হবে। তাতে অত্যাচার যেমন বাড়বে, তেমনই বাড়বে সহযোদ্ধার সংখ্যাও।
ঘটনার প্রতিবাদে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করতে গিয়ে ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিনিধিরা পুলিশি বাধার মুখোমুখি হয়েছেন। আবার নীরজ চোপড়া তাঁর টুইটে শুধু খেলোয়াড় না, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের সম্মান ও নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলেছেন। এটি এমনই একটি ইস্যু, যা আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং লিঙ্গবৈষম্যের অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। ক্ষমতার চর্চাকে একটা সাধারণ সমস্যার নিরিখে দেখার দাবি করে। আজ যন্তরমন্তরে ভিনেশ, সাক্ষী, সঙ্গীতাকে ঘিরে আছেন রবি, বজরং, দীপক সহ অসংখ্য পুরুষ। যেমন ইরানের মাহশা আমীনির জন্য পুলিশের বন্দুকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অসংখ্য পুরুষ। কারণটা লেনিন বিশ্লেষণ করেছিলেন এভাবে,
"Proletarian dictatorship is a real pioneer in establishing social equality for women. It is clearing away more prejudices than could volumes of feminist literature. But even with all that we still have no international communist women’s movement, and that we must have. We must start at once to create it."
-- Clara Zetkin (Lenin on the Women’s Question)
এভাবেই জন্ম স্যাফ্রাজেট থেকে শ্রমজীবী নারীদিবসের। বহু দশক ধরে খেলার মাঠ মৌলবাদ বিরোধিতার মঞ্চ। লিঙ্গবৈষম্য, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, পরিবেশ, শ্রমিকের অধিকার থেকে নাগরিকত্ব আইন, জীবনের বৃহত্তর প্রতিচ্ছবি বারবার উঠে এসেছে ক্রীড়াক্ষেত্রে, যৌথ উদ্যমে। সমাজতন্ত্রের চর্চায় মেয়েদের বিপুল, স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া আমাদের সভ্যতার স্বাধীন প্রবাহ, উৎকর্ষ অসম্পূর্ণ। একে তত্ত্ব থেকে অভ্যাসের উত্তীর্ণ করতে হলে সমষ্টির সাম্যবাদে এককের বোধের উত্তরণ অত্যন্ত জরুরি।
Comments :0