আগামী বছর লোকসভা নির্বাচন। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সেই নির্বাচনে বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে যদি আরএসএস-বিজেপি ফের ক্ষমতা দখল করতে পারে তাহলে সেই সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয় হবে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো। এক বছর পরই আরএসএস প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদ্যাপন হবে মহা সমারোহে। আর শতবর্ষের সেই মহা সমারোহের মধ্যেই ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণার গোপন অ্যাজেন্ডা তৈরি হয়ে গেছে। তার জন্য প্রয়োজনীয় আগাম প্রস্তুতির কাজও দ্রুত সেরে ফেলার চেষ্টা চলছে। আরএসএস-র প্রচারক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একান্তভাবেই চাইছেন তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর নেতৃত্বেই ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক। ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর হিন্দুত্ববাদী গৌরবগাথা তাঁকে ঘিরেই রচিত হোক। তাই আর বিলম্ব না করে তাঁর তৃতীয় দফার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে আরএসএস-র শতবর্ষে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ রহিত ধর্মান্ধতার যুপকাষ্ঠে বহুত্ববাদী উদার ভারতকে বলি দিতে মরীয়া হয়ে উঠেছেন।
স্মরণ করা যেতে পারে ২০১৪ সালে প্রধানত উন্নয়ন ও বিকাশের ইস্যুতে সামনে রেখে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বিষ ছড়ানো হাজারো কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেওয়া হলেও আরএসএস’র হিন্দুত্ববাদী গোপন অ্যাজেন্ডাগুলি রূপায়ণে আগ্রাসী তৎপরতা দেখানো হয়নি। তথাকথিত গোরক্ষা, লাভ জিহাদ, ধর্মান্তকরণ ইত্যাদি বিষয়গুলিকে সামনে রেখে উগ্র ও হিংস্র গেরুয়াবাহিনী প্রশ্রয় ও মদত দেওয়া হয়েছিল মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর লক্ষ্যে যাতে ধর্মীয়ভাবে সমাজে বিভাজন রেখা তৈরি করা যায় এবং মেরুকরণ তীক্ষ্ণ হয়। পাশাপাশি মুসলিম শাসনের নিদর্শনগুলি জনমানস থেকে মুছে ফেলার পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া হয় বিভিন্ন জায়গার বা প্রতিষ্ঠানের নাম বদলের মধ্যে দিয়ে।
২০১৯ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় এসেই প্রথম বড় মাপের আক্রমণ হয় সংবিধানের উপর। সংসদে সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে কার্যত কোনো রকম আলোচনা-বিতর্ক ছাড়াই একতরফা স্বৈরাচারি সিদ্ধান্তে সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫(ক) ধারা বাতিল করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার বা মর্যাদা সরাসরি কেড়ে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে পুর্ণাঙ্গ রাজ্যটিকে ভেঙে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল গঠন করা হয়। মুসলিম প্রধান এই রাজ্যের মানুষের যাবতীয় গণতান্ত্রিক অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। গোটা দেশের সংখ্যালঘু মুসলিমদের বার্তা দেওয়া হয় আরএসএস নিয়ন্ত্রিত ভারতে তার হাল কি হতে চলেছে। অতপর সিএএ, এনপিআর,এনআরসি করে সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার হুমকি দেওয়া। মোদীর প্রথম দফার শিক্ষাক্ষেত্রে গেরুয়াকরণের প্রাথমিক পদক্ষেপ শুরু হলেও আমূল পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয় দ্বিতীয় দফায়। দেশের ইতিহাসটাকেই বদলে হিন্দুত্বের ঘেরাটোপে মনগড়া বিকৃত ইতিহাস লেখা হয় এবং তাকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয় পাঠ্য সূচিতে। বাছাই করে বাদ দেওয়া হয় বিজ্ঞান চেতনা বিকাশের ও যুক্তিবাদী মন তৈরির যাবতীয় সূচি। স্বাধীন ভারতের অতীত ৭৫ বছরের যাবতীয় গৌরবকে মুছে ফেলে নতুন ‘আধুনিক’ গেরুয়া ভারতকে তুলে ধরা হচ্ছে। এই ভারতের আইকন হবে রামমন্দির, চার ধাম যাত্রা, নতুন সংসদ ভবন ইত্যাদি। অর্থাৎ দু’দফায় দশ বছর ধরে হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার প্রাথমিক কাজগুলি দ্রুত সেরে ফেলা হচ্ছে।
এরপর যে কোনও মূল্যে ২০২৪ সালের নির্বাচনে যদি জেতা যায় তাহলে আর কোনদিকে না তাকিয়ে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হবে। তার জন্য বদলে ফেলা হবে সংবিধান। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা চিরতরে বর্জন হবে। হিন্দুধর্মীয় অনুশাসনগুলি জায়গা করে নেবে সংবিধানে। ধর্মান্ধ-স্বৈরাচার রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীর দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে। সংখ্যাগুরুদের অধীনতা মেনে চলতে হবে সংখ্যালঘুদের। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে ভারত রূপান্তরিত হবে আধিপত্যবাদী স্বৈরশাসনে।
সম্প্রতি সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি আরএসএস-বিজেপি’র এই পরিকল্পনা সম্পর্কে দেশবাসীকে সঙ্গতভাবেই সতর্ক করে দিয়েছেন। এখন থেকেই যদি এদের রোখার প্রচেষ্টা শুরু না হয় তাহলে সমূহ বিপদ। বিশ্বের উদার গণতন্ত্রের মানচিত্রে ভারতের নাম উজ্জ্বল রাখতে হয় তাহলে আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-কে হারাতেই হবে।
Editorial
কিছুতেই নয় হিন্দুরাষ্ট্র
![](https://ganashakti-new-website.s3.ap-south-1.amazonaws.com/5830/645d333fe3f90_444361-rsspracharaks.jpg)
Comments :0