Agrarian crisis

কোষাগারের দেড় কোটি খরচ করেও ধান বেচায় কৃষক টানতে ব্যর্থ রাজ্য

রাজ্য

 

ভুয়ো অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ধান বিক্রির দুর্নীতি এখন টের পাচ্ছে রাজ্যের খাদ্য দপ্তর! খরিফ মরশুমে ধান কেনার জন্য ২৫ লক্ষ কৃষককে নথিভুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করেছিল রাজ্য সরকার। চলতি মরশুমে ধান কেনার জন্য এখনও পর্যন্ত মাত্র ৯ লক্ষ ৭০ হাজার কৃষক খাদ্য দপ্তরের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে। অথচ চলতি মরশুমে ধান কেনার আগে জেলা খাদ্য দপ্তরের কাছে ‘মিশন মোডে’ কৃষকদের নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কৃষকদের আকৃষ্ট করার জন্য সরকারি কোষাগার থেকে বিজ্ঞাপন খাতে ১ কোটি ৪৭ লক্ষ টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু প্রায় দেড় কোটি খরচ করেও রাজ্যজুড়ে ধান কিনতে কৃষকদের খুঁজে পাচ্ছে না খাদ্য দপ্তর।
সরকারের নিয়ম অনুযায়ী ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করতে হলে নথিভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক। এতদিন বিপুল সংখ্যায় সরকারের কাছে কৃষক নথিভুক্ত হতেন। এবারই তার ব্যতিক্রম। যার অবধারিত প্রভাব পড়েছে ধান সংগ্রহেও।
গত ১ নভেম্বর থেকে ২০২৩-২৪ বর্ষের ধান কেনা শুরু হয়েছে। গত বছর ৯দিনে রাজ্যের খাদ্য দপ্তর প্রায় ১৫ হাজার টন ধান কিনেছিল। এবার এখনও পর্যন্ত গত ১ নভেম্বর থেকে সরকারের সংগ্রহে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান কেনার পরিমাণ মাত্র ১৬০০ টন! এক বছরের ফারাকে ১০ শতাংশ মাত্র ধান এখনও পর্যন্ত কিনতে পেরেছে রাজ্যের খাদ্য দপ্তর। ফলে চলতি মরশুমে ধান কেনা নিয়ে রীতিমত উদ্বেগে রাজ্যের খাদ্য দপ্তর। 
ধান বিক্রির জন্য কৃষকদের নথিভুক্ত হতে তীব্র অনীহা নিয়ে খাদ্য দপ্তরের মধ্যেই একাধিক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। খাদ্য দপ্তরের এক আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘রেশন দুর্নীতি নিয়ে প্রাক্তন খাদ্য মন্ত্রী গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে নথিভুক্ত হওয়ার জন্য আর আগ্রহ দেখাচ্ছে না ব্যবসায়ী থেকে ফড়েরা। যার পরিণতিতেই নথিভুক্ত হওয়া কৃষকদের সংখ্যায় এই ঘাটতি।’’ ভুয়ো অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ধান কেনার ঘটনা যে এরাজ্যে গত ছয়-সাত বছর ধরে চলে আসছে তা খাদ্য দপ্তরের অজানা নেই। কিন্তু এবার দুর্নীতির আবহে মন্ত্রীর গ্রেপ্তারির পর ফড়েরা যে কিছুটা হলেও পিছু হটেছে তা জানাচ্ছেন খাদ্য দপ্তরের ধান কেনার কেন্দ্রের কর্মচারীরা। দক্ষিণবঙ্গের এক সিপিসি (সেন্ট্রালাইজইড পারচেস সেন্টার)-তে কর্মরত এক কর্মচারীর বক্তব্য, ‘‘গত মরশুমে নথিভুক্ত হওয়া এক কৃষককের আবেদন যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে, তার নাম ও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নাম্বারের মিল থাকলেও ভোটার কার্ড ও আধার কার্ডের সঙ্গে বিস্তর অমিল। এখন যাচাই করতে গিয়ে বোঝা যাচ্ছে, অতীতে এইসব ভুয়ো অ্যাকাউন্ট নাম্বার ব্যবহার করে ধান কেনা হয়েছে।’’
ধান বিক্রি করার জন্য নথিভুক্ত কৃষকদের প্রাথমিক শর্ত ছিল কৃষি দপ্তরের কৃষকবন্ধু প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট কৃষকের নথিভুক্ত থাকা। মুর্শিদাবাদ জেলাতে এতদিন দেড় লক্ষ কৃষক খাদ্য দপ্তরের কাছে ধান বিক্রির জন্য নথিভুক্ত ছিল। কিন্তু এখন ঠেলায় পড়ে তথ্য যাচাই করতে গিয়ে জেলা প্রশাসন জানতে পেরেছে, দেড় লক্ষ কৃষকদের মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার কৃষক কৃষি দপ্তরের কৃষকবন্ধু প্রকল্পে যুক্ত। বাকি ১ লক্ষের কৃষকবন্ধু প্রকল্পের সঙ্গে কোনও অস্তিত্বই নেই। এখন সেই মুর্শিদাবাদ জেলাতেই সম্প্রতি ধান কেনা নিয়ে এক বৈঠকে জেলাশাসকই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘কীভাবে কৃষকবন্ধু প্রকল্পে না থেকেও ১ লক্ষ কৃষক সরকারের কাছে ধান কেনার জন্য নথিভুক্ত হয়ে গেছে?’’ ফলে ধান কেনায় রাজ্যের খাদ্য দপ্তরের সীমাহীন দুর্নীতিকে এখন আর কোনোভাবেই এড়াতে পারছে না খাদ্য দপ্তর। 
একদিকে কৃষক সরকারের কাছে নথিভুক্ত হচ্ছে না। উলটোদিকে চলতি মরশুমে গতবারের থেকে বাড়িয়ে ৭০ লক্ষ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করেছে রাজ্যের খাদ্য দপ্তর। তারমধ্যে খরিফ মরশুমেই ৬৫ লক্ষ টন ধান কিনবে বলে ঠিক হয়ে আছে। কীভাবে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো যাবে তা নিয়ে এখন থেকেই চিন্তায় খাদ্য দপ্তরের আধিকারিকরা। 
গোটা ঘটনার নেপথ্যে আছে এরাজ্যে রেশন দুর্নীতির আবহে রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্য মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ইডি’র হাতে গ্রেপ্তার হওয়া। খাদ্য দপ্তরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ এক রাইস মিল মালিকের বক্তব্য, ‘‘কৃষকরা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করবে। তার বিনিময়ে সরকার কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিয়ে ধান কিনে নেবে। রাইস মিলের কাজ সেই ধান থেকে চাল তৈরি করে সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া। এর বেশি আর কোনও দায়িত্ব রাইস মিল নিতে আর আগ্রহী নয়।’’
১ নভেম্বর থেকে ধান কেনা শুরু হলেও এরাজ্যে সাধারণভাবে ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে নতুন ধান উঠতে শুরু করে। ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগামী বছরের জানুয়ারি মাসজুড়ে কৃষকদের কাছ থেকে সরকারের ধান কেনার সেরা সময়। এতদিন ভুয়ো আক্যাউন্ট ব্যবহার করে ফড়েদের মাধ্যমে সরকার ধান কিনে নিত। কিন্তু এবার ইডি’র হানায় সেই পথ বন্ধ। ফলে প্রকৃত কৃষকদের সরকারকে ধান বিক্রি করার জন্য উৎসাহিত না করলে রাজ্যের রেশন ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা। 
 

Comments :0

Login to leave a comment