গণশক্তি: সাক্ষাৎকারের শুরুতেই আপনাকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাই। কিন্তু একই সঙ্গে জানতে চাইছি, আপনি কি মনে করেন ২০২৩ সাল সত্যিই ভারতবাসীর কাছে সুখ নিয়ে আসবে?
প্রকাশ কারাত: এর উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন। কারণ মানুষ সবসময়ই আশা করে যে নতুন বছর তাঁদের জন্য সুখ আনন্দ নিয়ে আসবে। কিন্তু দুঃখের কথা, গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা বলছে ইচ্ছাপূরণের জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করা ছাড়া সাধারণ মানুষের গতি নেই। তবে আমি আশা করব, আনন্দের দিন আনার জন্য এই বছর মানুষ এগিয়ে আসবেন এবং বর্তমান দুর্দশার জন্য শাসককে দায়ী করবেন।
গণশক্তি: বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের পিছনে বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির সমর্থনের কথা আপনারা বারে বারে বলছেন। কিন্তু বৃহৎ পুঁজি কেন অন্যান্য বুর্জোয়া দলের পরিবর্তে হিন্দুত্ববাদীদেরই মদত দিচ্ছে?
কারাত: মোদী সরকারের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হলো হিন্দুত্ব প্রকল্পের সঙ্গে দেশের কর্পোরেট শক্তির আঁতাত। অন্যভাবে বলা যায়, আরএসএস এবং বৃহৎ বুর্জোয়ারা এর মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ খুঁজে পেয়েছে। সরকার নয়া উদারনীতি রূপায়ণ করছে যাতে বৃহৎ পুঁজিপতিদের সুবিধা হয়, অন্যদিকে বৃহৎ পুঁজিপতিরা হিন্দুত্ববাদীদের হাতে দেশের সেই স্থিতিশীলতা খুঁজে পেয়েছে যাতে তাদের স্বার্থপূরণের অবস্থা বজায় থাকে। কাজেই এটা উভয়ের পারস্পরিক স্বার্থপূরণের জন্যই ঘটছে।
গণশক্তি: হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা আক্রান্ত, সেটা রক্ষার জন্য দেশের বিচারবিভাগেরও সাংবিধানিক দায়িত্ব আছে। কিন্তু আপনি কি মনে করেন বিচারবিভাগের স্বাধীনতা এখন কমে যাচ্ছে?
কারাত: বিজেপি সরকারে আসার পরে গত সাড়ে আটবছরে আমরা ধারাবাহিকভাবে দেখতে পারছি সংবিধান এবং সাংবিধানিক সংস্থাগুলিকে সরকারের অধীনস্ত করার চেষ্টা চলছে। বিচারবিভাগও তাদের লক্ষ্যবস্তু। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী বিচারপতি নিয়োগে সরকারের এক্তিয়ার বাড়ানোর মন্তব্যে যে বিতর্ক তুলেছেন তাতে স্পষ্ট যে তারা একটি অনুগত বিচারবিভাগ চাইছে, সরকারের অনুগত। সুপ্রিম কোর্ট সমালোচনা করেছে। সুপ্রিম কোর্ট সরকারের থেকে স্বাধীনতা ভোগ করে, আমরা কখনোই এমন কোনও ব্যবস্থা সমর্থন করতে পারি না যেখানে আদালত সরকারের অধীনস্ত হয়ে পড়ে।
গণশক্তি: আমাদের সংবিধানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। দক্ষিণের রাজ্যগুলি, বিশেষত কেরালার মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করছেন যে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা খর্ব করছে। এই সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
কারাত: আমার মনে হয় সব অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যই এই অভিযোগ করছে। মোদী সরকার স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করছে এবং রাজ্যগুলির অধিকার খর্ব করছে। রাজ্যগুলি প্রাপ্য অধিকার, তাদের প্রাপ্য অর্থ, কর ও সম্পদের ভাগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো যৌথ তালিকার বিষয়গুলিতে তাদের অধিকার, এগুলি অস্বীকার করা হচ্ছে। তাছাড়া বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিতে রাজ্যপালকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজ্য সরকার পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে। কেরালায় রাজ্যপালকে দিয়ে পছন্দমতো উপাচার্য নিয়োগ করানো নিয়ে সমস্যা হয়েছে, রাজ্যপাল আইন মেনে চলেননি। এটা হিন্দুত্বের কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপরে সামগ্রিক আক্রমণের অঙ্গ। জিএসটি’র ক্ষতিপূরণ না দেওয়া, জিএসটি’র পরিবর্তে সেস বসিয়ে রাজ্যগুলিকে সংগৃহীত অর্থের ভাগ না দেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে আমার মনে হয় সব অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির একটি বৃহত্তর মঞ্চে একজোট হয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত।
গণশক্তি: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও একইরকম অভিযোগ করছেন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। তিনিও কেন্দ্রের থেকে আবাস যোজনা সহ বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা না পাওয়ার অভিযোগ করছেন। আপনি কি মনে করেন তাঁর অভিযোগও একইরকমভাবে সত্য?
