NCRB Report

হিংসা, প্রাণহানির তথ্য চেপে এরাজ্য ‘সবচেয়ে নিরাপদ’!

রাজ্য কলকাতা

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)’র কাছে অপরাধের ভুয়ো তথ্য পাঠিয়ে পশ্চিমবঙ্গ এবং কলকাতাকে ‘নিরাপদ’ দেখানোর চেষ্টা করছে তৃণমূল সরকার। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে তো বটেই, এমনকি তথ্যের অধিকার আইনে পাওয়া সরকারি তথ্যেও যেখানে দেখা যাচ্ছে যে রাজ্যে রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক হিংসায় যথেচ্ছ প্রাণহানি ঘটছে, সেখানে এনসিআরবি রিপোর্টে রাজ্যের পাঠানো তথ্য বলছে, কলকাতা তো বটেই সারা রাজ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসায় এবং রাজনৈতিক হিংসায় কারুর মৃত্যু হয়নি!
এনসিআরবি রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভুয়ো তথ্য পাঠানো অবশ্য নতুন কোনও ঘটনা নয়। গত কয়েক বছর ধরেই বিষয়টি নির্লজ্জতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এনসিআরবি’র ২০২২ সালের রিপোর্ট কয়েকদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে। তাতে অপরাধের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ এবং কলকাতার নামের পাশে বহু ক্ষেত্রে শূন্য অথবা খুবই সামান্য কিছু সংখ্যা বসানো রয়েছে। আর তা দেখিয়েই তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা রাজ্য এবং কলকাতাকে ‘নিরাপদতম’ বলে উল্লাস করতে নেমেছেন। তাল জুগিয়ে পেটোয়া সংবাদমাধ্যমগুলিও কলকাতাকে নিরাপদতম শহর বলে প্রচার করছে। কিন্তু নাগরিকদের জানা জ্বলন্ত ঘটনাগুলির সঙ্গে সংখ্যাতত্ত্বের কোনও মিল না থাকায় এনসিআরবি রিপোর্টের গুরুত্ব নিয়েই যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সেটা কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও বুঝতে পেরেছে। এনসিআরবি কর্তৃপক্ষ নিজে থেকেই তাই রিপোর্টে লিখে দিয়েছে, ‘‘রাজ্য ও শহরগুলির অপরাধ সংক্রান্ত সংখ্যাতত্ত্বের তুলনামূলক বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। অপরাধের সংখ্যা সর্বত্র সমানভাবে নথিভুক্ত হয়নি। যেখানে নথিভুক্ত বেশি হয়েছে সেখানে অপরাধের সংখ্যা বেশি প্রতীয়মান হচ্ছে।’’
আর যেখানে রাজনৈতিক কারণে নথিভুক্ত হয়নি? কিংবা ভুয়ো তথ্য পাঠানো হয়েছে? বোঝাই যাচ্ছে, কোনও যাচাই না করে রাজ্যের পাঠানো তথ্য ছাপিয়ে দায়িত্ব খালাস করেছে এনসিআরবি। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে ২০২২ সালের মার্চ মাসে শুধু বীরভূমের বগটুইতেই ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে তৃণমূলের বখরা-বিবাদে। কিন্তু এনসিআরবি’র রিপোর্টে সেসবের কোনও উল্লেখই নেই। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সংঘর্ষের হিংসার ঘটনা মাত্র ৯টি। কিন্তু মৃত্যু একজনেরও হয়নি। একইভাবে সাম্প্রদায়িক হিংসায় মৃত্যু স্বীকার করা দূরের কথা, সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনাই শূন্য বলে দাবি করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সরকারের পাঠানো রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ‘প্রেম নিয়ে বিরোধ এবং অবৈধ সম্পর্কের কারণে’ ২০২২ সালে ৪০ জন খুন হয়েছেন, কিন্তু রাজনৈতিক কিংবা সাম্প্রদায়িক হিংসায় কেউ নয়! একইভাবে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনাগুলিকেও বেমালুম চেপে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। প্রতি বছর ডেঙ্গুর মতো মারণ রোগে মৃত্যুর তথ্য গোপনে বিশেষ পারদর্শী এই রাজ্য সরকার সাম্প্রদায়িক হিংসা মোকাবিলার কাজেও আদৌ আন্তরিক কিনা, এনসিআরবি’র তথ্য ধামাচাপার ঘটনা তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। 


এনসিআরবি’তে রাজ্য সরকার যে ভুয়ো তথ্য পাঠিয়েছে তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। তথ্যের অধিকার আইন নিয়ে সক্রিয় সমাজকর্মী ও গবেষক বিশ্বনাথ গোস্বামী রাজ্যের বিভিন্ন পুলিশ কমিশনারেট ও জেলা পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা সম্পর্কে তথ্য জানতে চেয়েছিলেন। মাত্র ১২টি জেলা পুলিশ কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ কমিশনারেট থেকে তিনি ইতিবাচক সহযোগিতা পেয়েছেন। বহু ক্ষেত্রে তথ্য জানানোর আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে যা তথ্যের অধিকার আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু যে ১২টি কর্তৃপক্ষের থেকে তথ্য পাওয়া গিয়েছে তাতেই স্পষ্ট, ২০২২ সালের প্রথম ছ’মাসের সময়কালেই সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে ৩৫টি এবং প্রাণহানি ঘটেছে ১১ জনের। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক হিংসা ও তাতে প্রাণহানি সংখ্যা পূর্ববর্তী বছরগুলির থেকে বাড়ছে। কিন্তু এনসিআরবি রিপোর্টে গোটা বছরের সংখ্যাতত্ত্বে তা ‘শূন্য’ হয়ে গিয়েছে অদৃশ্য জাদুবলে! এর আগে ২০২১ সাল সম্পর্কিত রিপোর্টেও বলা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ১টি সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে। অথচ বিশ্বনাথ গোস্বামী তথ্যের অধিকার আইনে পুলিশ জেলাগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জেনেছেন, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে ৩০টি, প্রাণহানি হয়েছে ৮ জনের।
বিশ্বনাথ গোস্বামী বলেছেন, মাত্র ১২টি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জবাব পাওয়া গিয়েছে। কলকাতা পুলিশ কমিশনারেট, ডায়মন্ড হারবার পুলিশ জেলা কর্তৃপক্ষ, চন্দননগর কমিশনারেট কোনও জবাব দিতেই অস্বীকার করেছে। মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশ কর্তৃপক্ষ সাম্প্রদায়িক হিংসার তথ্য ‘নট অ্যাভেলেবল’ বলে জবাব পাঠিয়েছে। মালদহ জেলা পুলিশ কর্তৃপক্ষ সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ‘শূন্য’ বলে জানিয়েছে। তাতেও যা তথ্য পাওয়া গিয়েছে তার সঙ্গে এনসিআরবি রিপোর্টের কোনও মিলই নেই। 
শাসকদলের সঙ্গে মিলেমিশে এরাজ্যের প্রশাসনিক অফিসাররা তথ্য ধামাচাপা দিচ্ছেন, তথ্যের বিকৃতি ঘটাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্বনাথ গোস্বামী। তিনি বলেছেন, এরাজ্যে এমন থানা আছে যা সন্ধ্যা ৭টায় বন্ধ হয়ে যায়। এখানে তথ্য নথিভুক্ত হবে কী করে! তারপরেও তথ্য বিকৃত করার জন্য সরকারের নির্দেশে পেটোয়া এবং বেআইনি কাজে অভিযুক্ত অফিসারদের বসানো হয়েছে। তারা শুধু এনসিআরবি’কে ভুয়ো তথ্যই পাঠাচ্ছেন না, তথ্যের অধিকার আইনকে লঙ্ঘন করে নাগরিকদের তথ্য দিতে অস্বীকার করছেন। আমি তথ্য চেয়ে আবেদন করলেও কলকাতা পুলিশ আমাকে তথ্য দিতে অস্বীকার করেছে নানা অজুহাতে। পুলিশ ডাইরেক্টরেট থেকে লিখিতভাবে পুলিশ কমিশনারদের কাছে এবং জেলা পুলিশ সুপারদের কাছে নির্দেশ পাঠিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে নিষেধ করা হয়েছে এমন প্রমাণও আমার হাতে আছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment