জাতীয় শিক্ষানীতি প্রয়োগ হলে লাটে উঠবে মেহনতি পরিবারের লেখাপড়া। ভুলে যাবে শিক্ষা সকলের সাংবিধানিক অধিকার। যে মাটিতে দাঁড়িয়ে বিভাজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লড়াই ঘোষণা হলো সে মাটি তেলেঙ্গানা সশস্ত্র অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের মাটি।
তেলেঙ্গানার ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে মনে করিয়ে দিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের শিক্ষার এই বিভেদের নীতির সঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় মৌলবাদকে পরাস্ত করতে জোরদার আন্দোলনের ডাক দিয়ে মঙ্গলবার শুরু হলো এসএফআই’র ১৭তম সর্বভারতীয় সম্মেলন।
এদিন সম্মেলন শুরুর আগে এক সুসজ্জিত বর্ণময় শোভাযাত্রা হায়দরাবাদ শহর পরিক্রমা করে, হুসেইন সাগরের কিনারে প্রকাশ্য সমাবেশ হয়। সেই সমাবেশে গণআন্দোলনের নেতা ও ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বক্তব্য রাখেন। অন্যদিকে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (মালু স্বরাজ্যম নগর) হাব্বিবুল্লা দ্বিরাজ, আনিস খান মঞ্চে এদিনই শুরু হয়েছে সম্মেলনের কাজ।
সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন বিখ্যাত বিচারপতি চান্দ্রু। গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য এদিন সমাজকর্মী তিস্তা শীতলাবাদ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। কিন্তু তিনি ভিডিও মারফত উদ্বোধনী বার্তা দিয়েছেন এসএফআই কর্মীদের। প্রকাশ্য সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রেখেছেন এসএফআই’র সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাস, সর্বভারতীয় সভাপতি ভিপি সানু, এসএফআই নেত্রী দীপ্সিতা ধর, রাগারাজু, মূর্তি সহ এসএফআই’র নেতৃবৃন্দ। সম্মেলনে শোক প্রস্তাব পাঠ করেছেন ভিপি সানু ও দীপ্সিতা ধর।
এদিন প্রকাশ্য সমাবেশে মানিক সরকার বলেছেন, জাতীয় শিক্ষানীতির মধ্যে দিয়ে দেশের নতুন এক অভিজাত (এলিট) শিক্ষার্থী তৈরি হবে।
গরিব, দলিত, আদিবাসী, তফসিলি পরিবার সহ সমাজের প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা থেকে ছিটকে যাবে। কর্পোরেটদের স্বার্থে এই শিক্ষানীতি আনা হচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও জাতীয় শিক্ষানীতির মধ্যে দিয়ে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের মধ্যে একটি আর্থিক বৈষম্য দেখা দেবে। এই শিক্ষানীতিতে পাঠক্রম, পাঠ্যসূচি বদলের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার গৈরিকীকরণ ঘটানোর চেষ্টা হবে। ইতোমধ্যে দেশের কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গবেষণাকেন্দ্রগুলিতে আরএসএস’র ঘনিষ্ঠদের বসানো হয়েছে। দেশের স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে শিক্ষার যে সাধারণ ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছিল তা ভেঙে দেওয়ার জন্যই জাতীয় শিক্ষানীতির আগমন ঘটানো হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতির মধ্যে দিয়ে কীভাবে দেশে বেকারত্ব বাড়বে তা উল্লেখ করতে গিয়ে মানিক সরকার বলেছেন, জাতীয় শিক্ষানীতি যেহেতু এলিট অংশ তৈরি করবে, তাই পদস্থ অফিসার থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারীর চাকরি হবে ওই এলিট অংশের মধ্যে থেকেই। বর্তমান যে শিক্ষাব্যবস্থা বিরাজ করছে তাতে অত্যন্ত এটা বলা যায় যে চাকরির ক্ষেত্রে এই ভেদাভেদ অনেকটা নেই। সবটা নেই এটা বলা যাবে না। এই সমাজব্যবস্থায় যতটা সম্ভব শিক্ষার পর চাকরি পাওয়ার একটা বহমানতা রয়েছে। বর্তমানে এমনিতেই দেশের বেকারের হার হুহু করে বাড়ছে। বছরে ২কোটির চাকরির প্রতিশ্রুতি বিজেপি’র ডবল ইঞ্জিনের সমান।
