JAGCHEY GRAM

কাজের আকাল, অর্ধাহারের ছায়া মুঙলি হেমব্রমদের জীবনে

রাজ্য

West Bengal Panchayat Election Left Front CPIM

গত পঞ্চায়েত ভোটে সিপিআই(এম)’র প্রার্থী হয়েছিলেন। সেই ‘অপরাধে’ বাড়ি থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তৃণমূলী বাহিনী। অপহরণ করার পরে বিডিও অফিসের পুলিশের ‘আতিথেয়তায়’ তাঁর মনোনয়ন প্রত্যাহার করানো হয়েছিল। শাসক তৃণমূলের কাছে এটাই ছিল ‘জয়’!

আর মুঙ্গলী হেমব্রমের কাছে? কাঁকসার জঙ্গলমহলের মুঙ্গলি হেমব্রম। গড়জঙ্গল থেকে শাল পাতা কুড়িয়ে ভাতের দাম জোগাড় করেন আজও। দিনে পাঁচশো পাতা, দুদিনে হাজার পাতা তোলেন। বিনিময়ে মেলে ৩০০ টাকা, তার থেকে বাদ যায় ৫০। মাসে আয়ের পরিমাণ সর্বোচ্চ হাজার চারেক।

‘ঐ যারা পাঁচ বছর আগে আমাকে অপহরণ করে মনোনয়ন তুলিয়েছিল তারা আজ বিজেপি তো কাল তৃণমূল। আমি কিন্তু একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। গ্রামের মানুষজনও চেনে আমাদের। গ্রামে ঘুরে দেখুন আদিবাসী মহল্লাগুলো কী চেহারা, দুবেলা খাবার জোটে না। যত টাকা সব তো ওদের (তৃণমূল) হাতে। গ্রামে পয়সা আছে যাদের সব দেখুন তৃণমূলের লোকজনই’।
জঙ্গলঘেরা কাঁকসার আদিবাসী জনপদে দাঁড়িয়ে গ্রামের নব্য-ধনীদের চরিত্র সামনে এনেই তখন এগচ্ছে গ্রামীণ পদযাত্রা।

মুঙ্গলি হেমব্রমরা জীবনের অভিজ্ঞতায় সাদা-কালো চেনেন, বোঝেনও। বনকাঠি পঞ্চায়েতের আঁধারশুলি গ্রামের এই জননী তখন বলছিলেন, ‘গ্রামে কোনও কাজই নেই, আদিবাসী গ্রামগুলোতে আরও বাজে অবস্থা, তৃণমূল তো চুরি করছে, বিজেপি কোথায়? আদিবাসী গ্রামে এই অবস্থার সময় দেখা যায় না ওদের। আমাদের গ্রামের প্রায় ৭০ জন ছেলে ভিন রাজ্যে, আমার স্বামী আর এক ছেলে ওডিশায় রাজমিস্ত্রির জোগানদারের কাজে। কিন্ত ওদের নেতাদের সব বড় বড় বাড়ি, গাড়ি’।

তখন সকাল প্রায় নটা। বনকাঠি লাগোয়া জঙ্গলঘেরা নোলাগাড়া গ্রাম। এটি মলানদিঘী পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ে। সকাল নটাতেই আদিবাসী পাড়ায় তখন সাজো সাজো রব। শুরু হবে গ্রামীণ পদযাত্রা। 
হাতে হাতে প্ল্যাকার্ড সাজানো হচ্ছে। ‘রেগায় কাজ দাও’, ‘রেগার বকেয়া মজুরি দাও’, ‘চোর ধরো, জেল ভরো’, ‘রেশন থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে কেন নাম’- গ্রামীণ জীবনের প্রতিদিনকার যন্ত্রণার দিনলিপি পদযাত্রার স্লোগানে পরিণত হয়েছে।

নোলাগড়ারই বাসিন্দা মুচিরাম বাউড়ি। ছিলেন একশো দিনের কাজের শ্রমিক, তারপর খেতমজুর, এখন এলাকায় দিনমজুরের কাজ। বদলে যাচ্ছে পেশা প্রতিদিন। ‘গত বছরের ২০ দিনের মজুরি এখনও বকেয়া, পাইনি। বারেবারে পঞ্চায়েতে যাই, ফিরিয়ে দেয়। খেতমজুরের কোনও কাজ নেই মাঠে, এবার তো চাষও সেভাবে হয়নি। সেচের ব্যবস্থাও নেই এখানে। দিনমজুরি করি, গ্রামে করলে ২০০টাকা,  দুর্গাপুরে বা বাইরে গেলে ২৫০টাকা, তাও মাসে দশদিনও জোটে না’। গ্রামীণ অর্থনীতির ভয়াবহ চেহারার সহজতম অনুবাদ তখন মুচিরাম বাউড়ের গলায়। তা-ও এদিন কাজে যাননি, হাঁটবেন বলে।

নোলাগাড়া হয়ে চুয়া, রক্ষিতপুর, হরিকি পেরিয়ে মলানদিঘী পৌঁছানো এই পদযাত্রায় হাঁটতে হাঁটতেই সন্ধ্যা মুর্মু বলছিলেন, কেউ তো আমরা রেগার বকেয়া পাইনি, দশ মাস হয়ে গেছে। লাল ঝান্ডা করি বলে পঞ্চায়েত থেকে কিছুই মেলে না। ওরা টাকা চুরি করল, আর আমরা রেগার টাকা পেলাম না। জানেন আদিবাসীপাড়া, বাগদি পাড়াগুলোতে কত ঘর একেবলায় খেয়ে কাটাচ্ছে!

