Gangasagar special

অন্য সাগর: মফেয়ার স্কুল নেই, সুদের ধাক্কা রবিকে ঠেলেছে সমুদ্রে

ফিচার পাতা

মনোজ আচার্য

কচুবেড়িয়া কিংবা চেমাগুড়ি থেকে কপিল মুনি আশ্রম— দীর্ঘ পথের বাহারি সাজসজ্জা আপনার নজর কাড়তে পারে। এই আলোকোজ্জ্বল সাগরই আসল সাগর নয়। 
ভালো নেই সাগর দ্বীপের মানুষ। কলোনি পাড়ার রাবেয়া বেওয়া, ফিরোজ, বোম্বাট, গোপাল মণ্ডলদের ফুটিফাটা জীবনে আলো আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে অভাব। মাথায় আসবে হীরক রাজার সেই গল্প খানি। দেশ বিদেশ থেকে আসা অতিথিরা রকমারি আয়োজন দেখে  হীরক রাজার প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়েছিল। আড়ালে ছিল হাজার হাজার অভুক্ত প্রজার জীবনের করুন আর্তনাদ। সেটা ছিল গল্প। তবে,গল্পের সেই বাস্তবতা কে আপনি চাক্ষুস করতে পারবেন সাগর মেলার আলোকোজ্জ্বল চেহারা ও এখানের হত দরিদ্র মানুষের জীবন দেখে। 
পৌঁছে গিয়েছিলাম কলোনি পাড়ায়। সাগর মেলার জাঁকজমক থেকে খানিকটা দূরে কে ওয়ান বাসস্ট্যান্ডের পাশের রাস্তা ধরে এগলেই  কলোনি পাড়া। সেখানেই আলাপ রাবেয়া বেওয়ার সঙ্গে। স্বামী রিয়াজুল বছর তিনেক আগে মারা গিয়েছেন। দশ বছরের ছেলে ফিরোজ এবং মেয়ে মফেয়াকে নিয়ে তাঁর অভাবী টানাপোড়েনের সংসার। দু’বেলা দু’মুঠো জোগাড় করাটাই মুসকিলের সংসার ফিরোজ, মফেয়াকে স্কুল মুখো হতে দেয় না। ফিরোজ শ্রীধাম এলাকায় এক খাবার হোটেলে কাজ করে। মফেয়া মায়ের সঙ্গে ভিক্ষে করে। ধর্মীয় বিশ্বাসে অনেকেই সাগরে পয়সা ফেলে, রাবেয়া মফেয়া কাঠের শক্ত ডান্ডিতে সারি সারি চুম্বক লাগিয়ে দিনভর সাগর পাড়ের জলে ভিজে ভিজে সেগুলো সংগ্রহ করে। শুধু রাবেয়ারাই নয়,সাগর দ্বীপের বহু মানুষই মেলার সময় এই পেশা অবলম্বন করেন। 
কাজের আকাল। গত তিন বছর ধরে এই জীবিকা অবলম্বন করেই অনেকের মতো সংসার চালান রাবেয়ারা। রাবেয়া বেওয়া বিধবা ভাতার জন্য এই অফিস,সেই অফিস হন্যে হয়ে ঘুরেও তা এখনও পাননি। অভাব দারিদ্রের চাবুকের ঘা চেহারায় ফুটে ওঠে। খেজুর পাতার ছাউনি আর পলিথিনে মোড়া কুড়ে ঘর দারিদ্রের যন্ত্রণাকে আরও স্পষ্ট করে দেখায়। সাগরে পয়সা কুড়িয়ে সংসার চলে? জানতে চাইতেই রাবেয়া বেওয়া উত্তর দেয় মেলার সময় একটু বাড়তি রোজগার হয় তবে অন্য সময় হয় না। তবে চলে কি করে? ওই কোনও রকমে চলে। হতাশ গলাতেই কথাগুলো বলেন রাবেয়া। 


রাবেয়াদের বাড়ি ছেড়ে খানিকটা গেলেই শেখ সিরাজুলের বাড়ি। তিনি পেশায় কল মিস্ত্রি। তবে মুড়ি গঙ্গার এপাড়ের সাগরদ্বীপে সে জীবিকা অবলম্বন করে বছরভর খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটা দুস্কর। তাই বছরভর নানা কাজ করেন সিরাজুল। শীতের মরশুমে খেজুর রস কাটেন তিনি। তবে সেটা নিয়েও আক্ষেপ তাঁর — গ্রামের মানুষের অত টাকা পয়সা নাই। রস গুড় কেনার খদ্দের তেমন জোটে না। এই মেলার কদিন একটু বিক্রি ভালো হয় তবে মেলা গেলেই যে কে সেই। কচুবেড়িয়ায় মাল নিয়ে গেলে জেটিঘাটে কিছুই বিক্রি বাট্টা হয়। তবে যাতায়াতে প্রায় ৭০ টাকা খরচ। এতে পোষায় না। বলছিল সিরাজুল। 
সাগর পাড়ের জেলে বস্তি কী বলছে? সৈকতের ধারে চিকচিকে সাদা বালির ওপর সারি সারি হোগলার ঘর। আশপাশের গ্রাম ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিভিন্ন জায়গা থেকে জেলেরা তাদের পরিবার নিয়ে মাস ছয়েকের এই অস্থায়ী পাড়ায় আস্তানা গাড়েন। সাগরে মাছ ধরে, মাছ শুকোয় তা বিক্রি করে। দুর্গাপূজার পর সাগর পাড়ে সারি সারি হোগলার ঘরে জমজমাট হয়ে ওঠে জেলে বস্তি, মানুষের হাঁকডাক, হই হুল্লোড়ের এই জেলে বস্তিই শীতের শেষে শুনসান হয়ে পড়ে। বর্ষায় সবটাই গ্রাস করে নেয় সমুদ্র। সাগরে মাছ ধরে এখন লাভের মুখ দেখাটা দুষ্কর। জাল ভাড়া, বোট ভাড়া মিলিয়ে বিপুল খরচ সেই খরচ সামলে লাভের মুখ দেখা কঠিন। বলছিলেন হীরা মণ্ডল। কাকদ্বীপের বাসিন্দা হীরা মণ্ডল। বছর পঁচিশ ধরে মাস ছয়েকের অস্থায়ী এই জেলে বসতির পরিচিত বাসিন্দা। নিজের জাল ও নৌকা নেই। সুদে টাকা ধার করে জাল ও বোট ভাড়া নিয়ে মাছ ধরছেন। সুদে আসলে বাড়তে থাকা দেনার টাকা শোধ করার দুশ্চিন্তা নিয়েই সে হপ্তা খানেক চলে যান দূর সমুদ্রে। সঙ্গী মফিজুলকে দৈনিক রোজের টাকাও দিতে পারছেন না। মফিজুলের সঙ্গে এই নিয়ে বেশ বচসাও হয়। টাকা ছাড়া মফিজুল আর কাজ করবে না। মফিজুল রাগারাগি করে নামখানায় তাঁর বাড়িতে চলে গেছে। একা হীরা মণ্ডল এখন ছেলে রবি কে নিয়ে সমুদ্রে যান।
মেলা জুড়ে অনেক ভিখারি। তাঁদের সিংহভাগই সাগর দ্বীপের বাসিন্দা। শিল্পী গোপাল মণ্ডল, ফাইনুল শেখ, রবি মোদকদের ভিক্ষা বৃত্তির জীবন আলো ঝলমলে মেলার আড়ালে এক অন্ধকারের ধারাভাষ্য তুলে ধরবে। জাঁকজমকের মেলার বাইরের ছবি গুলিই আপনাকে জানান দেবে ভালো নেই সাগর দ্বীপ।
 

Comments :0

Login to leave a comment