চন্দন দাস
জাফরাবাদ এখন ‘হিন্দুদের গ্রাম’। নিহতরা এখন স্রেফ ‘হিন্দু’। পুলিশ যদি আতঙ্কিত গ্রামবাসীদের ফোন পেয়েই ছুটে যেত ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায়, তাহলে পরের দিন সকালে হরগোবিন্দ দাস, চন্দন দাসকে খুন হতে হতো না। লুট হতো না এতগুলি সংসারে। জ্বলতো না এতগুলি ঘর। দুষ্কৃতীরা পিছু হটতো। হামলাবাজদের বোঝাতে ‘মুসলমানরা এমনই হয়’ বলার সুযোগ পেতো না আরএসএস, বিজেপি।
তৃণমূল চেয়েছে, তাই সঙ্ঘ সুযোগ পেয়েছে। আশ্রয়শিবিরে ভাষণ দিতে গিয়ে বিজেপি’র সাংসদ বলছেন,‘সনাতন ধর্মের মানুষ আক্রান্ত।’ অর্থাৎ মাটি গিলতে গিলতে ধুলিয়ানকে ভেঙে ফেলতে বসা গঙ্গার আগ্রাসন ব্রাত্য। খতরে মে হ্যায় স্রেফ হিন্দু!
কিন্তু যতজন হামলা করেছিলেন, তার অনেক গুণ বেশি মুসলমান মানুষের বাস জাফরাবাদ, বেতবোনার আশপাশে। তারা তবে কী? মুসলমান? নাকি নেহাতই গ্রামবাসী? নাকি সবাই হামলাবাজ?
ধর্মের ভিত্তিতে এই পরিচয় প্রতিষ্ঠার রাজনীতি ছুটছে। খুব দ্রুত রাজ্যের গ্রামগুলিকে প্রধানত ধর্মীয় পরিচয়ে ভাগ করার ব্লুপ্রিন্ট নিয়ে এগচ্ছে তৃণমূল, বিজেপি। যেমন বাংলাদেশকে ‘মুসলমানদের দেশ’ করে তুলতে চাইছে সেখানকার মৌলবাদীরা। এখানে জাফরাবাদের মতোই পারলালপুর ‘হিন্দু নমশূদ্র’দের গ্রাম বলে চিহ্নিত হচ্ছে। গঙ্গার ওপারে, মালদহের ওই গ্রামেই আশ্রয় নিয়েছেন জঙ্গিপুরের আক্রান্ত পরিবারের একাংশ। মূলত মৎস্যজীবী, কৃষিজীবীদের গ্রাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে বলা হচ্ছে—‘নমশূদ্র হিন্দুদের গ্রাম।’
ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারের শিকার, গরিব নমশূদ্ররা এখন হয়ে উঠছেন ‘হিন্দু’— আরএসএস’র কৌশল। ব্যাঙ্গালোরে তাদের সাম্প্রতিক প্রতিনিধি সভাতেও এই কৌশলের ঘোষণা আছে। যাদের উপর এতদিন সামাজিক শোষণ চালিয়েছে, তাদের এখন ‘হিন্দু বিপন্ন’ বলে দল ভারী করতে নেমেছে।
আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে এই সুযোগ পাচ্ছে তৃণমূলের সরকারের ইচ্ছায়। তৃণমূল-বিজেপি’র কৌশলে আমাদের শরীরে সেঁটে দেওয়া হচ্ছে ধর্মীয় পরিচয়। অথচ আমাদের কেউ কাজ চান, কেউ ব্যবসা করেন, কেউ টোটো চালান, কেউ রিকশাচালক, কেউ পরিচারিকা, কেউ চাষ করেন, কেউ দিনমজুর, কেউ শিক্ষক, কেউ সরকারি কিংবা বেসরকারি অফিসের কর্মী। কেউ আরও অন্য পেশায় আছেন। জীবিকা অনেক ক্ষেত্রে আমাদের পরিচয়ের মাপকাঠি ছিল। জীবিকার যন্ত্রণা আমাদের টেনে আনতো রাস্তায়, ময়দানে, জীবনের মানোন্নয়নের দাবিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতাম।
সেই আমরা, সরকারের উদ্যোগে, তৃণমূল-বিজেপি’র কৌশলে পরিচিতি প্রাপ্ত হচ্ছি, অনেকটাই অজান্তে— হিন্দু অথবা মুসলমান। কারণ? সরকারের কর্মসূচি হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্মীয় বিভাজন। সরকার জমি দিচ্ছে না, কারখানা বানানোর উদ্যোগ নিচ্ছে না। মন্দির বানাচ্ছে।
নন্দীগ্রামে কী হচ্ছে? সেখানে কারখানা হওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। সেখানে মন্দির হচ্ছে। তাজপুরের বন্দরের সম্ভাবনা ডুবে গেছে গভীর জলে। কাছেই দীঘা। সেখানে মন্দির উদ্বোধনের অপেক্ষায়। পনেরো বছর আগেও পশ্চিমবঙ্গ কৃষি, শিল্প, কাজের আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনায় ছিল। এখন আমরা মন্দির নিয়ে আছি।
সোনাচূড়ায়, জেলিঙহ্যামে বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের পরিত্যক্ত জমিতে তিনবার, তিন রকম শিল্পের ঘোষণা করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। প্রতিবারই তার পাশে ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। এখন সেই শুভেন্দু অধিকারী সোনাচূড়াতেই রামমন্দিরের শিলান্যাস করেছেন। সে মন্দির ‘বেসরকারি।’ সরকারি মন্দিরও হচ্ছে। সেটি দীঘাতে, জগন্নাথের। প্রায় ২৬০ কোটি সরকারি কোষাগারের টাকায় বানানো সেই মন্দিরের ঝাঁটার জন্য ৫লক্ষ টাকা দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
এখন নন্দীগ্রাম থেকে কয়েক হাজার যুবক কাজ করতে যান তামিলনাডু, কেরালা, দিল্লিতে। নন্দীগ্রামের চাষের জমির এক বিরাট অংশ ভ্যানামি হয়েছে। কৃষক হয়েছেন মাছচাষের লিজ দেওয়া শ্রমজীবী। বিরোধী দল বিজেপি। তারা বিধানসভায় কর্মসংস্থানের হিসাব চায় না। বিনিয়োগের পরিমাণ জানতে চায় না। তাঁদের নেতা, বিজেপি’র মুখ শুভেন্দু বলেন, ‘‘জিতে এলে ওদের মুসলমান এমএলএ-দের রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেবো।’’ জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন,‘‘আমি ব্রাহ্মণের মেয়ে। আমি যেখানে শুই, তার মাথার দিকে একটি শিবমন্দির আছে।’’
বিধানসভা প্রায় ধর্মসভায় পরিণত হয়েছে। রাজ্যের গ্রাম-শহর পরিণত হচ্ছে ‘জঙ্গিপুর’-এ।
এমন সরকারই ওয়াশিংটন চেয়েছিল। ইঙ্গিত মিলেছিল এমনই এক এপ্রিলে। মার্কিন প্রশাসন মমতা ব্যানার্জিকে ‘আরও ভালো করে ব্যবহার’ করতে চায়, সেদিন ফাঁস হয়েছিল। সেদিন ভাঙড় কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর বক্তব্য শুনেছিল।
সেদিন আজকের বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গের আশঙ্কা ইঙ্গিত দিচ্ছিল। সেদিনও ২০ এপ্রিল ছিল। শুধু বছরটি ছিল ২০১১।
বামফ্রন্ট সরকার তার এক বছর আগে সামাজিক, আর্থিক, শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে থাকা সংখ্যালঘুদের ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে তৃণমূল নেত্রী তখন প্রচার চালাচ্ছিলেন। মমতা ব্যানার্জি বলছিলেন,‘‘সিপিএম মুসলিমদের জন্য সংরক্ষণের নামে ভাঁওতা দিয়েছে। হিন্দুদের চাকরি থেকে খানিকটা কেটে মুসলিমদের দিয়ে দিয়েছে।’’ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেদিন ভাঙড়ের জনসভায় বলেছিলেন,‘‘হিন্দু ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষণের কোটা থেকে কেটে মুসলিমদের দেওয়া হয়েছে? এটা শুধু মিথ্যাই নয়, চরম সাম্প্রদায়িক কথা। হিন্দুদের রাগিয়ে দেওয়ার জন্য এসব বলা হচ্ছে।...সংরক্ষণ থেকে বড়লোক মুসলিমদের বাদ দিয়েছি। হিন্দু ওবিসি-দের কোটা কমানো হয়নি। আগে ওবিসি কোটা ৭শতাংশ ছিল, এখন সেটা বাড়িয়ে ১৭শতাংশ করা হয়েছে। তৃণমূল সাম্প্রদায়িক প্রচার চালাচ্ছে।’’
