শাসকের সন্ত্রাস উপেক্ষা করে ২০২৩ পঞ্চায়েত নির্বাচনে গবারৃর চেয়ে অনেক বেশি আসনে প্রার্থী দিয়েছেন বামপন্থীরা। পঞ্চায়েতের তিন স্তর মিলিয়ে ৫৩ হাজারের বেশি প্রার্থী দিয়েছে সিপিআই(এম) সহ বামফ্রন্টের বাকি শরিক দলগুলি। কংগ্রেস এবং আইএসএফ প্রার্থীদের ধরলে সংখ্যাটা গিয়ে পৌঁছবে ৭৩,৭৫০-এ।
বিজেপি এবং তৃণমূলের ঘোষিত বিরোধীদের সংখ্যা আরও বাড়ত। বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ বলেচেন প্রায় ৫০টি ব্লকে বিরোধীদের প্রার্থী জমা দিতে দেওয়া হয়নি। মনোনয়নের পর প্রচারপর্বে সামনের সারিতে বামপন্থীরা। এলাকায় এলাকায় চলছে দেওয়াল লেখা, হুমকি উড়িয়ে। চলছে মিছিল, নির্বাচনী জনসভা। অংশ নিচ্ছেন গ্রামের খেটে খাওয়া জনতা।
প্রচারে তৈরি হয়েছে পোস্টার। দেওয়ালে সাঁটার পাশাপাশি মোবাইলে বা কম্পিউটারে ছড়িয়ে যাচ্ছে বক্তব্য। কৃষিতে রাজ্যের সঙ্কট, কাজের মারাত্মক সমস্যা। আর রয়েছে অবারিত লুটের মাথাদের হটানোর ডাক। ‘চোর তাড়াও গ্রাম জাগাও’ স্লোগানে রেগা থেকে আবাস দুর্নীতির বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে ঝড় তুলেছিল সিপিআই(এম)’র মিছিল। সাহস জুগিয়েছে মুখ খোলার।
পোস্টারে রয়েছে আগামীর ঘোষণাও। বামপন্থীরা জয়ী হলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় কোন লক্ষ্য নেওয়া হবে, জানানো হচ্ছে প্রচারে।
মনোনয়নের পরে শুরু হওয়া কর্মকাণ্ডের দু’টি স্তর। প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে নেমেছে তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনী। প্রতিরোধের মুখেও পড়ছে। বোলপুর, চন্দ্রকোণার মতো রাজ্যের নানা জায়গায়।
এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামপন্থীদের প্রচারের অভিমুখ মূলত দ্বিমুখী। একদিকে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে তৃণমূলের লুঠের যাবতীয় হিসেব নিকেশ। সেই প্রচার ইতিমধ্যেই সাধারণ মানুষের মনে ধরেছে। তামাম গ্রাম বাংলায় এই মুহূর্তে চোরের সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে ‘তৃণমূল’ শব্দটি।
কিন্তু শুধুমাত্র ‘নেগেটিভ’ প্রচারকে হাতিয়ার করেই নির্বাচনী ময়দানে পা রাখতে রাজি নয় সিপিআই(এম)। তৃণমূলী অপশাসনের পাশাপাশি নিজেদের বিকল্প ভাবনাগুলিও সামনে আনছে সিপিআই(এম)।
ইতিমধ্যেই সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির ফেসবুক পেজ থেকে প্রকাশিত হয়েছে একগুচ্ছ ডিজিটাল পোস্টার। সেই পোস্টারগুলিতে স্পষ্ট ভাবে বর্ণিত রয়েছে, ঠিক কোন বিষয়গুলিকে পঞ্চায়েতের প্রচারে তুলে আনতে চলেছে সিপিআই(এম)।
নির্বাচনী প্রচারের মূল স্লোগান তোলা হয়েছে, ‘‘ তৃণমূল বিজেপি দূর করো, লুঠতরাজ বন্ধ করো। বাম পথে গ্রাম। মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে তলো।’’ একইসঙ্গে দেওয়া হয়েছে দিকে দিকে বামপন্থী প্রার্থীদের জয়ী করার আহ্বান। জ্যোতি বসুর বিখ্যাত উক্তিকে আরও একবার স্মরণ করিয়ে বার্তা দেওয়া হয়েছে, বামপন্থীরা শক্তিশালী হলে, রাইটার্স থেকে নয়, সরকার চলবে গ্রাম থেকে।
এর পাশাপাশি প্রচারে তুলে ধরা হচ্ছে কৃষি এবং কৃষকের সঙ্কট এবং গ্রামে কর্মসংস্থানের হাহাকারকে।
পোস্টার সেটে প্রশ্ন করা হচ্ছে, কেমন আছে গ্রাম বাংলা? দেওয়া হয়েছে রাজ্যের কৃষিকাজের খতিয়ান। সরকারি রিপোর্ট এবং সিপিআই(এম)’র করা সমীক্ষার রিপোর্ট তুলে ধরা বলা হচ্ছে, ৩৮ শতাংশ কৃষক বলছেন বর্তমানে চাষ অলাভজনক।
ফসলের দাম পাওয়া যায়? এই প্রশ্নের উত্তরে মাত্র ৩১ শতাংশ বলছেন ঠিক দাম পাওয়া যায়। ২৮ শতাংশ বলছেন, ঠিক দাম পাওয়া যাচ্ছে না, এরজন্য রাজ্য সরকার দায়ী। ২১ শতাংশ বলছে ঠিক দাম পাওয়া না গেলেও কারণ অজানা। ২০ শতাংশ বলছেন দাম না পাওয়ার জন্য ফড়েরা দায়ী। অর্থাৎ ৬৯ শতাংশ বলছেন ফসলের সঠিক দাম মিলছে না।
এই তথ্য সামনে রেখে স্লোগান তোলা হয়েছে, ‘‘ কৃষক বিরোধী তৃণমূল-বিজেপি দূর করুন। লাভজনক কৃষি ব্যবস্থা এবং কৃষকের অধিকার।’’
এর পাশাপাশি তথ্য দিয়ে পোস্টারে তুলে ধরা হয়েছে, কৃষি কাজের খতিয়ান। পোস্টার অনুযায়ী, ২০২১-এ গ্রামাঞ্চলে ধান বিক্রি হয়েছে ১৪০০-১২০০ টাকা/ কুইন্টাল। অথচ সরকারি ভাবে কুইন্টাল প্রতি দাম ধার্য ছিল ১৯৪০ টাকা। অর্থাৎ কৃষকরা পেয়েছেন ধার্য দামের মাত্র ৫৭-৭৭ শতাংশ।
অপর একটি পোস্টারে বলা হয়েছে, বামপন্থীদের অঙ্গীকার, সমবায় সমিতির পুনরুজ্জীবন। চাষীদের দাদন, বিমা, ন্যায্যমূল্যের সার ও কৃষি উপকরণ পাওয়া নিশ্চিত করবে বামপন্থী পঞ্চায়েতগুলি। নাবার্ডের সাহায্যে গ্রামে গ্রামে খামার পাঠশালার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। নিশ্চিত করা হবে ফসলের সহায়ক মূল্য।
একইসঙ্গে বলা হয়েছে, বামপন্থীরা পঞ্চায়েতের দায়িত্ব পেলে বামফ্রন্টের ভূমি সংস্কারের গৌরবময় কাজের পরিধি আরও বিস্তার করা হবে। একইসঙ্গে বনভূমিতে আদিবাসীদের অধিকারও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে।
মমতা ব্যানার্জি বহুবার বলেছেন, তাঁর সময়কালে রাজ্যের কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দাবিকে খণ্ডন করে রাজ্য সিপিআই(এম)’র তরফে ডিজিটাল পোস্টারের মাধ্যমে প্রচার চালানো হচ্ছে, কৃষকের গড় আয়ে পশ্চিমবাংলার স্থান ২৮টি রাজ্যের মধ্যে ২৬তম। পাঞ্জাবে কৃষকের গড় আয় ২৬,৭০১ টাকা, হরিয়ানায় ২২,৮৪১ টাকা এবং কেরালায় সেটা ১৭,৯১৫ টাকা। অপরদিকে পশ্চিমবাংলায় কৃষকের মাসিক আয়ের গড় মাত্র ৬৭৬২টাকা।
ডিজিটাল পোস্টারে তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, কৃষকের মাসিক আয়ের জাতীয় গড় ১০,২১৮ টাকা । সেই হিসেব মাথায় রাখলে, পশ্চিমবাংলার কৃষকের গড় আয় জাতীয় গড় আয়ের মাত্র ৬৬শতাংশ।
কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে পশ্চিম বাংলার কৃষকের গড় আয় ছিল জাতীয় গড় আয়ের ৯৮ শতাংশ। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে গড় আয়ের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ছিল সপ্তম স্থানে।
এর পাশাপাশি প্রচার চালানো হচ্ছে, পঞ্চায়েতে গরিব মানুষের টাকা লুঠ আটকাতে নিয়মিত অডিট রিপোর্ট পেশ করতে হবে বিধানসভায়। জেলা পরিষদ থেকে গ্রামসভা- সমস্ত স্তরে স্পষ্ট আর্থিক হিসেবনিকেশ বাধ্যতামূলক করা হবে বামফ্রন্টের সময়কালের মতো।
এর পাশাপাশি পরিকল্পনা সমিতিতে ইউনাইটেড ফান্ড গঠন করা হবে। পঞ্চায়েতের প্রকল্পগুলির উপভোক্তাদের জন্য উপভোক্তা কমিটি গঠনের কথাও বলা হচ্ছে বামপন্থীদের প্রচারে। দাবি উঠেছে সহায়তা প্রাপকদের নিয়মিত তালিকা তৈরি করতে হবে। একইসঙ্গে গঠন করা হবে গ্রাম পরিকল্পনা সমিতি। সেই স্থায়ী সমিতিতে স্থান পাবে বিরোধী দলের প্রতিনিধি।
Comments :0