প্রকাশ্যে দলের সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে পুলিশকে বোমা মারার হুমকি দিয়েছিল সে। প্রায় এক দশক হতে চলেছে, আজও সেই মামলায় সামান্য জেরাটুকু পর্যন্ত করার সাহস দেখাতে পারেনি মমতা ব্যানার্জির পুলিশ প্রশাসন!
অথচ খোদ এক তৃণমূল কর্মীর প্রায় দেড় বছর আগের পুরানো একটি অভিযোগের ভিত্তিতে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এফআইআর, জেরা শেষে আদালতে তোলা হলো অনুব্রত মণ্ডলকে এবং সাতদিনের পুলিশ হেপাজতের নির্দেশও এল দুবরাজপুর আদালত থেকে! এবং গত বারো বছরে এই প্রথম কোনও তৃণমূল নেতাকে পুলিশ আদালতে তুললেও তৃণমূলের তরফে কোনও আইনজীবী জামিনের আবেদন পর্যন্ত করলেন না!
এই উলটপুরাণ কেন? পুরানো মামলা খুঁজে এনে মঙ্গলবার অনুব্রত ওরফে কেষ্টকে তড়িঘড়ি পুলিশ হেপাজতে নেওয়ার এই সরকারি তৎপরতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে গোরু পাচার কাণ্ডে শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বের অস্বস্তি। তাই বিপুল টাকা খরচ করে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কপিল সিব্বালকে আইনজীবী হিসাবে নিয়োগ করেও কেষ্টর দিল্লি যাত্রা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার পরে একটি ‘সাজানো’ মামলায় তাকে রাজ্য পুলিশের হেপাজতেই রেখে দেওয়ার এমন মরিয়া দৃষ্টিকটু চেষ্টা চালালো পুলিশ প্রশাসন এবং সরকার। অপরাধ প্রবণতার মনোভাব থেকেই পুলিশ প্রশাসন-শাসকদল এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটালো বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহলও।
যদিও ইডি’র একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, গোটা ঘটনাপরম্পরার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে মামলা সাজিয়ে কেষ্টকে রাজ্য পুলিশ হেপাজতে নেওয়া যে ইডি’র জেরা আটকাতেই, আদালতে সেকথা জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষুব্ধ কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা।
এদিকে মঙ্গলবার সকালে নাটকীয় ঘটনার পরেই এদিনই বিকালে কেষ্টর তরফে তার আইনজীবীরা রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছেন। দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালতের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করেই দিল্লি হাইকোর্টে মামলা হয়েছে। আগামীকাল শুনানির সম্ভাবনা।
সোমবার দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালত ইডি’র আবেদন মঞ্জুর করে গোরু পাচার কাণ্ডের মানি লন্ডারিং তদন্তে কেষ্টর বিরুদ্ধে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যু করে। যার অর্থ দিল্লিতে ইডি’র সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়েই জেরা করা করা হবে কেষ্টকে। আদালতের রায়ের পরেই তৎপরতা শুরু হয় ইডি’র। জানা যায়, মঙ্গলবার সকালে আসানসোল জেল থেকে বের করে তাকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হবে।
কিন্ত এদিন সকাল থেকেই বদলে যায় ছবি। সামনে আসে তৃণমূল সরকার, পুলিশ প্রশাসনের সম্মিলিত কুনাট্যের চিত্র।
শনিবার দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টে শুনানি শেষ হয়েছিল, রায়দান সোমবার পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল। রায় কী হতে পারে তা আগাম টের পেয়েই যেন রবিবার সকাল দশটায় আগেভাগেই এক তৃণমূল কর্মীকে দিয়ে এফআইআর দায়ের করানো হয়। নিমেষের মধ্যেই রুজু হয়ে গিয়েছিল মামলা। রাতারাতি আসানসোল আদালতে হয়ে গেল ‘জিজ্ঞাসাবাদ’! রাত পেরোতেই ‘শোন অ্যারেস্ট’ করে আসানসোল জেল থেকে দুবরাজপুর আদালতে করা হলো পেশ। সকাল সাতটাতেই ‘তৎপর’ পুলিশ আসানসোল আদালত থেকে কেষ্টকে বের করে দুবরাজপুর আদালতে নিয়ে যায়। নেওয়া হলো পুলিস হেপাজতে। কেষ্টর দিল্লি যাত্রা আটকাতে মরিয়া শাসকদলের এভাবে পুলিশকে ব্যবহারের আরও এক নজির দেখলেন রাজ্যবাসী।
আরও আশ্চর্যের হলো, অভিযুক্ত যেখানে কেষ্ট সেখানে জামিনের আবেদনটুকু পর্যন্ত করলেন না তৃণমূলের আইনজীবীরা! দুবরাজপুরের তৃণমূল কর্মীর কাছ থেকে কেষ্টর বিরুদ্ধে ‘টুঁটি চেপে ধরার’ অভিযোগ পেয়েই পুলিশ ছুটল আসানসোল আদালতে তাকে নিজেদের হেপাজতে নিতে!