কারাত: পশ্চিমবঙ্গে দুই ধরনের ইস্যু রয়েছে। এখানেও পূর্ববর্তী রাজ্যপাল ধনকড় অসাংবিধানিকভাবে কাজ করেছেন। আমরা কোনও রাজ্যপালেরই অসাংবিধানিক কাজ সমর্থন করি না। কিন্তু কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা না দেওয়ার সমস্যাটা পশ্চিমবঙ্গে একইরকম নয়। এখানে টাকা বেআইনিভাবে খরচ হয়েছে, সাইফন হয়েছে অন্য খাতে। আবাসের টাকা, একশো দিনের কাজের টাকা অপব্যবহার হয়েছে। দুঃখের কথা হলো, কেন্দ্র আর রাজ্যের মধ্যে বিবাদে গ্রামের গরিব লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যাদের টাকা প্রাপ্য ছিল তাঁরা পাচ্ছেন না। কাজেই এটা আলাদা বিষয়।
গণশক্তি: আপনি বাংলার বুকে তৃণমূল এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে একসঙ্গে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। কিন্তু যদি একটু অন্য দৃষ্টিকোণগুলি দেখি, এরাজ্যের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মনে করতে পারেন বিজেপি’র হাত থেকে বাঁচতে তৃণমূলই একমাত্র পথ। অন্যদিকে তৃণমূলের অপশাসন থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি’কে পরিত্রাতা ভাবতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বামপন্থী আন্দোলনকে কীভাবে তীব্র করা যায়?
কারাত: বাংলায় বাম আন্দোলন শক্তিশালী হতে পারে কেবল তৃণমূল এবং বিজেপি উভয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেই। কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারেরই অগণতান্ত্রিক কাজগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে একটা রাজনৈতিক মেরুকরণ করা হয়েছে বলেই আপনি ঐ দৃষ্টিকোণগুলির কথা বলছেন যা প্রচার করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তি হিসাবে আমরা বলতে পারি না যে তৃণমূল মূল শত্রু, তাই বিজেপি’র প্রতি নরম হতে হবে, অথবা বিজেপি মূল শত্রু তাই তৃণমূলের প্রতি নরম হতে হবে। দুটোই বাংলার মানুষের, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থবিরোধী হবে। তৃণমূল এরাজ্যে বামপন্থীদের ওপরে, সিপিআই(এম)’র ওপরে নৃশংসতম আক্রমণ চালিয়েছে, কাজেই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই না করে রাজ্যের মানুষের স্বার্থরক্ষা করা সম্ভব নয়, বাম আন্দোলনকেও জোরদার করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে বিজেপি আরও বড় বিপদ, ত্রিপুরায় তারা একইভাবে নৃশংস আক্রমণ নামিয়েছে বামপন্থীদের ওপরে। হিংসাত্মক আক্রমণে, সন্ত্রাসে বিজেপি’র সঙ্গে তৃণমূলের কোনও ফারাক নেই। তাই এদের কোনও পক্ষের সঙ্গে কোনোরকম সমঝোতা না করে উভয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে বাংলায়।
গণশক্তি: সম্প্রতি রাজ্যের উত্তরাংশকে ভাগ করার একটি চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আপনি কি মনে করেন রাজ্যভাগের ফলে উত্তরাংশের মানুষের সমস্যার কোনও সুরাহা হতে পারে?
কারাত: বহু রাজ্যেই বহু ভাষার এবং জাতিগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছেন। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো, তাদের সংস্কৃতি রক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দার্জিলিঙের বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবির মোকাবিলায় হিল কাউন্সিল গঠন করে বামফ্রন্ট সরকার সেই পদক্ষেপই নিয়েছিল, ত্রিপুরাতেও তাই করেছে বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু বিজেপি ভাষাভিত্তিক রাজ্য মানে না। তারা ছোটো ছোটো রাজ্যের কথা বলে প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলে। এখন তারা ভাবছে উত্তরবঙ্গে তারা নতুন রাজ্য গঠন করে ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু এটা বাংলার পক্ষে খারাপ হবে, বাংলার যে বৈশিষ্ট্য তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উত্তরবঙ্গের মানুষের কোনও সমস্যার সমাধানও হবে না। ওখানকার পশ্চাৎপদতার পিছনে রাজ্যের বৃহৎ আকৃতি কারণ নয়, এর পিছনে ঐতিহাসিক নানা কারণ আছে। তবে সেখানকার মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের দরকার আছে, সেটা কীভাবে করতে হবে তা আগেই বামফ্রন্ট সরকার দেখিয়েছে। একবার ভাঙা শুরু হলে নানা জনজাতি আরও ভাঙার দাবি তুলবে, সমস্যা এভাবে মিটবে না।
গণশক্তি: পরের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালেই লোকসভা নির্বাচন। বিজেপি’কে পরাস্ত করার জন্য বামপন্থীরা কীভাবে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নিচ্ছেন?
