কয়লা, গোরু পাচারের পরে এবার বালি খাদান কেলেঙ্কারি ও বেআইনি বালি পাচারের তদন্তে সোমবার রাজ্যজুড়ে ঝটিকা তল্লাশি অভিযানে নামলো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। কয়লা পাচারের তদন্ত ইতোমধ্যে চার্জ ফ্রেম হয়েছে, বিচার পর্ব বাকি। গোরু পাচারের তদন্তেও দু’দফায় চার্জশিট জমা পড়েছে যদিও ‘মাথা’ সুরক্ষিত রেখে কানের আশপাশেই ঘুরেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
বালি পাচারের তদন্তে জোর কদমে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী মহল পর্যন্ত পৌঁছাবে? এই শঙ্কা জিইয়ে রেখেই সোমবার ভোর থেকে রাজ্যের ২২টি জায়গায় একযোগে তল্লাশি অভিযান ও জেরা শুরু করল ইডি। সাম্প্রতিককালে একযোগে এত বিস্তৃত অভিযান হয়নি। বেহালা থেকে রিজেন্ট কলোনি,সল্টলেক থেকে নিউটাউন, কল্যানি থেকে মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম থেকে বাঁকুড়া- একযোগে চলছে তল্লাশি ও জেরা। রাত পর্যন্ত একাধিক জায়গায় তা চলছে। ইতোমধ্যে গোপীবল্লভপুরে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে শাসক ঘনিষ্ঠ, একসময় ভিলেজ পুলিশ থেকে এখন বালি মাফিয়া বনে যাওয়া জাহিরুল আলির বাড়ি থেকে নগদ কয়েক লক্ষ টাকাও উদ্ধার করে ইডি।
সোমবারের এই তল্লাশি অভিযানে ভরকেন্দ্রে রয়েছে জি ডি মাইনিং প্রাইভেট লিমিটেড। ২০১১ সালে এই কোম্পানিটি তৈরি হয়। ২০২৪ সালে ধীমান চক্রবর্তী ও মনস্বিতা ঘোষ বর্তমানে বোর্ড অব ডিরেক্টরসে রয়েছে। যদিও বালি কারবারিদের অন্যতম মুখ অরুণ সরাফ আগে সংস্থার ডিরক্টর ছিলেন। এই কোম্পানি ছাড়াও অরুণ সরাফ আরও ১৫টি সংস্থাটির ডিরেক্টর বর্তমানে। এই ১৫টি সংস্থাই তৈরি হয়েছে তৃণমূল সরকারের আমলে, ২০১১’ র পর থেকে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি, মূলত টেন্ডারে বেনিময়, বালি ঘাট থেকে বালি তুলে পাচার, ভুয়ো প্যাড ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি। বালি পাচারের চক্রের শিকড় অনেক গভীরে। কোটি কোটি টাকার কারবার। কয়েকশো ভুয়ো ও শিখণ্ডী সংস্থা খুলে টাকা পাচারের সিন্ডিকেটও চলেছে। হাওলার মাধ্যমেও বালি পাচারের টাকায় কয়লা-গোরুর মডেলেই বিদেশে পাচার হয়েছে।
ইডি’র একটি সূত্রে জানা গেছে বালি পাচারের কারবারে এমনকি সরকারি মদতও রয়েছে। ওয়েস্ট বেঙ্গল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড( ডব্লিউবিএমডিটিসিএল)র ভূমিকাও সন্দেহজনক। পরিকল্পতিভাবে ছদ্ম টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু সংস্থাকে বালি পাচারের কারবার তুলে দেওয়া হয়েছে। সরকারি নজরদারির জায়গায় আনা হয়েছে বেসরকারি হস্তক্ষেপ। রাজস্বে ঘাটতি হচ্ছে তা জেনেও কীভাবে এবং কেন চলছে এই কারবার সরকারি নিস্পৃহতায়? কেলেঘাই-সুবর্ণরেখা থেকে দামোদর-অজয়ের বালিঘাট, নদীর পাড় দেখলেই খালি চোখে বোঝা যায় বালি পাচারের পরিনাম কী? শুকিয়ে যাচ্ছে এমনকি নদীর গতিপথও বদলে যাচ্ছে একাধিক জায়গায়।
বেহালার সখেরবাজারে জেমস লং সরণিতে, কলকাতার রিজেন্ট কলোনিতে, ঝাড়গ্রামের ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুর ১ এবং ২ নম্বর ব্লকে সহ একাধিক জায়গায় চলে তল্লাশি অভিযান। সুবর্ণরেখা নদীর পাড় ধরে একাধিক বালি খাদানেও তল্লাশি চলে। একাধিক জায়গায় রাত পর্যন্ত অভিযান চলছে। তদন্তকারী সংস্থার তরফে যদিও সরকারিভাবে কী বাজেয়াপ্ত হয়েছে তা এখনও জানানো হয়নি।
দক্ষিণ কলকাতার রিজেন্ট কলোনির রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থার এজেন্ট সঞ্জীব বয়েডের বাড়িতেও এদিন সকালে কেন্দ্রীয় বাহিনী সমেত হানা দেয় ইডি। জানা গেছে বিমা সংস্থার এজেন্ট হলেও হাওলার মাধ্যমে বালি পাচারের কালো টাকা সাদা করার কারবারে যুক্ত ছিল এই ব্যক্তি। গত এক দশকে তাঁর সম্পত্তিও আকাশ ছুঁয়েছে। ইডি অভিযানের সময় নিজের বাড়িতেই ছিলেন অভিযুক্ত সঞ্জীব বয়েড। ঐ এজেন্টের মোবাইল ফোনও বাজেয়াপ্ত করেছেন তদন্তকারী। উদ্ধার হয়েছে বেশ কিছু নথিপত্র। ইডি সূত্রে খবর, বালি পাচার ও কালো টাকা সাদা করার ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা হলে, তিনি যে সব দাবি করেন, তার সঙ্গে ইডির কাছে থাকা নথিপ্রমাণের মিল নেই।
জি ডি মাইনিং প্রাইভেট লিমিটেডের সখের বাজারের অফিসে, কল্যাণীতে সংস্থার বর্তমান ডিরেক্টর ধীমান চক্রবর্তীর বাড়িতে, সল্টলেকে অরুন সরাফের বাড়িতেও হানা দেয় ইডি। কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয় বাইরে। বালির কারবারি অরুণ সরাফ ও সংস্থার ডিরেক্টর ধীমান চক্রবর্তীকে বাড়িতেই ম্যারাথন জেরা শুরু করেন তদন্তকারীরা।
ঝাড়গ্রামে সবথেকে বেশি জায়গায় এদিন চলে ইডি’র কারবার। এদিন ভোর ৫ টায় বালি মাফিয়া নামে এলাকায় পরিচিত শেখ জাহিরুল আলির বাড়িতে হানা দেয় ইডি। ত ৯ টা পর্যন্ত সেখানে চলছে তল্লাশি অভিযান। কে এই শেখ জাহিরুল? একসময় সাইকেল সারাইয়ের দোকানে কাজ করতেন। এখন সুবর্ণরেখা নদীর পাড়ে চোখ ধাঁধানো ঝাঁ চকচকে তিলতলা অট্টালিকা। সেই বাড়ির উঠানে ডজন খানেক বিভিন্ন মডেলের বাইক। রয়েছে একাধিক চার চাকা। লরি, ডাম্পার , ট্রাক্টর, জেসিপি এগুলো নদীর চরে, ঝোপে পড়ে থাকে। জানা যায় এর আগে ভিলেজ পুলিশের চাকরি করতেন। আর সেই চাকরি বেশি দিন টেকেনি। সার্টিফিকেট জাল করে সেই কাজ পেয়েছিল এমনও অভিযোগ এলাকাবাসীর। তবে কাজের কাজটা করে ফেলেছিল। ভিলেজ পুলিশ থাকাকালীনই বালি ভর্তি লরি ডাম্পার পারাপারের দায়িত্বে। তখন দুই জেলারই এস পি ছিল বর্তমানে বিজেপি দলের নেত্রী ভারতী ঘোষ। আর তা থেকেই হাত পাকিয়ে সরাসরি বালি ব্যবসা।
ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর থানার নয়াবাসনে অবস্থিত শেখ জাহিরুল আলির সেই অট্টালিকায় আজ ভোর ৫ টায় হানা দেয় ইডি। প্রথম দফায় দুপুরে ১২ লক্ষ টাকা নগদ উদ্ধার হয় বলে জানা যায়। অবৈধ বালি খাদানের জেরে গোপীবল্লভপুরে সুবর্ণরেখা নদীর পাড় জুড়ে ১০ টি গ্রাম ভাঙনের মুখে। ইতোমধ্যে ৪০০ বিঘা চাষের জমি, আম বাগান, ফুটবল খেলার মাঠ, আইসিডিএস কেন্দ্র সুবর্ণরেখা গর্ভে তলিয়ে গেছে। জিডি মাইনিং প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গেই জড়িত জাহিরুল। এর পাশিপাশি বেলিয়াবেড়া থানার ভামাল এলাকায় অমরজিৎ বেরা এবং আসকলা এলাকার দুঃখীরাম বাগের বাড়িতেও অভিযান চালানো হয়।
ঠিকাদার ব্যাবসার পাশাপাশি বালি ব্যবসায় গিয়ে উত্থান। সেই বালি ব্যাবসায়ী সৌরভ রায়ের মেদিনীপুর শহরের বাড়িও সকাল থেকে চলে তল্লাশি। মেদিনীপুরের অট্টালিকা সহ একাধিক বিলাসবহুল বাড়ির মালিক সৌরভ রায়ের রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলা সহ একাধিক জায়গায় সম্পত্তি রয়েছে। সরকারিভাবে লিজে নেওয়া বালি খাদানের পাশাপাশি বেআইনি খাদান থেকে বালি পাচার ঘটনায় কেবল বালি ব্যবসায়িরা জড়িত এমনটি নয়। আমলা, প্রসাশনিক আধিকারিক, শাসকদলের কাছেও ভাগ পৌঁছাতো কোটি কোটি টাকা। সেই কাঁচা টাকার খিদের পরিণামে এখন ভাঙনের মুখে কাঁসাই, সুবর্ণরেখা নদীর পাড় জুড়ে শতশত মৌজা। পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরিতেও বালি পাচার কাণ্ডের তদন্তে হানা দেয় ইডি। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরি -১ ব্লকে হেঁড়িয়া অঞ্চলের জরাননগর গ্রামে বালি ব্যবসায়ী দিলীপ প্রধানের বাড়িতে ভোরে হানা দেয় ইডি। জেলার সুবর্ণরেখা, গোপীবল্লভপুর সহ বিভিন্ন এলাকার বালি খাদান থেকে বালি সরবরাহ করেন।
ED Raids
রাজ্য জুড়ে ইডি’র তল্লাশি, নগদ উদ্ধার

×
মন্তব্যসমূহ :0