কেষ্টর দলেরই এক প্রাক্তন প্রধান সোমবার বীরভূমের দুবরাজপুর থানায় দায়ের করলেন অভিযোগ। দুবরাজপুর ব্লকের বালিজুড়ি পঞ্চায়েতের প্রধান শিবঠাকুর মণ্ডলের অভিযোগ, ‘‘২০২১’র বিধানসভা ভোটের সময় দুবরাজপুর পার্টি অফিসে ডেকে পাঠিয়ে অনুব্রত আমাকে টুঁটি চেপে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। কারণ, আমি আর দল করব না বলেছিলাম। তখন কিছু করে পারিনি। এখন দেখলাম এটাই সুযোগ। তাই সঠিক সময় বুঝে অভিযোগ দায়ের করেছি।’’ অভিযোগকারী এই তৃণমূল নেতাই জানিয়েছেন, ‘‘আমি অভিযোগ করেছি থানায়।’’
কেষ্টর বিরুদ্ধে তৃণমূলেরই এক প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধানের অভিযোগ পেয়েই চটজলদি ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৭, ৩২৩, ৩২৫, ৫০৬ ধারায় মামলা রুজুও করে দেয় পুলিশ। শুধু তাই নয়, পুলিস তড়িঘড়ি কেষ্টকে ‘শোন অ্যারেস্ট’ করে প্রোডাকশন ওয়ারেন্টের জন্য আসানসোল জেলে আবেদন করে দেয়। রাত পেরোতেই পাঁচটি গাড়ির কনভয় নিয়ে আসানসোল জেল থেকে কেষ্টকে নিয়ে আসা হয় দুবরাজপুর আদালতে। ১৪ দিনের পুলিশ হেপাজতের আবেদন জানানো হয়। বিচারক সাত দিন মঞ্জুর করেন। কিন্তু কেষ্টর হয়ে জামিনের আবেদন করেননি কেউ। এব্যাপারে দুবরাজপুর আদালতে হাজির জেলা আদালতের সরকারি আইনজীবি তথা তৃণমূলের সহ-সভাপতি মলয় মুখার্জি বলেছেন, ‘‘আইন মেনেই সবটা হয়েছে। তবে হঠাৎই ঘটেছে, তাই জামিনের আবেদন করা হয়নি। এতে ইডি’র তদন্তে কোনও ব্যাঘাত ঘটবে না।’’
গোটা ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, আদতে কেষ্টকে রাজ্য পুলিশের হেপাজতে নেওয়ার তাগিদই সাজানো হয়েছে গোটা চিত্রনাট্য।
আর পুলিশি হেপাজত মানেই যে কেষ্টর নিশ্চিন্তের ঠিকানা তা এদিন আবার দুবরাজপুর হাসাপাতালেই প্রমাণ হয়েছে। পুলিশি হেপাজতের নির্দেশে পরে দুপুর আড়াইটা নাগাদ নিয়মমাফিক স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দুবরাজপুর গ্রামীণ হাসপাতালে। অন্য বিচারাধীন বন্দিদের হাসপাতাল চত্বরে গাড়ি থেকে নামিয়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে মমতা ব্যানার্জির স্নেহধন্য কেষ্ট বসেছিল গাড়িতেই। স্বয়ং চিকিৎসকরাই সেখানে এসে তাকে পরীক্ষা করেন। এই ঘটনার পরেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন হাসপাতালের অন্য রোগীদের পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের অভিযোগ, গোরু পাচারে যুক্ত এক অভিযুক্তকে গাড়িতে বসিয়ে চিকিৎসকরা দেখলেন, অথচ দিনের পর দিন লাইন দিয়েও আমরা ডাক্তার দেখাতে পারি না। ভিআইপি বলে আলাদা নিয়ম!
কেষ্টর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তো এটিই প্রথম নয়। এর আগে এমন বহু অভিযোগ হয়েছে তার বিরুদ্ধে। পুলিশ চোখ তুলেও তাকায়নি কখনো। বরং ‘‘পুলিশকে বোমা মারার’’ হুমকির ঘটনায় যে মামলা হয়েছিল তাতে হাজিরা দিতে গিয়ে সিউড়ি আদালতে কেষ্ট পেয়েছিল রাজকীয় অভ্যর্থনা। আদালতের ভেতরে কর্মরত পুলিশকর্মী নিজের চেয়ার পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন কেষ্টর জন্য। হাওয়া পেতে যাতে অসুবিধা না হয় সেজন্য ফ্যানের মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতির দিকে।
সেই কেষ্টকেই কি না ঠুনকো একটি অভিযোগের ভিত্তিতে রাতারাতি গ্রেপ্তার করল পুলিশ! শুধু তাই নয়, তার হয়ে জামিনের আবেদনটুকু পর্যন্ত হলো না! অথচ এই কেষ্টকে সিবিআই-ইডি’র হেপাজত থেকে মুক্ত করতে তার দলের নেতা-কর্মী-আইনজীবিরা আসানসোল থেকে দিল্লি যাতায়াত করছেন নিয়মিত। গলা ফাটাচ্ছেন জামিনের জন্য!
Anubrata
দিল্লিতে জেরা আটকাতে কেষ্টকে ঠুনকো মামলায় গ্রেপ্তার এরাজ্যে
×
Comments :0