রামশঙ্কর চক্রবর্তী : বালেশ্বর
খড়্গপুরে রডের কারখানায় কর্মী ছাঁটাই হয়েছে সম্প্রতি। ছাঁটাই শ্রমিকের দলে ছিলেন পিংলার বাসিন্দা বছর তিরিশের তাপস সিং। বাহানাগায় দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের অন্যতম যাত্রী এই আদিবাসী যুবক জখম অবস্থায় এখন বালেশ্বর হাসপাতালে।
রবিবার তাপসের দিদির সঙ্গে দেখা বালেশ্বর হাসপাতালে। খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন তিনি। বললেন, ‘‘কাজ চলে যাওয়ার পর বাইরে চলে যাবে ঠিক করেছিল ভাই। রডের কাজ জানে। চেন্নাইয়ে সেই কাজই পেয়েছিল। সেখানে যাচ্ছিল। কাজ হলো না। আদৌ আর হবে কিনা, ঠিক নেই। বেঁচে গেছে সেটাই অনেক।’’
যাঁরা মারা গিয়েছেন দুর্ঘটনায়, তাঁদের নিজেদের যন্ত্রণার অবসান হয়েছে। অসহায় হয়ে পড়েছে পরিবার। আর যাঁরা কাজের খোঁজে যাচ্ছিলেন, তাঁদের যন্ত্রণা আরও বাড়ল। লড়াই বাড়ল পরিবারের। তাপসের দিদি’র কথায় সেই সত্যেরই অনুরণন।
বাহানাগায় নিহত এবং আহতদের বেশিরভাগ পরিযায়ী শ্রমিক। তাঁদের একাংশ পশ্চিমবঙ্গের বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার শ্রমিক। অনেকে কারখানা থেকে কাজ হারানো শ্রমজীবী। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলি মূলত গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা।
এরাজ্যের গ্রামের হাহাকারের আয়না বালেশ্বরের হাসপাতাল।
করমণ্ডল এবং যশবন্তপুর দুটি ট্রেনেরই অসংরক্ষিত কামরাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আর এই কামরাগুলিতে প্রায় ৯০ শতাংশ যাত্রীই ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের, যাঁদের সবাই পরিযায়ী শ্রমিক। ওডিশা প্রশাসন ও রেলের সূত্রও বলছে ইতিমধ্যেই যাঁদের মৃত্যু হয়েছে তাঁরা বেশিরভাগই পরিযায়ী শ্রমিক।
দুর্ঘটনার একদিন পরে বালেশ্বর, কটকের হাসপাতালে অনেক টুকরো চিত্র চোখে পড়ল। কেউ নিখোঁজ পরিজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন, অনেকে আবার হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিজের লোকজনের আসার প্রহর গুনছেন। বালেশ্বর জেলা হাসপাতালে দুর্ঘটনায় চিকিৎসাধীনরা প্রায় প্রত্যেকেই পরিযায়ী শ্রমিক। পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার এই দুটি রাজ্যের বাসিন্দা তাঁরা।
হাসপাতালের যে ক’টি ওয়ার্ডে দুর্ঘটনাগ্রস্তরা রয়েছেন, তার সবকটিতেই খোঁজ নিয়ে জানা গেল ৫০ জনের মতো বিহারের, বাকি সবাই পশ্চিমবঙ্গের। এই বিরাট সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক চেন্নাই, কেরালা, বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন প্রান্তে রাজমিস্ত্রি, রেস্তোরাঁ বা বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত।
এরাজ্যে কাজের আকাল যে কেমন, তা প্রমাণ করে দিল বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনা।
বালেশ্বরের হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে দু’জন হিন্দিতে কথাবার্তা বলছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, ‘‘বঙালকা লোক হ্যায় সব, বাহারমে কাম করতা থা। লেকিন ইতনে সারে?’’ তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা খড়্গপুর থেকে এসেছেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের একজন আহতকে নিয়ে যেতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এসেছেন।
শুক্রবার সন্ধে ৭টা নাগাদ ওডিশার বালেশ্বরের বাহানগায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে শালিমার-চেন্নাই করমণ্ডল এক্সপ্রেস ও হাওড়া যশবন্তপুর। দুটি ট্রেনের অসংরক্ষিত কামরায় প্রচুর ভিড় ছিল। হাওড়াগামী যশবন্তপুরে যেমন পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফিরছিলেন তেমনই চেন্নাইগামী করমণ্ডলে প্রচুর শ্রমিক ভিনরাজ্যে কাজে যাচ্ছিলেন।
করমণ্ডলের অসংরক্ষিত কামরায় থাকা বীরভূমের নোয়াডাঙা গ্রামের ধনঞ্জয় কোড়া বলেন, ‘‘হাওড়া থেকেই ট্রেনে প্রচুর ভিড় হয়েছিল। একেবারে ঠাসাঠাসি লোক ছিল। আমাদের ট্রেনে যখন দুর্ঘটনা হলো, হঠাৎই প্রবল ঝাঁকুনি। আমি জ্ঞান ফিরে শুধু গোঙানির আওয়াজ শুনতে পাই। আর সবই পুরো অন্ধকার ছিল।’’
উচ্চমাধ্যমিক পাশ ধনঞ্জয় কোড়া চেন্নাই যাচ্ছিলেন রাজমিস্ত্রির কাজে। বাড়িতে বাবা, মা, দাদা, দিদি আছেন। দাদা ভ্যানরিকশা চালান। চেন্নাইতে কাজ করে রোজ ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মেলে ধনঞ্জয়ের। ওভারটাইম করলে জোটে আরও ৩০০। দুর্ঘটনায় বুকের পাঁজরে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন ধনঞ্জয়।
দুর্ঘটনায় ব্যাগ, মোবাইল সবই খোয়া গেছে বিহারের বাসিন্দা সূরজ কুমারের। মাথায় গুরুতর আঘাত তাঁর। এখনও পরিবারের কেউ আসেনি, কারও খোঁজ পাচ্ছেন না তিনি। হাওড়াগামী ট্রেনের যাত্রী সূরজ জানান, ‘‘কবে বাড়ি ফিরব জানি না। কাজ করে যে টাকা পেয়েছিলাম তা আমার ব্যাগে ছিল। ব্যাগ তো হারিয়ে গেছে।’’
গুরুতর আহত মন্দারমনির প্রতাপ সিংহ বলেন, ‘‘আমি অসংরক্ষিত কামরায় ছিলাম। বেঙ্গালুরু থেকে ফিরছিলাম। সেখানে একটা কারখানায় কাজ করি। যখন দুর্ঘটনা ঘটল আমি শুয়েছিলাম। ভিড়ও ছিল খুব। আমাদের কামরার অনেকেই মারা গেছেন মনে হয়।’’
হাসপাতালের বাইরে রবিবারও বহু মানুষের ভিড়। আহতদের পরিজন তাঁরা। বলা ভালো পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ির লোকেদের ভিড়। আবার কিছু মানুষ ভিড় করেছেন নিখোঁজ পরিজনদের খোঁজে। এদিন বালেশ্বর জেলা হাসপাতালের মর্গে দুর্ঘটনায় মৃতদের দেহগুলি বাহানগার হাইস্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিখোঁজ পরিজনদের সেখানেই যেতে বলছে।
জানা গিয়েছে, করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের ৫৪৪ জন আহত হয়েছেন। বালেশ্বরের হাসপাতালে ৪০০’র বেশি হতাহত ছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগ পশ্চিমবঙ্গের। তেমনি কটকে রয়েছেন ১৫০ জনের বেশি। ভূবনেশ্বর এইমসে ভর্তি প্রায় ১৩৩ জনও শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেরই।
Comments :0