Modi

‘চুপ রহো’: কাশ্মীরের রাজ্যপালকে কেন বলেছিলেন মোদী?

বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

১) ‘তুম আভি চুপ রহো। ইয়ে কুছ অউর চিজ হ্যায়।’ পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদী হামলায় ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানদের মৃত্যুর পরে জম্মু ও কাশ্মীরের তৎকালীন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিককে এমন কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কারণ সত্যপাল মালিক আঙুল তুলেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের গাফিলতির দিকে। পহেলগামে পর্যটকদের ওপরে সন্ত্রাসবাদীদের হামলা মনে করিয়ে দিয়েছে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় সেই সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা। পহেলগামে ২৬ জন পর্যটকের প্রাণহানির ঘটনাতেও কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি প্রকাশ্যে এসে গেছে। প্রশ্ন হলো, এখন কাকে চুপ করতে বলবেন প্রধানমন্ত্রী? 
২) পুলওয়ামায় সিআরপিএফ জওয়ানদের পরিবহণের জন্য বিমান চাওয়া সত্ত্বেও সরকারের তরফে কেন দেওয়া হয়নি বিমান? নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনি সত্ত্বেও ৩০০ কেজি বিস্ফোরক নিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের একটি গাড়ি এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পুলওয়ামার রাস্তায় ঘুরছিল কী করে? এরকম অনেক প্রশ্নেরই উত্তর আজও অজানা, কারণ মোদী সরকার আজ পর্যন্ত পুলওয়ামার ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেনি।
=======
নিজস্ব প্রতিনিধি: পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলায় পর্যটকদের মৃত্যুর ঘটনার পরে বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় বৈঠক হয়েছে রাজধানী দিল্লিতে। নিহতদের পরিবারের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানিয়ে নীরবতা পালন করা হয় বৈঠকে, সব রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে রেহাই পাচ্ছে না সরকার। সর্বদলীয় বৈঠকে সিপিআই(এম)’র সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য স্পষ্ট ভাষায় জানতে চেয়েছেন, পুলওয়ামার ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট আজও প্রকাশ্যে এল না কেন? যে ত্রুটি ও গাফিলতিগুলো পুলওয়ামায় ঘটেছিল সেগুলির পুনরাবৃত্তি রোধ নিশ্চিত করা না গেলে পহেলগামের ঘটনা ভবিষ্যতেও রোধ করা যাবে কী করে? 
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় সিআরপিএফ জওয়ানদের কনভয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছিল। ৩টি ব্যাটেলিয়নের জওয়ানদের সড়ক পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল জম্মু ও থেকে শ্রীনগরে। ওত পেতে ছিল সন্ত্রাসবাদীরা, জওয়ানদের কনভয় যখন জাতীয় সড়ক ধরে শ্রীনগরে যাচ্ছিল, সেই সময় কাকাপোরা-লেলহর লিঙ্ক রোড দিয়ে ঢুকে পড়ে বিস্ফোরক বোঝাই একটি গাড়ি। ডানদিক দিয়ে যাচ্ছিল জওয়ানদের কনভয়, বাঁ দিকে ছিল বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি। তারপর বিস্ফোরক বোঝাই গাড়িটি সোজা ধাক্কা মারে জওয়ানদের বাসে। ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর শুরু হয় কনভয় লক্ষ্য করে অবিরাম গ্রেনেড ও গুলিবৃষ্টি।  ৪০ জন জওয়ান প্রাণ হারান সেই ঘটনায়। মৃত্যু হয়েছিল  ২ বাঙালি জওয়ানেরও।
২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল পদে ছিলেন সত্যপাল মালিক। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সত্যপাল মালিক বিজেপি’তে ছিলেন ২০০৪ সাল থেকে। মোদী সরকারের আমলে বিহারে রাজ্যপালের দায়িত্বও পালন করেছিলেন, কিন্তু পুলওয়ামার ঘটনার পরে প্রধানমন্ত্রী মোদী ও বিজেপি’র সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে গভীর খাদ সৃষ্টি হয়। তবে মুখ খুলতে আরও সময় নেন সত্যপাল মালিক। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা ঘটনার পরে লোকসভা নির্বাচনে যুদ্ধজিগির তুলে জয়ী হয়েছিলেন মোদী। কিন্তু ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের একবছর আগে সত্যপাল মালিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করে দেন যে পুলওয়ামার ঘটনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় মোদী তাঁকে চুপ করে থাকতে বলেছিলেন। কেন জওয়ানদের নিরাপত্তা বিমান পরিবহণের ব্যবস্থা না করে বাসে করে পাঠানো হচ্ছিল সেই প্রশ্ন তোলায় মোদী তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুম আভি চুপ রহো। ইয়ে কুছ অউর চিজ হ্যায়।’ 
এখানেই শেষ নয়, জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল পদ থেকে সরানোর পরে সত্যপাল মালিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআই তদন্ত শুরু করে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে সত্যপাল মালিক যখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তখনও তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালায় সিবিআই। স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে তাঁর বিরুদ্ধে নাকি দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে মোদী সরকার! 
সত্যপাল মালিক ঠিক কী কথা প্রকাশ্যে আনার পরেই তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির হদিশ পায় সিবিআই? দ্য ওয়ার পত্রিকার পক্ষে করণ থাপার সেই সময়ে (২০২৩ সালে) সত্যপাল মালিকের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এখানে তারই একটি অংশ উল্লেখ করা হলো, যেখানে করণ থাপার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে গোয়েন্দাদের সতর্কবার্তা ছিল, তা সত্ত্বেও কী করে পুলওয়ামার ঘটনা ঘটলো?
জবাবে সত্যপাল মালিক বলেন, ঘটনা হলো এই যে সিআরপিএফ বিমান চেয়েছিল তাদের জওয়ানদের পরিবহণের জন্য, কারণ এত বড় কনভয় কখনোই সড়ক পথে নিয়ে যাওয়া হয় না। 
করণ থাপার: তারা আপনার কাছে চেয়েছিল’ 
সত্যপাল মালিক: না, আমার কাছে নয়। তারা রাজনাথ সিংয়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে চেয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তা দিতে অস্বীকার করে। আমার কাছে চাইলে আমি অবশ্যই বিমানের ব্যবস্থা করতাম, তাদের মাত্র পাঁচটি বিমান প্রয়োজন হতো, সেটাও তাদের দেওয়া হয়নি।
থাপার: আপনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে বিমান চাওয়া সত্ত্বেও দেওয়া হয়নি?
মালিক: হ্যাঁ, এবং আমি সেদিনই সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম যে এই ঘটনা ঘটেছে আমাদের গাফিলতির জন্য। জওয়ানদের বিমান দেওয়া হলে এই ঘটনা ঘটতে পারত না। এর উত্তরে প্রধানমন্ত্রী আমাকে তখন চুপ থাকতে বলেছিলেন। 
থাপার: এটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। আপনি প্রধানমন্ত্রীকে গাফিলতির কথা বলার পরেও তিনি আপনাকে চুপ করে থাকতে বলেন! মানুষকে গাফিলতির কথা জানাতে নিষেধ করেছিলেন! 
মালিক: অজিত দাভোলও আমাকে তাই বলেছিল। 
থাপার: তার মানে আপনি যা বলছেন তাতে বোঝা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী এবং দাভোল দুজনেই...
মালিক: আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে পুলওয়ামার ঘটনার পুরো দায় পাকিস্তানের ওপরে চাপছে তাই তখন চুপ করে থাকাই ভালো মনে করা হয়েছিল। 
থাপার: তার মানে এটা সরকারের একধরনের চালাকিপূর্ণ কৌশল যেখানে পাকিস্তানকে দায়ী করা যাবে?
মালিক: ঠিক তাই।
থাপার: এবং এর ফলে সরকারের কৃতিত্ব দেখানো যাবে, এবং সেটা নির্বাচনে সহায়ক হবে?
মালিক: ঠিক তাই।
থাপার: আপনি একটি ইউটিউব চ্যানেলকে একথাও বলেছেন যে কনভয় যাত্রার সড়কের লিঙ্ক রোডগুলিকে নিয়মমাফিক স্যানিটাইজ করা হয়নি? 
মালিক: হ্যাঁ, অবশ্যই স্যানিটাইজ করা হয়নি। ঐ রুটের ৮ থেকে ১০টা লিঙ্ক রোড ছিল ঐ এলাকায়। তার একটাতেও প্রহরা রাখা হয়নি যাতে কনভয়ে কেউ ঢুকতে না পারে। কিছুই করা হয়নি। 
থাপার: আপনি একথাও বলেছেন যে দোভালের সঙ্গে কথা বলার পরেই আপনি বুঝতে পারেন যে দায় পাকিস্তানের ঘাড়ে যাবে এবং তা নির্বাচনে জিততে সাহায্য করবে। কিন্তু সত্যিই পাকিস্তান, পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদী অথবা পাকিস্তানি তাঞ্জিম এই ঘটনার জন্য কতটা দায়ী ছিল? 
মালিক: যে পরিমাণ বিস্ফোরক সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে ছিল তা অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ সম্ভব ছিল না। এটা অবশ্যই পাকিস্তান থেকে বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থতা ছিল আমাদের তরফে, আমার তরফেও। একটা গাড়ি আনুমানিক ৩০০ কেজি বিস্ফোরক নিয়ে ১০-১২ দিন ধরে ঐ এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল, অথচ আমরা সেটাকে চিহ্নিতই করতে পারিনি।
থাপার: আপনি আমাকে একটা কথা বলুন, পুলওয়ামায় ঠিক কী ঘটেছিল তা আমরা কি কোনোদিন জানতে পারবো?
মালিক: হ্যাঁ, সরকার সবই জানে। 
থাপার: কিন্তু সরকার সব কথা জানালে তো তারাই ব্যর্থতার জন্য দায়ী হবে? 
মালিক: তা তো বটেই।
থাপার: তাহলে সরকারের তথ্য প্রমাণ গোপন রাখার যথেষ্ট কারণ আছে। 
মালিক: সরকারের তথ্য গোপন রাখার যথেষ্ট কারণ আছে, এবং বিষয়টি অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহারেরও যথেষ্ট কারণ আছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment