আবাস যোজনায় নথিভুক্ত ৮৪ শতাংশ উপভোক্তার তথ্য যাচাই এখনও সম্পূর্ণ করতে পারেনি রাজ্য সরকার। এই অবস্থায় আগামী তিন দিনের মধ্যে ৯ লক্ষ বাড়ির অনুমোদন চূড়ান্ত করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে নবান্ন।
সময়ের মধ্যে টাকা খরচ করতে না পারলে কেন্দ্রীয় সরকারের চাপ। আবার দ্রুত কাজ করতে গিয়ে দুর্নীতিতে জেরবার হয়ে থমকে প্রশাসন। দুই সাঁড়াশি চাপে দিশাহারা রাজ্য সরকার।
আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে সম্পূর্ণ করতে হবে ১১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৪৮৮টি বাড়ি নির্মাণের কাজ। ৯০ দিন সময়ের মধ্যে বাড়ি তৈরির টাকা শেষ করতে না পারলে জরিমানার খাঁড়া ঝুলছে। সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হলে বাড়ি পিছু জরিমানার শর্ত চাপিয়ে দিয়ে রাজ্যের জন্য আবাস যোজনায় চলতি আর্থিক বছরে অর্থ বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র। জরিমানার টাকা কাটা হবে কেন্দ্রের বরাদ্দের তহবিল থেকে। ফলে তিন দিনের মধ্যে আবাস যোজনায় নথিভুক্ত বাড়ির অনুমোদনের সঙ্গে আগামী তিন মাসের মধ্যে ১১ লক্ষ বাড়ির নির্মাণ কাজ শেষ করার চাপ এখন রাজ্যের মাথায়।
পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে বুধবার নবান্ন থেকে রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের আধিকারিক ও জেলাশাসকদের সঙ্গে আবাস যোজনা নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠক থেকে উঠে আসে, এখনও পর্যন্ত চলতি অর্থবর্ষে (২০২২-২৩) ১১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৪৮৮টি বাড়ির মধ্যে ৫ লক্ষ ৯১ হাজার বাড়ি নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। নথিভুক্ত ৫ লক্ষ ৯১ হাজার বাড়ির মধ্যে অনুমোদিত হয়েছে মাত্র ১ লক্ষ ৮১ হাজার বাড়ি। এদিন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৬ শতাংশ বাড়ি আবাস যোজনায় ছাড়পত্র পেয়েছে।
আরও জানা গিয়েছে, এদিন পর্যন্ত রাজ্যে সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশ বাড়ির অনুমোদন দেওয়া গিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলাতে। ৪৬ হাজার বাড়ির মধ্যে বাঁকুড়া জেলাতে অনুমোদন মিলছে মাত্র ১৪ হাজার ২৮৯টি বাড়ির। অনুমোদনের শতাংশের হিসাবে জেলাভিত্তিতে এটাই সর্বাধিক। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে পুরুলিয়া জেলা। মাত্র ২.৪৭ শতাংশ বাড়ির অনুমোদন দেওয়া গিয়েছে। চলতি আর্থিক বছরে পুরুলিয়া জেলায় ৪৪ হাজার বাড়ি তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। তার মধ্যে এদিন পর্যন্ত মাত্র ১০৯৫টি বাড়ি নির্মাণের প্রস্তাবকে চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে পেরেছে জেলা প্রশাসন। আবাস যোজনায় ঘর নিয়ে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন পঞ্চায়েত এলাকায় মানুষের ক্ষোভ গত কয়েক দিন ধরে টের পেয়েছে প্রশাসন। সেই মুর্শিদাবাদে এখনও পর্যন্ত মাত্র ৩.৫৩ শতাংশ বাড়ি চলতি আর্থিক বছরে অনুমোদন পেয়েছে।
পরিস্থিতি যাচাই করে এদিন নবান্ন থেকে তিন দিনের মধ্যে অনুমোদনকে চূড়ান্ত করার কথা বলতে হয়েছে মুখ্যসচিবকে। সূত্রের খবর, যেভাবে প্রতিদিন আবাস যোজনা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ সামনে আসছে, তাতে সরকারের অস্বস্তি বাড়ছে। অনুমোদন পর্ব মিটিয়ে টাকা ছাড়ার কাজ শুরু হলে গণ অসন্তোষে কিছুটা লাগাম পরানো যাবে বলে মনে করছে রাজ্য সরকার। তাই এদিন সভা করে জেলাশাসকদের কাছে তিন দিন সময় বেঁধে দিয়ে ৮৪ শতাংশ বকেয়া অনুমোদন সেরে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বছরের শেষ সময়ে মোদী সরকারের যাবতীয় শর্তের কাছে মাথা নুইয়ে নবান্ন আবাস যোজনা প্রকল্পে ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ আদায় করার পর থেকে দ্রুতগতিতে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু পঞ্চায়েত দপ্তরের তৈরি করা সময়সীমা শুরুতেই হোঁচট খেতে শুরু করে। আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের দিয়ে গ্রামে সমীক্ষা পর্ব চালানো থেকে শুরু হয় গোলমাল। তারপর থেকে ফি দিন রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় চলছে বাড়ি নিয়ে অশান্তি।
এরাজ্যে আবাস যোজনায় ৩৯ লক্ষ ৮৯ হাজার নাম যোগ্য তালিকাভুক্ত হয়ে আছে। সেই তালিকা নিয়ে সমীক্ষায় নেমেছিলেন আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। আর তাতেই উঠে আসে আবাস দুর্নীতির ভয়াবহ ছবি। তালিকা থেকে ১১ লক্ষ নাম চলতি আর্থিক বছরের জন্য বাছাই করার কথা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মাত্র ৫ লক্ষ ৯১ হাজার নাম নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। নথিভুক্তি করার কাজ মূলত করা হয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েত ও ব্লক স্তর থেকে। সমীক্ষা, অনুসন্ধান পর্ব মিটিয়ে তবেই ৫ লক্ষ ৯১ হাজার নাম এখন্ পর্যন্ত নথিভুক্ত করা হয়েছে।
এই নথিভুক্তির পরের ধাপেই আছে অনুমোদন। নথিভুক্ত হওয়ার পর জমির কাগজপত্র, ব্যাঙ্কের পাসবই, আধার নম্বর দিয়ে বাড়ি নির্মাণের প্রস্তাব অনুমোদনের চূড়ান্ত কাজ করতে হয় জেলা প্রশাসনকে। এখনও পর্যন্ত মাত্র ১ লক্ষ ৮১ হাজার বাড়িকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে ১১ লক্ষ বাড়িকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার পরই টাকা ছাড়ার কাজ শুরু হবে।
পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, অতীতে আবাস যোজনার অনুমোদনে এত দীর্ঘ সময় লাগত না। কিন্তু এখন যেভাবে আবাস যোজনা নিয়ে মানুষের ক্ষোভে প্রতিদিন উত্তাল হয়ে উঠছে রাজ্যের গ্রামাঞ্চল, তাই প্রশাসনও ধীরে পদক্ষেপ নিচ্ছে। ফলে চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে প্রতিটি কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কিন্তু দেরি করারও বিপদ আছে। সামনে সময় বলতে মাত্র তিন মাস। ৩১ মার্চের মধ্যে বাড়ি নির্মাণের টাকা সম্পূর্ণ খরচ করতে না পারলে জরিমানার খাঁড়া ঝুলছে।
Comments :0