তীব্র ক্ষুধা। একজনের, ২৬ জনের, এক দেশের।
আর্জেন্টিনা মঙ্গলবার বিশ্বকাপের প্রথম খেলায় নামছে। ১৯৮৬-র পরে বিশ্বকাপ আসেনি। দেশের ক্ষুধা। ফুটবলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার মানুষের সম্পর্ক অতিকৃত। রোমান্স, ভাবাবেগ, ক্রোধ-আনন্দের যুগ্ম সঞ্চারী। অভিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ মিলিয়ে ২৬ জনের স্কোয়াড, প্রথম একাদশ নামবে শেষ ৩৬ আন্তর্জাতিক ম্যাচে অপরাজিত থাকার নজির নিয়ে। শুধু অতীতের ইতালি এক ম্যাচ এগিয়ে ছিল। শীর্ষেই পৌঁছনো ছাড়া এই তৃষ্ণার কোনও তৃপ্তি নেই।
এই সমষ্টিগত ক্ষুধার মধ্যেও একজনের আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা স্বভাবতই বেশি। ম্যাচের আগে খবর একটিই— মাঠে নামছেন লিওনেল মেসি। এটি তাঁর পঞ্চম বিশ্বকাপ, সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ প্রতিভার প্রথমটিকে ধরে। একদিন অনুশীলনে না আসায় হৃদকম্প ভূমিকম্পের আকার নিয়েছিল আর্জেন্টিনায়। পরের দিন এসেছেন, কিন্তু একা এবং মূলত শারীরিক কসরৎ। সংশয় কাটিয়ে প্রথম ম্যাচের আগে শেষ অনুশীলনে সতীর্থদের সঙ্গেই, হাসিখুশি দেখিয়েছে তাঁকে। তবে ভরা মরশুমে একের পর এক ক্লাব ম্যাচের চাপে তাঁর পায়ের পেশিতে কিছু সমস্যা থেকেই গেছে। দোহায় আর্জেন্টিনা তো বটেই অন্য দেশের সাংবাদিকরা সোমবার শুধু জানতে চেয়েছেন একটিই খবর। তাঁদের নিরুদ্বিগ্ন করে স্বয়ং মেসি এসেছিলেন সাংবাদিক সম্মেলনে। উড়িয়ে দিয়েছেন চোট-আঘাতের কথা। বলেছেন, গুজব আমারও কানে এসেছে। তেমন কিছুই ঘটেনি। আমি শারীরিক এবং মানসিক ভাবে পুরো চাঙ্গা, আমরা জাতীয় দলে এই সময় উপভোগ করছি।
লিওনেল মেসি মারাদোনার দেশের মানুষ। প্রতিদিন তুলনার ভার তাঁর কাঁধে। মারাদোনা তাঁর হিরো ছিলেন, তাঁর কোচও ছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপ হাতে মারাদোনার সেই ছবি যেন তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। নিষ্পত্তির অযোগ্য বিতর্ক— মারাদোনা না মেসি? ফুটবলের দার্শনিক বলা হয় জর্জ ভালদানোকে। সেই প্লেয়ার, শতাব্দীর সেরা গোলের সময়ে মারাদোনার ডানদিকে দৌড়াচ্ছিলেন যিনি এবং সব সময়েই ভাবছিলেন বল এবার তাঁকেই দেওয়া হবে, হতবাক হয়ে দেখেছিলেন যে ‘গ্যালারির মতো তিনিও স্রেফ দর্শক’। সেই ভালদানো পর্যন্ত বলেছেন, ‘মারাদোনা মাঝে মাঝে মারাদোনা, মেসি প্রতিদিন মারাদোনা’। তবু এই প্রশংসা, এমনকি পরপর ব্যালন ডি’অর, চ্যাম্পিয়নস লিগ, লা লিগা, কোপা আমেরিকা সবকিছুর সঙ্গেই সেই কাঁটাতার— মেসির হাতে বিশ্বকাপ নেই।