রাজ্যের মানুষকে হিন্দু আর মুসলমানে ভাগ করে দেওয়ার চক্রান্ত সেই সময়েই নিয়েছিল তৃণমূল।
মমতা ব্যানার্জির এমন নানা কাণ্ডকেই মার্কিন প্রশাসন বলেছিল, ‘উৎসাহব্যঞ্জক।’ উইকিলিকসের ভারত সংক্রান্ত মার্কিন দূতাবাস এবং কনস্যুলেটগুলির মধ্যে ২০০৯-এর অক্টোবরের কিছু বার্তা বা কেবল সেই সময় ফাঁস হয়। সেখানেই জানা যায়, ২০০৯-এর ২০ অক্টোবর কলকাতায় মার্কিন কনস্যুলেটের পাঠানো কেবল (নং২৩০৩৫৩)-তে বার্তটিকে তারা চিহ্নিত করেছিল ‘স্পর্শকাতর’ হিসাবে। সেখানে জানানো হয়,‘‘তাঁর দলের প্রকাশ্য ঘোষণার মধ্যে কোনও মার্কিন বিরোধিতা নেই। কনস্যুলেটের অফিসারদের সঙ্গে তাঁর দলের বেসরকারি যোগাযোগ আছে। দুটিই উৎসাহব্যঞ্জক ইঙ্গিত যে ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিপিআই(এম)’র সরকারের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বেশি বন্ধুত্বমূলক হবে। কনস্যুলেট সুপারিশ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি পদাধিকারীরা ব্যানার্জিকে আরও ভালো করে ব্যবহার করা অব্যাহত রাখুন।’’
সেই বার্তায় মার্কিন কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা তৃণমূল নেতাদের সম্পর্কে লেখা হয়েছিল ‘প্রাইভেট আউটরিচ।’ সোজা কথায়, তৃণমূলের নেতারা মার্কিন প্রশাসনের ‘খোচর’ হিসাবে কাজ করছিলেন। আর সেই বার্তায় মমতা ব্যানার্জিকে ‘আরও ভালো করে ব্যবহার’ বোঝাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ‘কালটিভেট’ করতে।
তৃণমূল যখন আরএসএস, মাওবাদী, জামাতের মতো শক্তির সাহায্যে রাজ্যের পশ্চিমবঙ্গকে ধর্ম, জাতের নামে ভাগ করার চেষ্টা করছিল, ‘কৃষক দরদি’ সেজে রাজ্যের যুবকদের কাজের সম্ভাবনা ধ্বংস করতে হাঙ্গামা চালাচ্ছিল, ঠিক তখন মমতা ব্যানার্জিকে ‘কালটিভেট’ করায় আরও জোর দিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। ‘কালটিভেট’ মানে চাষ করা, আবাদ করা। অর্থাৎ মমতা ব্যানার্জি এবং তার দলকে এই দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার গুরুত্বপূর্ণ জমি মনে করেছিল পৃথিবীর মানুষের, সভ্যতার পয়লা নম্বর শত্রু। ‘বামফ্রন্ট বেছে বেছে মুসলমানদের জমি কেড়ে নিচ্ছে’— জমিতে এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনও সেই সময়ে হাজির হয়েছিল তৃণমূলের প্রচারে।