কারাত: অনেকেই জানতে চায় বিজেপি’কে পরাস্ত করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে সব বিরোধীদের ঐক্য হবে কিনা। আজকের ভারতে বিজেপি যেহেতু সবচেয়ে শক্তিশালী তাই এমন চাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। একটা দলের গরিষ্ঠতায় সরকারে অবস্থান যা আগে একসময়ে কংগ্রেসের ছিল, তা এখন বিজেপি’র বাস্তবতা। সবাই মিলে বিজেপি’র বিরুদ্ধে মুখোমুখি এক প্রার্থী দিয়ে বিজেপি’কে হারানো একটা দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু রাজনীতি এমন সহজ পাটিগণিতে চলে না। অতীতের শক্তিশালী কংগ্রেসকে পরাস্ত করার ঘটনাতেও সার্বিক বিরোধী ঐক্য গড়ে ঘটেনি, তবে বিরোধীদের আন্দোলন একটা গতি পেয়েছিল কারণ মানুষ তখন সেটাই চাইছিল। জরুরি অবস্থার পরে কেউ কেউ ঐক্যের চেষ্টা করলেও বিরোধীদের সার্বিক ঐক্য ছিল না, উত্তর ভারতের মানুষ দেখেছিল জনতা পার্টিকে দিয়ে কংগ্রেসকে হারানো সম্ভব, তারা জনতা পার্টিকে ভোট দিয়েছিল। আজকের সমস্যা হলো, এখনও পর্যন্ত সেই ধরনের বড় গণআন্দোলন তৈরি হয়নি। বড় কৃষক আন্দোলন ঘটেছে, কিন্তু সেটাও মূলত তিনটি রাজ্যের গণআন্দোলন। ২০২৩ সালে আমাদের সেই ইস্যুগুলি বেছে নিয়ে তেমন বড় ধরনের গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে যার মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ ঐক্য গড়ে উঠবে। গণআন্দোলনই বিরোধী দলগুলির ঐক্যর ভিত্তি গড়ে দেবে। এটা ছাড়া জাতীয় পর্যায়ে বিরোধী দলগুলির কোনও আনুষ্ঠানিক ঐক্য সম্ভব নয়। বরং তেমন চেষ্টা ক্ষতিকর হয়ে যাবে। কারণ যদি কংগ্রেস সব দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানায় তাহলে কেবল অর্ধেক বিরোধী দল তাতে সাড়া দেবে, বাকি অর্ধেক সাড়া দেবে না। জনগণের অনেক ইস্যু রয়েছে সেগুলি নিয়ে সংসদের ভিতরে বাইরে বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের চাপ তৈরি করা সম্ভব। অন্যরা কেবল নির্বাচনের আগে কৌশলে আগ্রহ দেখায়, কিন্তু জনগণের কোনও ইস্যুতে একসঙ্গে লড়াই করতে হবে তা নির্ধারণে ও নেতৃত্বদানে বামপন্থীদের ভূমিকা পালন করার আছে। আমরা বামপন্থীরা এই মনোভাব নিয়েই ২০২৩ সালে এগবো এবং ২০২৪ সালে রাজ্যভিত্তিক পরিস্থিতি অনুসারে বিজেপি বিরোধী সর্বোচ্চ ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করবো। কোনও রাজ্যে কোনও আঞ্চলিক দল হয়তো বিজেপি বিরোধী মূল শক্তি, তাকে বাদ দিয়ে বিরোধী ঐক্য অর্থহীন। এসব বিবেচনা করে বিহারে, তামিলনাডুতে যেভাবে বিজেপি বিরোধী ঐক্য গড়া সম্ভব হয়েছে, সেভাবেই আমরা প্রচেষ্টা চালাবো বিজেপি’কে পরাস্ত করতে।
Prakash Karat interview with ganashakti
গণআন্দোলনেই বিজেপি-বিরোধী ঐক্যের ভিত্তি তৈরি হতে পারে, সাক্ষাৎকারে প্রকাশ কারাত
×
Comments :0