সম্মেলনের প্রতিনিধি অধিবেশনের উদ্বোধন করে বিচারপতি চান্দ্রু বলেছেন, বর্তমানে দেশে যে জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি চলছে তা ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে জারি করা জরুরি অবস্থার থেকেও ভয়ঙ্কর। সেই সময়ে জরুরি অবস্থায় কাগজ, সংবাদমাধ্যমের উপর সেন্সরশিপ করা হয়েছিল। এখন মোদী সরকার গণতন্ত্রের উপর সেন্সরশিপ জারি করেছে। দেশের সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে মোদী সরকার হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে রয়েছে। এর বিরুদ্ধে এসএফআই’কে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দেশজুড়ে লড়াই, আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একসময় দেশে ‘নবরত্ন’ গর্বের ছিল। এখন সেই ‘নবরত্ন’ আদানি, আম্বানি হয়েছে। দেশে নয়া শিক্ষানীতি আনা হচ্ছে। এই শিক্ষানীতি ধনী ও গরিবের মধ্যে বিভাজন তৈরি করবে। এই শিক্ষানীতি দেশের মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য তৈরি হয়েছে। যাদের অর্থ রয়েছে, তারাই শিক্ষার আওতায় থাকবে। বাকিরা শিক্ষার অঙ্গন থেকে ছিটকে যাবে।
জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে আহ্বান জানিয়ে বিচারপতি চান্দ্রু বলেছেন, শিক্ষা নিয়ে সরকার যে নীতি আনছে তা ভয়ঙ্কর। তাহলে আমাদের কাজ কী? শুধু সমালোচনা করা নয়, আমাদের লক্ষ্য বিকল্প রাস্তা বের করা। অর্থাৎ চ্যালেঞ্জ নিতে হবে ছাত্র-ছাত্রীদের। তার জন্যই লড়াই আন্দোলন। গত কয়েক বছরে দেশে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। অথচ মোদী সরকার ২০১৪ সালের বিজ্ঞাপনে বলেছিল এবার আর চিন্তা নেই। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কী করে হবে? দেশের লক্ষ কোটি টাকাই তো লুট হয়ে গিয়েছে কর্পোরেটদের হাতে। এই টাকার একটা অংশ তো শাসকদলকে ভোটে জিতিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা ছাড়াও এটাই এখন এক নতুন বিপদ। সমাজের চরিত্রই বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে বিজেপি, আরএসএস। ছাত্র-ছাত্রীরাও এই আওতা থেকে বাদ যাচ্ছে না। সুতরাং এসএফআই-কে সতর্ক থাকতে হবে।
এদিনই প্রতিনিধি অধিবেশনে খসড়া সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেছেন ময়ূখ বিশ্বাস। প্রতিবেদন পেশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আগে শিক্ষার বুনিয়াদকে আরও মজবুত করার লক্ষ্যে লড়াই আন্দোলন ছিল এসএফআই। এখন শিক্ষাকে বাঁচানোর জন্য প্রতিদিন পথে নামতে হচ্ছে। গেরুয়াবাহিনীর কড়া মনোভাব, ছাত্র-ছাত্রীদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে। বিভিন্ন রাজ্যের এসএফআই কর্মীরা জান কবুল লড়াই করে চলেছেন। এই সময়ের মধ্যে সংগঠন অনেকটা বেড়েছে। ব্রিটেনে এসএফআই’র সংগঠন তৈরি হয়েছে। মাত্র কয়েকটি রাজ্য কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। আশাকরি, আগামীদিনে সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবে। পশ্চিমবঙ্গের মতো বেশ কয়েকটি রাজ্যের এসএফআই’র কর্মীরা কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে অনেকটা জমি আদায় করতে পেরেছে। কর্পোরেট শিক্ষাব্যবস্থা, যা মোদী সরকার আনতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়াই করে এসএফআই’কে দেশের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন ময়ূখ বিশ্বাস।
Comments :0