মেসি এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, এ হলো এক বিশেষ মূহূর্ত। সম্ভবত আমার শেষ বিশ্বকাপ। আমার এবং আমাদের স্বপ্ন সফল করার শেষ সুযোগ। কোপা আমেরিকা জয়ের পরে উৎকণ্ঠা কমেছে। চাপ কমেছে।
মেসি নিজেও এবার এসেছেন চনমনে হয়ে। অনেকেই বলছেন, ‘ভিন্টেজ মেসি’, সেই পুরানো মেসি। বার্সেলোনা থেকে চলে যেতে হবে, কল্পনায় ভাবেননি কখনও। সেই ব্যথাতুর বিদায়ের ধাক্কায় পিএসজি’তে প্রথম মরশুম খারাপ কেটেছে। কিন্তু এখন যখন তিনি প্যারিসের মাঠ থেকে উঠে এসেছেন মরুশহরে তখন গোলের খরা কেটেছে, একটু নিচে থেকে খেলে একের পর এক গোল করাচ্ছেন নেইমার, এমবাপ্পেকে দিয়ে। আবার শুরু হয়েছে ‘মেসি-ম্যাজিক’। সুতরাং আবার তিনি উসকে দিয়েছেন আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা।
মেসির জন্যও আর্জেন্টিনা লড়বে, একথা ঠিক।
গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ যেমন বলেছেন, ‘আমরা ওর জন্য লড়াই করা সিংহ’। কিন্তু এবারের আর্জেন্টিনা শুধু মেসি নির্ভর নয়। এর থেকে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের নিয়ে আগেও খেলেছেন মেসি। কিন্তু দলের বাঁধুনি ভঙ্গুর ছিল, এখানে-ওখানে ফাঁক ছিল। মেসির প্রলম্বিত ছায়ার নিচে খেলেছে দল। এবারের দলে একেক পজিশনে একাধিক দক্ষ খেলোয়াড়। অনেক ছন্দবদ্ধ খেলছে দল। এই কৃতিত্বের আসল দাবিদার স্কালোনি। যখন কোচ হলেন তখন বহু ভ্রুকুঞ্চন হয়েছে, বহুদিন পাত্তা পাননি। কিন্তু তিনিই মেসিকে ঘিরে একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন নতুন একটা দল। এতটাই যে ‘আলবিসেলেস্তে’ এখন আরও এক পরিচয় পেয়েছে— ‘লা স্কালোনেতা’।
এই দলে সংঘবদ্ধতা বেশি, সমানুভূতি বেশি। কিন্তু শেষ মূহূর্তেও দল সাজাতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছেন স্কালোনি। নিকোলাস গঞ্জালেস আঘাতের জন্য ছিটকে গেছেন কাতারে আসার পরে। শোনা যাচ্ছে, তিনি শারীরিক পরিস্থিতির সঠিক রিপোর্ট করেননি। ক্ষতি হয়েছে, কেননা আক্রমণে বাড়তি ধার দিচ্ছিলেন। জোয়াকিন কোরিয়াও ছিটকে গেছেন। মেসির সঙ্গে যাঁর বোঝাপড়া ভালো সেই লে সলসো আগেই বাদ পড়েছেন আঘাতের কারণেই। আর্জেন্টিনার বেঞ্চে, অথবা এই যুদ্ধে বাঙ্কারে একটু ছন্দপতন ঘটেছে।
কিন্তু ক্ষুধা তো কমেনি। সৌদি আরবের মতো পরিসংখ্যানের বিচারে দুর্বলতর দলের বিরুদ্ধেই প্রথম পরীক্ষা হয়ে যাবে লা পুলগাই এ দলের একমাত্র নক্ষত্র কিনা। ইতিমধ্যেই কাতার ভেসেছে নীল-সাদা জার্সিতে। হ্যাঁ, মেসির জন্য, কিন্তু ডি মারিয়া, ডি পল, লাউতারো মার্টিনেজের জন্যও।
Comments :0