তিনটি কাজ গত চোদ্দ বছরে হয়েছে। প্রথমত, ভারতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী, আরএসএস-জামাত-সাম্প্রদায়িকতার সবচেয়ে প্রবল বিরোধী কমিউনিস্টরা দুর্বল হয়েছে। কারণ্য পশ্চিমবঙ্গ ছিল তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি। দ্বিতীয়ত, যখন দেশে কমিউনিস্টদের দুর্বল করা হচ্ছে, তখনই নরেন্দ্র মোদী এবং মমতা ব্যানার্জির ক্ষমতা দখল। দু’জনেই আরএসএস’র অত্যন্ত বিশ্বস্ত। মমতা ব্যানার্জির দল আবার মুসলিম মৌলবাদী শক্তিরও ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশকে উত্তপ্ত করতে, হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে সেই দেশের মৌলবাদী শক্তির কাছে সারদার চুরির টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। ফলে পশ্চিমবঙ্গ এখন দুই ধরনের সাম্প্রদায়িক শক্তিরই কিলবিল করার ভূখণ্ড। তৃতীয়ত, বামফ্রন্ট সরকার কিছু সঙ্কট আগে থেকে অনুধাবন করে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। যেমন কাজের হাহাকার, চাষ ক্রমশ অলাভজনক হয়ে ওঠা, ফসলের অভাবী-বিক্রির আশঙ্কা, গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের আরও স্কুলের অঙ্গনে নিয়ে আসা, পঞ্চায়ে-পৌরসভাগুলিতে ঘনীভূত সমস্যা সামলাতে আরও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। ‘কৃষির সাফল্যের উপর ভিত্তি করে শিল্প’ কিংবা ‘ভূমিসংস্কার এবং পঞ্চায়েত রক্ষা করতে শিল্পায়ন’— এই সবই ছিল সময়ের দাবি।
আজ বোঝা যাচ্ছে। স্পষ্ট। রাজ্যের পঞ্চায়েত, পৌরসভা নিষ্ক্রিয়। কৃষক ফসলের দাম পাওয়ার আশাই ছেড়ে দিচ্ছেন। জমি আবার কয়েকজনের হাতে পুঞ্জিভূত হচ্ছে। কাজের হাহাকার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলায় গ্রামের গ্রামে যুবকরা হাতে গোনা থাকেন, বেশিরভাগই ভিন রাজ্যে আছেন। অন্য রাজ্যের খোলামকুচির মতো শস্তা শ্রম কুড়িয়ে নেওয়ার মাটি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।
রবিবারের ব্রিগেডের এটিই পরিপ্রেক্ষিত।
আর বাস্তবতা? ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে একটি ব্রিগেড সমাবেশ রাজ্য দেখেছিল। তার আগে দীর্ঘ ‘ইনসাফ যাত্রা’ হয়েছিল। কাজের দাবিতে যুব, ছাত্র সমাজের সেই আন্দোলন-প্রচারের প্রতিফলন শ্রমজীবী, মধ্যবিত্তরা দেখিয়ে দিয়েছিলেন জনপ্লাবনে, ব্রিগেডেই। তারপর আর জি কর হাসপাতালে ট্রেনি চিকিৎসক তরুণীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডর পরে জ্বলে উঠেছে গণআন্দোলনের শিখা। সমাজের সব অংশের মানুষকে দেখা গেছিল সেই দিন-রাতের সীমানা ছাড়িয়ে মাথা তোলা লড়াইয়ে। সাম্প্রতিককালে নিয়োগ-দুর্নীতি সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে মমতা-সরকারের ব্যর্থতা, তৃণমূলের চাকরি-চুরির বিরুদ্ধেও সমাজের প্রতিটি স্তরে দেখা গেছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। গ্রাম, শহর ঘৃণা করছে তৃণমূলকে।
সেই ঘৃণাকে শাসকের দিক থেকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে তৃণমূল-আরএসএস। প্রমাণ জঙ্গিপুর। সেই ঘৃণাকে শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চরিত্র দিতেই ব্রিগেডের ডাক।
Comments :0