ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেড়েই চলেছে। আক্রান্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রাণহানির পরিসংখ্যান। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে আবার ২ জনের মৃত্যু হলো ডেঙ্গুতে। তার মধ্যে একজন ১৪ বছরের বালিকা। বৃহস্পতিবার কলকাতার ১০৫ নম্বর ওয়ার্ডে যখন ওই বালিকার মৃত্যুতে হাহাকার চলছে পরিবারে, তখন মেয়র তাঁর পারিষদদের নিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে উৎসবের মেজাজে ডেঙ্গু সচেতনতার প্রচারে বেরিয়েছেন ঠিক তার পাশের ১০৬ নম্বর ওয়ার্ডে। প্রশাসনের সমস্ত কিছু হাতে থাকা সত্ত্বেও পৌরসভা কি শুধু প্রচারই করবে? তাহলে ডেঙ্গু মোকাবিলায় কাজ কখন করবে— প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ মানুষ। এদিনই ডেঙ্গু সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে সরাসরি রাস্তায় নেমে শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশনের প্রাক্তন মেয়র অশোক ভট্টাচার্য সাধারণ মানুষের এই প্রশ্নের উল্লেখ করে বলেন, যে কোনও ক্ষেত্রেই কর্পোরেশনের ব্যর্থতার দায় মেয়রকেই নিতে হবে।
ডেঙ্গুতে মৃত্যু হলো অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ভার্গবী মণ্ডলের (১৪)। জানা গিয়েছে, কলকাতা পৌরসভার ১০৫ নম্বর ওয়ার্ডে হালতুর যাদবগড়ের বাসিন্দা ভার্গবী গত বৃহস্পতিবার থেকেই জ্বরে আক্রান্ত হয়। এলাকার মানুষের কথায়, ওই দিন টিউশন করে বাড়িতে ফেরার পর থেকেই প্রবল মাথার যন্ত্রণা হয় তার। এরপরেই প্রবল জ্বর আসে। তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি ডেঙ্গু বলে সন্দেহ করেন। শনিবার থেকে বালিকার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি শুরু হয়। ডেঙ্গু ধরা পড়ে তার। রবিবার রাতে এমআর বাঙ্গুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও পরিবারের অভিযোগ, সেখানে বেডের তীব্র অভাব চলছে বলে জানানো হয়। ফলে তখনকার মতো বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় ভার্গবীকে। শেষ পর্যন্ত সোমবার সকালে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। ততক্ষণে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হতে শুরু করেছে। প্লেটলেট নেমে যায়। বুধবার সকালে মৃত্যু হয় ভার্গবীর।
কলকাতা পৌরসভার ১০৫ নম্বর ওয়ার্ডে যখন বালিকার মৃত্যুতে পরিবারে হাহাকার চলছে তখন পাশেই ১০৬ নম্বর ওয়ার্ডে হালতুতে ডেঙ্গু সচেতনতা প্রচারে বেরোলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তাঁর সঙ্গে ব্যান্ড পার্টির বিশাল বাহিনী। উপরন্তু বিস্ময়করভাবে এই প্রচারে জোরো জোরে বলা হলো, তেল ছড়াতে বলে পৌরকর্মীদের বিরক্ত করবেন না। কিন্তু এলাকার মানুষ পৌরকর্মীদের কী কী বিষয় জানাবেন, পৌর কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাবেন কিনা বা মশা নিয়ন্ত্রণে ঠিক কী কাজ করবেন— সেই বিষয় একটি কথাও জানানো হলো না মেয়রের প্রচারে। বরং প্রচারে বলা হলো তেল ছড়ালে পরিবেশের ক্ষতি এবং তার সঙ্গে অর্থেরও অপচয়। ডেঙ্গু মোকাবিলায় যেহেতু কোনও টিকা বা ওষুধ নেই তাই মানুষকেই সচেতন হতে হবে। তাঁদেরকেই নজর রাখতে হবে যাতে বাড়ির পাশে জল না জমে।
উল্লেখ্য, গত সেপ্টেম্বর মাসে এই ওয়ার্ডে মৌমিতা মুখার্জি এবং অনুরাগ মালকারের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। তাছাড়া প্রতিদিন এই ওয়ার্ডে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। পূর্বাচলে এবং খালপাড়ের বহু বাড়িতে রয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। এলাকার মানুষ যখন বার বার শাসক দলের কাউন্সিলরের কাছে আবেদন করেছেন ডেঙ্গু মোকাবিলা করার জন্য, তখন কাউন্সিলর ব্যস্ত ছিলেন নিজের পুজো নিয়ে। শুধু সেই সময় নয়, অভিযোগ, গোটা বছর জুড়ে কোনও সময়ের জন্য ওয়ার্ড ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো বা মশা মারার তেল দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করা হয়নি পৌরসভার পক্ষ থেকে। কিন্তু এদিন মেয়র আসছেন বলে বুধবার রাত থেকে শুরু হয় রাস্তায় ব্লিচিং পাউডার ছড়ানোর কাজ। যা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন এলাকার সাধারণ মানুষ।
