প্রতীম দে
‘‘আমরা ভারতের জনগণ ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রূপে গড়িয়া তুলিতে, এবং উহার সকল নাগরিক যাহাতে সামাজিক, অর্থনীতিক এবং রাজনীতিক ন্যায়বিচার; চিন্তার, অভিব্যক্তির, বিশ্বাসের, ধর্মের ও উপাসনার স্বাধীনতা; প্রতিষ্ঠা ও সুযোগের সমতা নিশ্চিতভাবে লাভ করেন, এবং তাঁহাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-মর্যাদা ও জাতীয় ঐক্য ও সংহতির আশ্বাসক ভ্রাতৃভাব বর্ধিত হয়; তজ্জন্য সত্যনিষ্ঠার সহিত সংকল্প করিয়া আমাদের সংবিধান সভায় অদ্য, ২৬শে নভেম্বর, ১৯৪৯ তারিখে, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করিতেছি, বিধিবদ্ধ করিতেছি এবং আমাদিগকে অর্পণ করিতেছি।’’
এই কথা গুলো লেখা আছে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায়।
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি দীর্ঘ আলোচনা, বিতর্কের পর গৃহীত হয় স্বাধীন ভারতের সংবিধান। সংবিধান। যা মেনে দেশ চলবে। যার দ্বারা দেশের প্রতিটা মানুষে অধিকার রক্ষীত হবে। ৭৫ বছর পার করে এসেছে এই সংবিধান। আর এই ৭৫ বছরের মাথায় এসেই ক্রমাগত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে সংবিধান। যেই সংবিধান ‘সবার’ কথা বলে সেই সংবিধানকে বদলে দিতে চায় হিন্দুত্ববাদীরা, সহজ ভাবে বলতে গেলে আরএসএস।
আরএসএস এক দেশ, এক ভাষা, এক নেতা এই ভাবনায় বরাবর বিশ্বাসী।
বর্তমান সময় দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার প্রতিনিয়ত আঘাত নামিয়ে আনছে সংবিধানের ওপর। শুরুটা হয়েছিল ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙা দিয়ে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে বাবরি ভেঙে ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্রের ওপর আঘাত আনে উগ্র-হিন্দুত্ববাদীরা। তারপর একাধিক বার কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করলেও সংবিধান বদলের চেষ্টা করেনি তারা। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নখ দাঁত বের করে সংবিধানের ওপর আঘাত আনা শুরু। যেই সংবিধানের নামে শপথ নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী সেই সংবিধানকে নতুন সংসদ ভবনে কোন স্থান দেওয়া হয়নি। উল্টে স্থান দেওয়া হয়েছে রাজতন্ত্রের প্রতীক সেনগলকে।
২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচন ছিল সংবিধান বাঁচানোর লড়াই এমনটা বার বার বলেছেন বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস। লোকসভা নির্বাচনের পর তাই অমরা রাম, রাহুল গান্ধীদের দেখা গিয়েছে সংবিধান হাতে সাংসদ হিসাবে শপথ নিতে।
কিন্তু কোন আজ মনে করা হচ্ছে সংবিধান বিপন্ন...
সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই বলা আছে দেশের প্রতিটা মানুষ যাতে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষা করবে সংবিধান। কিন্তু সংবিধান তো আর সামনে এসে রক্ষা করবে না, রক্ষা করার কাজটা করতে হবে সংবিধানের নামে যেই সরকার শপথ নিয়েছে তাকে। আমরা দেখছি গত এক বছরে বার বার মানুষের অধিকার খর্গ হয়েছে। আঘাত আনা হয়েছে দেশের যুক্ত রাষ্ট্রীয় কাটামোর ওপর।
প্রথমটা শুরু হয়েছিল গো মাংস রাখার অপরাধে একজন ব্যাক্তিকে পিটিয়ে মারার ঘটনা দিয়ে। যেই দেশের সংবিধান একজন নাগরিককে অধিকার দিচ্ছে নিজের ইচ্ছা মতো খাদ্যাভাসের সেই দেশের একজন নাগরিককে পিটিয়ে মারা হচ্ছে ধর্মের নামে। তারপর একে একে লাভ জিহাদ, শহুরে নকশাল ইত্যাদি। এই সব ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে একটি উনমত্ত দলকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বিশৃঙ্খলা তৈরি করার জন্য। গত একদশক ভারতে বর্ষে বজরং দল, হিন্দু সেনারা যেমন দাপিয়েছে তেমন ভাবেই দেখা গিয়েছে প্রশাসনিক কাঠামোকে ব্যবহার করে ‘এক দেশ, এক ভাষা, এক নেতা, এক ধর্ম’ এর তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গিকার।
আবার এই সরকার করোনাকালে ব্যার্থ হয়েছে বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষিত ভাবে বাড়ি ফেরাতে। প্রধানমন্ত্রীর অপরিকল্পিত লকডাউন দেশের গরীব মানুষকে আরও গরীব করেছে। কোন সামাজিক সুরক্ষা সেই সময় চালু করতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার। মানুষ কি খাবে? কি ভাবে বাঁচবে তার কোন দীশা তারা দেখাতে পারেনি। মানুষকে দীশা দেখানো তো দুর, মহারাষ্ট্র থেকে বাংলায় একজন শ্রমিক কি ভাবে ফিরবেন তার কোন ব্যবস্থা তারা করতে পারেনি। সেই সময় দেশ সাক্ষী থেকে মৃত মায়ের দেহ আগলে স্টেশনে বসে শিশুর কান্নার। দেশ সাক্ষী থেকে মাইলের পর মাইলে কলে সন্তান নিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন শ্রমিকরা।
ভারতের সংবিধান যেমন ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছে তেমন ভাবেই রাজ্য গুলোর ক্ষমতার কথাও বলেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুগ্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত যাতে রাজ্য এবং কেন্দ্র দুই সরকারই নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে।
দেশ দেখেছে এই সময় কালে একের পর এক আইন এনে রাজ্য গুলোর ক্ষমতার ওপর আঘাত আনা হয়েছে। জিএসটির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কর ব্যবস্থা চালু করে আদতে রাজ্য গুলোর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ওপর আঘাত আনা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা নীতি চালু করে শিক্ষা ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চেয়েছে আরএসএস, হ্রাস করা হয়েছে রাজ্যের ক্ষমতা। উল্লেখ্য কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধী মুখে করলেও এরাজ্যের শাসক দল তৃণমূল ঘুর পথে এই সব আইন ঘুরিয়ে এরাজ্যে চালু করেছে।
সম্প্রতি এক দেশ এক ভোট। কেন্দ্রের এই প্রস্তাবিত আইন বলছে রাজ্য বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচন হবে একসাথে। সরকারের যুক্তি এর ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেই বিপুল খরচ তা কমবে। কিন্তু আদতে কি তাই। অধ্যাপক জাদ মাহমুদের কথায়, সরকার চাইছে মানুষের ক্ষমতাকে হ্রাস করতে। তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে একটা পরীক্ষা। তারা মানুষের কাছে আসেন এই ভোটের সময়। একজন মানুষ লোকসভায় একটি দলকে ভোট দিতে পারেন কিন্তু বিধানসভা বা অন্য নির্বাচনে মনে করতে পারেন যে সেই তাকে দেবে না। এই এক দেশ এক ভোট হলে যেটা হবে স্থানীয় বিষয় আর গুরুত্ব পাবে না তখন জাতীয়তাবাদী জিগির তুলে ভোট পার করতে চাইবে কেন্দ্রে শাসক দল।’’
রাজনৈতিক বিশেষঞ্জদের মতে বিজেপি যেই ডবল ইঞ্জিনের কথা বলে তা আদতে এক দলীয় ক্ষমতা কায়েম করা। কেন্দ্রে যে রাজ্যেও সে আবার পৌরসভা পঞ্চায়েতেও সে।
ভারতীয় সংবিধান কখনই নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপের কথা বলে না। সংবিধান বহুত্ববাদের কথা বলে। কিন্তু বর্তমানে কেন্দ্রের শাসক দল এই ধারনার বিরোধী। আর তাই সংসদে দাঁড়িয়ে সংবিধান প্রনেতাকে অপমান করতে দুবার ভাবেন না দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
কিন্তু মনে রাখতে হবে দিনের শেষে মানুষ। জ্যাোতি বসুর কথা, ‘মানুষই ইতিহাস রচনা করেন।’ দেশের মানুষে এই নির্বাচনে ইতিহাস রচনা করেছেন, একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায়নি বিজেপি। ধাক্কা খেয়ে সংবিধান পরিবর্তনের পরিকল্পনা।
Comments :0