ক্রমে অর্ধাহারে থাকা পরিবারের সংখ্যাও বাড়ছে তল্লাটে। উদ্বেগজনক ছবি ধরা পড়ছে গ্রামীণ পদযাত্রাতেই।

 মলানদিঘী পঞ্চায়েতের বাসিন্দা বীরেন হাঁসদা, চন্দ্র হেমব্রমের কথায়, গত বছরের প্রায় ১৮ থেকে ২০দিনের মজুরি বকেয়া। পঞ্চায়েতে তো এখন পয়সাওয়ালা লোকেদের জায়গা। আমার গিয়ে বললও দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। কে থাকবে গ্রামে? আমাদের গ্রাম থেকে ৬০জন ছেলে এখন সব চেন্নাই, গুজরাটে, ঝাড়খণ্ডে। গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে যাচ্ছে।

তৃণমূলের চুরি, দুর্নীতির জেরেই এই অচলাবস্থা। শিকার হচ্ছেন গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষ- পদযাত্রা সেই সঙ্কটের কথাই সোচ্চারে অনুবাদ করছে।

চন্দ্র হেমব্রমের মতো আদিবাসী যুবকের কথায়, ‘ঐ তো জঙ্গলে গিয়ে পাতা কুড়োতে হয়, তাতেই সংসার চালাতে হয়। রেশন থেকে এক মাস দুমাস অন্তর নাম বাদ চলে যায়। হাতের ছাপ মেলে না বলেন, গতরে খাটলে হাতের গড়ন তো বদলে যায়। কে বোঝাবে?’।

কাজ, কাজ, কাজ। কাজের দাবি, কাজ না পাওয়ার যন্ত্রণা, মজুরি না মেলার ক্ষোভ আর কাদের জন্য কাজ মিলছে না- সবের উত্তর হয়েই এগচ্ছে শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর সংগঠনের ডাকা মিছিল। 
গ্রামের সঙ্কটের গল্প বলতে বলতেই এগচ্ছে লাল ঝান্ডার পদযাত্রা।

মলানদিঘী বলছে রেশনে গরিব মানুষের হাতে ছাপ মিলছে না বলে নাম বাদ যাচ্ছে, হরিকি বলছে তৃণমূলের চুরির জন্য তো রেগার টাকা মিলছে না, রেগা শুরু করুন না হলে অনাহারের বাড়বে প্রত্যন্ত জনপদে। 
নোলাগাড়া জানাচ্ছে কাজের আকালেও বর্গা উচ্ছেদ করছে তৃণমূলী বাহিনী।

আবার চুয়া জানাচ্ছে গ্রাম উজাড় করে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিন রাজ্যের গ্রামের জোয়ান ছেলেপুলেরা। গ্রামে টাকা কামাচ্ছে কেবল তৃণমূলী মাতব্বররাই। ‘উন্নয়ন’ হয়েছে  মলানদিঘী পঞ্চায়েতের প্রধান পীযূষ মুখার্জি আগে যজমানি করে সংসার চালাতো এখন দুটি ফ্ল্যাট আঁড়াতে, গ্রামের বাড়িটি তিনতলা চোহারা নিয়েছে।
পালটা প্রতিরোধের কাহিনীও শোনাচ্ছে পদযাত্রা। 
কাঁকসার ত্রিলোকচন্দ্রপুরে সরকারি খাস জমি দখল করেছিল তৃণমূলীরা, গ্রামের মহিলারা জড়ো হয়ে পালটা প্রতিরোধ করে, জনরোষের মুখে আক্রান্ত হয় তৃণমূলী বাহিনী। খাস জমি তারপর গ্রামবাসীরা উদ্ধার করে বাঁশের বেড়া দিয়ে, এদিনই সেখানে গাঁছ পুঁতেছে।

দশ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পদযাত্রায় শামিল হওয়া কৃষক নেতা অলক ভট্টাচার্য, শ্রমিক নেতা পঙ্কজ রায় সরকার একযোগেই বলছিলেন- ‘গ্রাম সংসদের সভা তো তৃণমূল তুলে দিয়েছে গত ১১ বছর, গ্রামের শেষতম পরিবারটির দাবি, যন্ত্রণার কথাই উঠে আসছে এই পদযাত্রায়, প্রতিটা দাবি জীবনের সঙ্গে জড়িত, গ্রামের অর্থনীতি খাদের মুখে দাঁড়িয়ে এই সরকারের বদান্যতায়’।

অজয় নদীর এপাড়ে দুপুরে সন্ত্রাসবিদ্ধ বিঁধবিহারের শিবপুরেও বৈঠকি সভাতেই উঠে এল যে গত এক দশকে গ্রাম সংসদের সভায় বলতে না পারা কথাই। পঙ্কজ রায় সরকার, মুর্শিদ আলির সামনে তখন গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন নামেই দুয়ারে সরকার, তৃণমূলের অনুমোদন না থাকলে মেলে না কিছুই। কয়েক বছর আগেই প্রয়াত পার্টি সংগঠক সদানন্দ বাগদির আশি বছর বয়সি বৃদ্ধা মা মায়া বাগদি হাজির হলেন দুপুরে এই বৈঠকি সভায়। মাটির বাড়ি, খড়ের চাল, সামান্য ত্রিপল চাইতে গেলেও পঞ্চায়েত দেয়নি। বিধবা ভাতা মিলছিল, গত দুবছরে তাও বন্ধ।

শিবপুরের বাসিন্দা অতরা বাগদি, মায়া বাগদির মতো প্রৌঢ়া বলছিলেন- এই যে লাল ঝান্ডার মিটিংয়ে আসি, তাই মেলে না কিছুই।

Comments :0

Login to leave a comment