ওদিকে আবারও ডেঙ্গুতে মৃত্যু হুগলীর উত্তরপাড়ার এক বাসিন্দার। এর আগে উত্তরপাড়ায় ৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবার মৃত্যু হলো এক ব্যক্তির। উত্তরপাড়া পৌরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভদ্রকালীর বাসিন্দা স্বপন ঘোষ (৫৩) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। জ্বর না কমায় গত ৪ নভেম্বর উত্তরপাড়ার একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সেখান থেকে ৭ নভেম্বর কলকাতার সিএমআরআই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আইসিইউ থেকে ভেন্টিলেশনে চলে যান ওই ব্যক্তি। বুধবার রাতে তাঁর মৃত্যু হয়।
এলাকায় অভিযোগ, জঞ্জাল পরিষ্কার করাই যেখানে পৌরসভার কাজ, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই ময়লা পরিষ্কারের নামে টাকা দাবি করছে পৌরসভা। যে সব ফ্ল্যাট থেকে টাকা তোলা যাচ্ছে না, সেখানে ময়লা পরিষ্কার বন্ধ করে দিয়েছে। প্রশ্ন, নাগরিকরা যখন কর দেন তখন কেন পৌরসভা আলাদা করে টাকা তুলছে? সৌন্দর্যের নামে নর্দমা বন্ধ করে সরু পাইপ বসানোর হয়েছে— যেখানে ময়লা আর জল জমে থাকছে। পরিষ্কারের কোনও উদ্যোগ নেই। এক্ষেত্রে সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তাকে স্বাগত জানাচ্ছেন মানুষ।
অন্যদিকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে শিলিগুড়িতেও। শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ, শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশন চালনা করছে তৃণমূল কংগ্রেস। প্রশাসন, পুলিশ সবই ওদের। ডেঙ্গুর ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন— শহরজুড়ে এই প্রশ্নের জবাব চাইলেন শিলিগুড়িবাসী। বৃহস্পতিবার ডেঙ্গু সচেতনতামূলক প্রচার কর্মসূচিতে সরাসরি রাস্তায় নেমে শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশনের প্রাক্তন মেয়র অশোক ভট্টাচার্য একথার উল্লেখ করে বলেন, কর্পোরেশনের এই ব্যর্থতার দায় মেয়রকেই নিতে হবে।
বিভিন্ন বেসরকারি সূত্রে রাজ্যে চলতি বছরে অন্তত ৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। আক্রান্তের সংখ্যা ৬৫ হাজার ছাড়িয়েছে বলে বিভিন্ন বেসরকারি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। ঘরে ঘরে জ্বর, ক্রমশ ভয়াল হচ্ছে ডেঙ্গু। এখন তা প্রাণঘাতী হতে শুরু করেছে শিশু, কিশোর কিশোরীদের ক্ষেত্রেও। হাত একরকম তুলে নিয়েছে দিশাহারা প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশনের ২২নম্বর ওয়ার্ড কমিটির উদ্যোগে ডেঙ্গু সচেতনতা প্রচার অভিযান চলে। এদিন সকালে অরবিন্দ পল্লি মেন রোড (সমর বিড়ি ফ্যাক্টরি মোড়)-র সামনে থেকে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার সহ পদযাত্রার মধ্য দিয়ে ২২ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিআই(এম) কাউন্সিলর দীপ্ত কর্মকার, শরদিন্দু চক্রবর্তী সহ এলাকার নাগরিকদের সাথে নিয়ে বিভিন্ন রাস্তায় পরিক্রমা করে ডেঙ্গু সচেতনতা প্রচার অভিযান চালান প্রাক্তন মেয়র। একই সঙ্গে ডেঙ্গু সচেতনতামূলক লিফলেট বিলি করা হয়।
এদিন ডেঙ্গু সচেতনতা প্রচার চলাকালীন অশোক ভট্টাচার্য বলেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় সমন্বয়, উদ্যোগ ও বর্তমান পৌর বোর্ডের সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যে কারণে শিলিগুড়িতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। এই সময়কালে শিলিগুড়ি শহরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় পাঁচ হাজার। মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ জন। ডেঙ্গু চিকিৎসা করাতে গিয়ে গরিব মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। পৌর কর্পোরেশনের মেয়র ও মেয়র পারিষদরা সাবধানতা না নিয়ে আমোদ প্রমোদের অনুষ্ঠানেই ব্যস্ত ছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে সঠিক কাজ করা হলে পরিস্থিতি এতটা জটিল হতো না। তাই আমরা আমাদের মতো করে ডেঙ্গু সচেতনতার প্রচার কর্মসুচি করে চলেছি।
Comments :0